মালিকের যে কৌশলে চাঁদা তুলতে বাধ্য হয় হাতি
রাজধানীর বারিধারা সড়ক। হঠাৎ বিশাল আকারের একটি হাতি কয়েকটি প্রাইভেট কারের পথ আটকে দাঁড়াল। তা দেখে কাছে এসে দাঁড়াল উৎসুক মানুষ। মুহূর্তেই সড়কে প্রাইভেট কার ও অন্যান্য যানে জট লেগে যায়। এ সময় মাহুতের (হাতিচালক) ইশারায় হাতিটি বীরদর্পে গাড়িচালক ও পথচারীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করা শুরু করে। মাহুত হাতিটির কানের নিচ এবং গলায় ক্ষণে ক্ষণে আঘাত করে, যাতে দ্রুত চাঁদা আদায় করে হাতিটি। লোহা-বাঁশের সমন্বয়ে (অগ্রভাগ সুঁইয়ের মতো ধারালো) তৈরি লাঠি দিয়ে আঘাত করায় হাতিটি নিরুপায় হয়ে মাহুতের নির্দেশনা মানছিল। এটি গত শনিবারের ঘটনা।
এভাবে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ১৫-১৭টি হাতি দিয়ে চাঁদা তোলা হয়। হরিণ ও হাতি লালনপালন বিধিমালা ২০১৭-এর শর্ত অনুযায়ী, লাইসেন্স করা হাতি দিয়ে বাজার, রাস্তাঘাট, লোকালয় কিংবা কোনো স্থানে চাঁদা সংগ্রহ করা নিষেধ। বন সংরক্ষক তথা সংশ্লিষ্টদের অনুমতি ছাড়া হাতি ক্রয় এবং বিক্রয় করাও নিষেধ। জানা যায়, ৯৬টি হাতির মধ্যে মাত্র ২৯টির লাইসেন্স রয়েছে। লাইসেন্সকৃত হাতির পাশাপাশি লাইসেন্সবিহীন হাতি দিয়ে চাঁদাবাজিসহ নানা অবৈধ কাজ করানো হচ্ছে। আইন অমান্য করেই রাজধানী তথা দেশের বিভিন্ন স্থানে হাতি দিয়ে দিনের পর দিন চাঁদা তোলা হচ্ছে। মাহুতরা এসব হাতি মালিকদের কাছ থেকে ভাড়া নেন। আর ভাড়া বাবদ মালিকদের দিতে হয় ৩৫-৪৫ হাজার টাকা। মাহুতরা ভাড়ার টাকা ওঠানোর পাশাপাশি লাভ ওঠাতে হাতিগুলোর ওপর কঠোর থেকে কঠোর হন। তারা হাতি দিয়ে রাস্তার ওপর গাড়ি কিংবা পথচারী থামিয়ে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করেন। অনেক সময় বাসা-বাড়িতে প্রবেশ করে টাকা আদায় করেন। সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় হলো-হাতিগুলোকে ক্ষুধার্ত রাখার পাশাপাশি আঘাত করা হয়। যাতে মাহুতরা যা বলেন হাতি পালন করে। বছরে হাতির লাইসেন্সের নবায়ন ফি মাত্র ১ হাজার টাকা। কিন্তু এর বিপরীতে হাতি ভাড়া দিয়ে মালিকরা বছরে প্রায় ৫-৬ লাখ টাকা আয় করেন বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ বলেন, এসব হাতি নির্দিষ্ট খামারে লালনপালন করার কথা। কিন্তু তা না করে হাতিগুলো ভাড়া খাটানো হচ্ছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালের জরিপ অনুযায়ী দেশে প্রায় ৯৬টি ব্যক্তিমালিকানা হাতি রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ২৯টি হাতি লাইসেন্স করে নেওয়া হয়েছে।
অপর এক কর্মকর্তা বলেন, একসময় মালিকরা হাতি দিয়ে সার্কাস কিংবা বনে গাছ টানার কাজ করত। বর্তমানে সার্কাস নেই; গাছও টানা হয় না। ভারত, নেপাল, শ্রীলংকাসহ বিভিন্ন দেশে ‘এলিফ্যান্ট অরফানেজ’ থাকলেও বাংলাদেশে নেই।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সড়কে গাড়ি ও পথচারী আটকিয়ে চাঁদা আদায় করে হাতি। দাবীকৃত টাকা না পেলে হাতি পথচারী ও গাড়িচালকদের আটকে রাখে। সবুজ নামের এক মাহুত জানান, ঢাকা শহরে প্রায় ১৭টি হাতি দিয়ে চাঁদা তোলা হয়। মাহুতের কোনো হাতি নেই, সবই ভাড়ায় আনা। একটি হাতির সঙ্গে মাহুতের পাশাপাশি আরও ২ জন থাকেন। সহকারীকে ৭০০ টাকা করে দিতে হয়। প্রতিদিন একটি হাতি দিয়ে গড়ে প্রায় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা উঠানো হয়। ২৪ ঘণ্টায় হাতির খাবার বাবাদ খরচ লাগে ৩ হাজার টাকার মতো।
আপনার হাতির মালিক কে-জানতে চাইলে ওই মাহুত বলেন, নাম বললে আর হাতি ভাড়া পাব না। মালিক হাতির খোঁজ নেন না। আমরা মাসে ভাড়ার টাকা পৌঁছে দিই। বয়স্ক হাতির ভাড়া মাসে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা। কম বয়সি হাতির ভাড়া ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা।
‘পিপল ফর অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন-বাংলাদেশ’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান স্থপতি রাকিবুল হক এমিল বলেন, বাংলাদেশে ব্যক্তিমালিকানায় যেসব হাতি রয়েছে, সেগুলো দিয়ে বর্বর কর্মকাণ্ড করানো হচ্ছে। চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে হাতিগুলোকে শারীরিক নির্যাতন করা হচ্ছে। মাহুতের হাতে থাকা লাঠির মাথায় সূক্ষ্ম ধারালো হুক থাকে, যা দিয়ে হাতিকে আঘাত করে রক্তাক্ত করা হয়। আঘাতের ভয়ে হাতিগুলো মাহুতের নির্দেশমতো সব করে। প্রতিরোধকারী সংস্থা, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এসব দেখেও না দেখার ভান করেন।
২০১৯ সালে হাতি দিয়ে চাঁদা উঠানোর সময় রাজধানীর কাওরান বাজার থেকে র্যাবের ম্যাজিস্ট্রেট দুটি হাতি আটক করে চিড়িয়াখানায় পাঠান। কারাদণ্ড দেওয়া হয় মাহুতদের। ওই বছরই জুলাইয়ে পাশ হয় প্রাণিকল্যাণ আইন-২০১৯। এই আইন অনুযায়ী কোনো প্রাণীকে ধাতব কিছু দিয়ে আঘাত করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এরপর প্রায় ৩ বছর পার হলেও ব্যক্তিমালিকানাধীন হাতির ওপর নির্যাতন বন্ধ হচ্ছে না। আর হাতি দিয়ে চাঁদাবাজি বন্ধে বন বিভাগকে কোনো ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত