কমছে বন্যার পানি বাড়ছে দুর্ভোগ, দূরে যাচ্ছে না ত্রাণ

| আপডেট :  ৩০ আগস্ট ২০২৪, ১০:৫৬  | প্রকাশিত :  ৩০ আগস্ট ২০২৪, ১০:৫৬


কমছে বন্যার পানি বাড়ছে দুর্ভোগ, দূরে যাচ্ছে না ত্রাণ

কুমিল্লা প্রতিনিধি


উজানের ঢল ও টানা বৃষ্টিতে আকস্মিক বন্যার কবলে পড়া কুমিল্লার পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি। জেলার ১৪টি উপজেলার বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হওয়ার আট দিন পার হলেও এখনো বন্ধ হয়নি ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পানি। তবে আগের চেয়ে উজানের পানির প্রবাহ কিছুটা কমেছে। কুমিল্লা জেলায় বানের পানির উচ্চতা কিছুটা কমলেও মানুষের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। এদিকে পানি কামায় ভেসে উঠছে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাটের চিত্র। রাস্তার ওপর দিয়ে গড়িয়ে যাওয়া পানির স্রোতের তীব্রতায় প্রায় রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলার রায়কোট উত্তর ইউনিয়নের পিপড্ডা গ্রামের বাসিন্দা আরিফুর রহমান মজুমদার একজন শতবর্ষী মানুষ। নিজেই হাঁটাচলা করে মসজিদে যেতে পারেন; বাড়িতে সাংসারিক বিভিন্ন কাজও সামলান।

ভারত থেকে হু হু করে নেমে আসা পানি ও কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে ভয়াবহ বন্যায় শতবর্ষী এই বৃদ্ধের বাড়িও তলিয়ে গেছে। দীর্ঘ এই জীবনে নিচের চোখে কখনও এত পানি দেখেননি বলে জানান তিনি। এছাড়া বানভাসিদের ত্রাণ নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন এই বৃদ্ধ।

আরিফুর বলেন, “আমার বয়স এখন প্রায় ১১০ বছর। আমার এই জীবনে এত বড় বন্যা, এত পানি দেখিনি। কোথা থেকে এল এই পানি সেটাই ভেবে কূল পাচ্ছি না। আমার বাবার কাছেও কখনও শুনিনি এমন বন্যার কথা। মানুষের বাড়িঘর পানির নিচে। ডুবে গেছে সব সড়কপথ।

প্রবল স্রোতে পানির চাপে বিভিন্ন স্থান ভেঙে যায় রাস্তাঘাটের ওপর দিয়ে গড়িয়ে যাওয়ায় ধসের ঘটনা ঘটেছে। দেখা যায়, প্রতিটি ইউনিয়নে কম বেশি রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিছু কিছু রাস্তা ধসে বিভক্ত হয়ে পড়ায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে।

জেলার বন্যাকবলিত বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, ধীরগতিতে কমতে শুরু করেছে বন্যার পানি। তবে গত ২২ আগস্ট রাত পৌনে ১২টার দিকে বুড়িচং উপজেলার ষোলনল ইউনিয়নের বুড়বুড়িয়া এলাকায় যেই স্থান দিয়ে গোমতী নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙেছিল-সেই স্থান দিয়ে এখনো স্রোতের মতো লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে। এতে বুড়িচং ও পাশের ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি এখনো ভয়াবহ আকারে রয়েছে। এদিকে গোমতী নদীর পানি বিপৎসীমার ৬৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী খান মো. ওয়ালিউজ্জামান এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, উজান থেকে নেমে আসা পানির প্রবাহ কিছুটা কমলেও তা একেবারে বন্ধ হয়নি। গোমতীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

বন্যার্তরা বলছেন, কুমিল্লার বাইরে থেকে যারা ত্রাণ নিয়ে আসছেন তাদের অনেকেই ট্রাকে করে আসছেন। কিন্তু বন্যার্তদের কাছে পৌঁছার সব রাস্তাঘাটে পানি। কোথাও কোথাও আবার রাস্তাঘাট ভেঙেও গেছে।

ফলে বন্যার্তদের কাছে পৌঁছাতে হলে নৌকা বা স্পিডবোট প্রয়োজন- যা এখন খুবই অপ্রতুল। ফলে ডাঙ্গার কাছাকাছি থাকা লোকজনের হাতে ত্রাণ পৌঁছাছে বেশি।

অপরদিকে ত্রাণ এলেই সড়কের আশপাশের মানুষ ভিড় করে গাড়ি আটকে দিচ্ছে। তারা বারবার ত্রাণ পাচ্ছে। ত্রাণ না পেলে গাড়িতে হামলার ঘটনাও ঘটছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বৃহস্পতিবার গোমতী নদী পাড়ের বিভিন্ন এলাকার পানিবন্দি মানুষ এসব অভিযোগ করেন।

গোমতী নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে যাওয়া এবং সালদা ও ঘুংঘুর নদীর ভাঙনের কারণে কার্যত পানির ওপর ভাসছে বুড়িচং ও ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ত্রাণ সহায়তা আসছে বুড়িচং উপজেলার জন্য।

এসব ত্রাণের গাড়ি কুমিল্লা শহরতলীর শাসনগাছা থেকে পালপাড়া ব্রিজ হয়ে কালখাড়পাড় এলাকা দিয়ে বুড়িচংয়ে প্রবেশ করে। কুমিল্লা নগরীর বিভিন্ন বস্তি থেকে আসা লোকজন এ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে। বন্যাদুর্গত নয়, এমন এলাকার লোকজনও ভিড় করছে এই পথটিতে।

ত্রাণের গাড়ি এলেই সেটিকে জটলা বেঁধে ঘিরে ধরা হচ্ছে। যার কারণে ত্রাণবাহী গাড়িগুলো ঠিকভাবে সামনের দিকে অগ্রসর হতে পারে না। কিছু গাড়ি ভিড় ঠেলে একটু সামনে অগ্রসর হলেও অনেক সময় নৌকার অভাবে গন্তব্যে খাবার পৌঁছে দিতে পারছে না।

বুড়িচং প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক জহিরুল হক বাবু জানান, যাদের ত্রাণ দরকার তারা পাচ্ছেন না; অথচ যারা পাচ্ছেন তারা একাধিকবারও পাচ্ছেন। বন্যার শুরু থেকেই সব জায়গায় শৃঙ্খলার অভাব দেখছি আমরা। ত্রাণের গাড়িগুলো কুমিল্লা শহর হয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতেই একদল লোক সেটিকে ঘিরে ফেলে; যাদের প্রায় সবাই ডাঙার মানুষ। কৌশলে বন্যার্তদের ত্রাণে ভাগ বসাচ্ছে তারা। সড়কে প্রশাসনের সরব উপস্থিতি ও সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ থাকলে যে পরিমাণ ত্রাণ আসছে, তা দিয়ে দুর্গত এলাকায় কয়েকদিন চলে যেত। মানুষের মধ্যে এমন হাহাকার থাকতো না।”

এ ধরনের প্রবণতার কথা স্বীকার করেছেন বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাহিদা আক্তার।

তিনি বলেন, “আমাদের পুরো উপজেলা এখনো পানির উপর ভাসছে। প্রতিনিয়ত পানির মাত্রা বাড়ছে। ইউনিয়ন পরিষদের সচিবদের দিয়ে দুর্গম এলাকায় খাবার পৌঁছানো হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি সমভাবে ত্রাণ বিতরণ করতে। এরই মধ্যে একাধিক স্থানে ত্রাণের গাড়িতে হামলা হয়েছে। সেনাবাহিনী মাঠে কাজ করছে। তবে যে পরিমাণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা দরকার, তা পাওয়া যাচ্ছে না। এসব বিষয়ে আমরা কাজ করছি।

ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) স ম আজহারুল ইসলাম বলেন, এরই মধ্যে এই উপজেলার জন্য আসা সরকারি বরাদ্দের টাকা প্রায় শেষ। বুড়িচং হয়ে এখানে ত্রাণ পৌঁছানো বর্তমানে সম্ভব না। কারণ পানি অনেক বেশি, সব সড়কপথ পানিতে ভাস। এ উপজেলার জন্য যারা ত্রাণ কাজে সহায়তা করতে চান, তারা মুরাদনগরের কোম্পানীগঞ্জ হয়ে ব্রাহ্মণপাড়ায় ঢুকতে পারবেন। সেভাবে ত্রাণ সহায়তা নিয়ে আসার জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি।

কুমিল্লার জেলা প্রশাসক খন্দকার মু মুশফিকুর রহমান বলেন, বন্যাকবলিত উপজেলাগুলোর দুর্গত এলাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। বন্যাকবলিত মানুষের মাঝে শুকনা খাবার, স্যালাইন ও ওষুধ বিতরণ করা হচ্ছে। ত্রাণসামগ্রী বিতরণও অব্যাহত আছে। আমরা সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর রাখছি। যারা আটকে পড়েছেন তাদেরকে উদ্ধারে কাজ চলছে। দুর্গম এলাকার সবাই যেন খাদ্য সহায়তা পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখা হচ্ছে।

বিবার্তা/এসবি

© BBARTA24.NET
Developed by : ORANGEBD
  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত