দুই পদ বিলুপ্তির গোপন মিশন ব্যর্থ হয়ে গেল

| আপডেট :  ১৫ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:১৩  | প্রকাশিত :  ১৫ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:১৩

প্রশাসনে মঞ্জুরিকৃত দু’টি পদ বিলুপ্ত করার গোপন মিশন ব্যর্থ হয়ে গেছে। সম্প্রতি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ উদ্যোগটি নিয়েছিল। কিন্তু বিষয়টি শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকেনি। পদ দুটি হলো ‘সহকারী সচিব/সিনিয়র সহকারী সচিব’। গত বৃহস্পতিবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা (সওব্য) অনুবিভাগে অনুষ্ঠিত এ সংক্রান্ত বৈঠক থেকে প্রস্তাবটি নাকচ হয়ে যায়।

তবে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে এ নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠার কমতি নেই। এ ধরনের উদ্যোগে তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়েছেন সচিবালয়ে কর্মরত তিন সহস াধিক এওপিওদের (প্রশাসনিক ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তা) অনেকে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রস্তাবটি গৃহীত হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়তে হতো নন-ক্যাডার কোটায় সহকারী সচিব পদে পদোন্নতি প্রত্যাশী কর্মকর্তাদের। কেননা বাস্তবে সচিবালয়ে সরকারের প্রথম শ্রেণির ভিত্তি পদ হলো সহকারী সচিব। সিনিয়র সহকারী সচিব পদটি মূলত সিনিয়র স্কেল। এটি কোনো পদোন্নতির পদ নয়। ফলে সচিবালয়ে ক্যাডার কর্মকর্তাদের জন্য এই দুটি পদ এন্টি পদ হিসাবে বিবেচিত না হলেও নন-ক্যাডার কোটায় পদোন্নতি পাওয়া দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তাদের জন্য এটি পদোন্নতির ফিডার পদ। এর ফলে এই পদ বিলুপ্ত হলে তাদের উপরে ওঠার সিঁড়ি আর থাকবে না।

পদ বিলুপ্তির খবরটি অনেকটা গুজব আকারে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বৈঠকের এক দিন আগে সচিবালয়ে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু কারও কাছে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য কিংবা প্রস্তাবের কাগজ ছিল না। কঠোর গোপনীয় রক্ষা করায় চেষ্টা তদবির করেও প্রস্তাবের কাগজপত্র তারা জোগাড় করতে পারেননি। তা সত্ত্বেও বৈঠকের দিন বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হন। যদিও বিষয়টি নিয়ে সচিবালয় প্রশাসনে কর্মরত দুই হাজার ১২ জন প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং ৯৩০ জন ব্যক্তিগত কর্মকর্তা চরম ক্ষুব্ধ।

সূত্র জানায়, পদ সৃষ্টি ও বিলুপ্তকরণ সংক্রান্ত তিন পৃষ্ঠার একটি প্রস্তাব গত ১৫ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। সেখানে শেষ পৃষ্ঠায় ৭(৩)নং অনুচ্ছেদে উপপ্রধানের ১টি, সিনিয়র সহকারী সচিবের ২৯টি ও সিনিয়র সহকারী প্রধানের ৯টিসহ মোট ৩৯টি পদ বিলুপ্তির প্রস্তাব করা হয়। এ ছাড়া অন্যান্য এজেন্ডার মধ্যে ওই প্রস্তাবের ৭(১), ৭(২) এবং ৭(৪) নং প্রস্তাবে ক্যাডারের ৪৩টি পদ সৃষ্টিসহ আরও কিছু প্রস্তাবনা ছিল।

গত বৃহস্পতিবার বিকালে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা (সওব্য) অনুবিভাগে এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সওব্য অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন, এনসিডি। তবে শেষ পর্যন্ত সিনিয়র সহকারী সচিবের পদ বিলুপ্তির প্রস্তাব সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়নি। বৈঠক সূত্র যুগান্তরকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং পরিবার কল্যাণ বিভাগের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, সভায় আলোচনা হলেও সিনিয়র সহকারী সচিবের পদ বিলুপ্তির প্রস্তাবটি গৃহীত হয়নি।

এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নেতৃস্থানীয় কয়েকজন এওপিও বলেন, এমনিতে যথাযথভাবে কোটা পূরণ করে সময়মতো পদোন্নতি দেওয়া হয় না। উপরন্তু এভাবে সিনিয়র সহকারী সচিবের পদ বিলুপ্ত হয়ে গেলে ভবিষ্যতে তাদের এ পদে প্রবেশ করার পথ একেবারে রুদ্ধ হয়ে যাবে। এমনকি তারা এও মনে করেন, এই প্রস্তাব ছিল মহল বিশেষের নীলনকশা অনুযায়ী একটি টেস্ট কেস মাত্র। এটি সফল হলে ভবিষ্যতে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য মন্ত্রণালয়/বিভাগ থেকে সহকারী সচিব ও সিনিয়র সহকারী সচিবের পদও বিলুপ্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হতো, যা বাস্তবায়িত হলে প্রকারান্তরে নন-ক্যাডার কোটায় সহকারী সচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব ও উপসচিব পদে পদোন্নতির ধারাবাহিক পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে যেত।

তারা বলেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিপিটি উইং থেকে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে ক্যাডার কর্মকর্তাদের অর্গানোগ্রাম বা সাংগঠনিক কাঠামো সংশোধন করার যে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে সেখানে ভিত্তি পদ ধরা হয়েছে উপসচিব। অপর দিকে এ সংক্রান্ত রুলস বা বিধিবিধানও সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ যৌথভাবে কাজটি গোপনীয়তা রক্ষা করে করছে। কিন্তু সত্যিই যদি সচিবালয়ে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোতে ক্যাডার কর্মকর্তাদের ভিত্তি বা এন্টি পদ উপসচিব করা হয় তাহলে তো এওপিওদের ভবিষ্যতে সহকারী সচিব থেকে উপসচিব পর্যন্ত নির্ধারিত কোটা অনুযায়ী পদোন্নতির আর কোনো সুযোগ থাকবে না।

পদোন্নতি দিলেও তাদের পূর্বের পদে কাজ করতে হবে। সেটি তো সম্ভব হবে না। এর ফলে ১৯৯২ সাল থেকে সচিবালয়ের নন-ক্যাডার কর্মকর্তারা কোটা ভিত্তিতে সহকারী সচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব এবং উপসচিব পদে পদোন্নতি পাওয়ার যে অধিকার অর্জন করে আসছেন সেটি চিরতরে বন্ধ হবে।’ তারা মনে করেন, কেউ কেউ হয়তো এওপিওদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদায় উন্নীত করে দুধের স্বাদ ঘোল খেয়ে মেটাতে রাজি থাকবেন।

কিন্তু সেটি হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে নতুন করে যারা পিএসসির মাধ্যমে দ্বিতীয় এই পদে যোগদান করেছেন। কোটা পদ্ধতি না থাকলে যাদের অনেকের ক্যাডার সার্ভিসে মেধা তালিকায় চাকরি পেতেন। এ ছাড়া গত ১০-১২ বছরে যারা এওপিও পদে যোগ দিয়েছেন কিংবা পদোন্নতি পেয়ে নিচ থেকে এসেছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই উচ্চশিক্ষিত ও মেধাবী। সহকারী সচিব হতে না পারলে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।’

সূত্র জানায়, ১৯৯২ সালে ক্যাডার একীভূতকরণ রুলস অনুযায়ী সচিবালয়ে ভিত্তি পর্যায়ে তিন ভাগের এক ভাগ ধরে ১৪১টি সহকারী সচিবের পদ ফিডারধারীদের (এওপিও) সংরক্ষিত করা হয়। একইভাবে সিনিয়র সহকারী সচিবের পদ সংরক্ষণ করা হয় ২৫%, অর্থাৎ চার ভাগের এক ভাগ। এ ছাড়া নন-ক্যাডার থেকে ৯টি উপসচিবের পদ সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু অভিযোগ আছে, অদ্যাবধি এই কোটা কখনো পূরণ করা হয় না। বর্তমানে নন-ক্যাডার কোটায় সহকারী সচিবের পদ সংরক্ষণ করা হয়েছে ২৬৭টি। এর মধ্যে শূন্যপদ রয়েছে ৫টি। সিনিয়র সহকারী সচিবের পদ ৫৭টি সংরক্ষণ করা আছে। শূন্য আছে ৭টি। তবে অনেক বিলম্বে হলেও উপসচিবের ৯টি পদ বর্তমানে পূরণ আছে। কিন্তু বাস্তবে মোট পদের রেশিও হিসাব করলে কোনো স্তরে প্রাপ্য কোটা পূরণ করা হয়নি।

বর্তমানে সহকারী সচিব/সিনিয়র সহকারী সচিবের মঞ্জুরিকৃত পদ রয়েছে ২৯৬০টি। এর এক তৃতাংশ হলে নন-ক্যাডার কোটায় সহকারী সচিবের পদ দাঁড়াবে প্রায় এক হাজার। কিন্তু বাস্তবে দেওয়া হয়েছে মাত্র ১৪১টি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রশাসনে বর্তমানে উপসচিব থেকে তদূর্ধ্ব পর্যায়ে যে নীতি অনুসরণ করে ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে সেখানে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোতে পদ দুটিতে ক্যাডার কর্মকর্তা পদায়ন করার প্রয়োজন পড়বে না। ইতোমধ্যে গত এক দশক থেকে বেশির ভাগ সিনিয়র সহকারী সচিবের পদগুলোতে কাজ করছেন উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা। যাদের অনেকে সুপারনিউমারারি নামক সৃষ্ট উপসচিবের অতিরিক্ত পদের পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তা।

আবার বেশ কিছু মন্ত্রণালয়/বিভাগে একসময় যে কক্ষে সিনিয়র সহকারী সচিব বসতেন, এখন সেখানে যুগ্মসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে পদায়ন করা হয়েছে। যেখানে বসতেন উপসচিব, সেখানে দেওয়া হয়েছে যুগ্মসচিব কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে অতিরিক্ত সচিবকে। এর ফলে প্রশাসনে পদোন্নতিতে গতি বাড়লেও অভ্যন্তরীণ কাজকর্মে ভিন্ন এক অস্বস্তিকর পরিবেশ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। প্রকাশ্যে না বললেও ক্যাডার কর্মকর্তাদের অনেকে এমন পরিস্থিতি নিয়ে সংক্ষুব্ধ।

প্রসঙ্গত, বর্তমানে হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী উপসচিব পদে মঞ্জুরিকৃত পদের সংখ্যা ৯৯০টি। বাস্তবে উপসচিব রয়েছেন এক হাজার ৮৪১ জন। এর মধ্যে ২০০৮ সালে উপসচিবের ৪৩০টি সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টি করা হয়। যুগ্মসচিব পদে মঞ্জুরিকৃত পদ ৩২৯টি। বাস্তবে যুগ্মসচিব আছেন ৭১০ জন। অতিরিক্ত সচিবের মঞ্জুরিকৃত পদ ১৩৭টি। অতিরিক্ত সচিব আছেন ৪৮৫ জন। সচিব ও সিনিয়র সচিবের মঞ্জুরিকৃত পদ ৬৯টি। বাস্তবে কর্মরত আছেন ৭৭ জন।

এ ছাড়া সচিবালয়ে সাধারণত প্রশাসন ক্যাডারের কোনো কর্মকর্তা চাকরির শুরুতে যোগদান করেন না। তাদের ক্যাডারের এন্টি পদ হিসাবে সহকারী কমিশনার পদে প্রথমে মাঠ প্রশাসনে যোগদান করতে হয়। প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের অনেকে সিনিয়র স্কেল পাওয়ার পর মাঠ প্রশাসনের পদ ছাড়াও সিনিয়র সহকারী সচিব পদে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সাংগঠনিক কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত সিনিয়র সহকারী সচিব পদে যোগদান করে থাকেন।

সূত্র: যুগান্তর

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত