মা-বাবাকে হারিয়েছে গাজার ১৭ হাজার শিশু: অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শৈশব

| আপডেট :  ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৪:২২  | প্রকাশিত :  ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৪:২২


মা-বাবাকে হারিয়েছে গাজার ১৭ হাজার শিশু: অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শৈশব

আন্তর্জাতিক

আন্তর্জাতিক ডেস্ক


চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। শৈশব হারিয়ে ফেলেছে ওরা। জানে না সেইদিনগুলি আবার ফিরে আসবে কিনা। চারদিকে গুলি-গোলার শব্দ আর বারুদের গন্ধেই দিন শুরু আর দিন শেষ হয় ওদের। ওরা ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার শিশুদের অবস্থা বর্ণনা করার মতো নয়। বড়রা পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝলেই ওরা বোঝে না কিছুই। চারিদিকে যন্ত্রণা আর মৃত্যুর চিহ্ন ওদের বয়স বাড়িয়ে দিয়েছে শতগুণ।

ইসরাইলের নির্বিচার হামলায় বিপর্যস্ত ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় গত চার মাসে অন্তত ১৭ হাজার শিশু পরিবার থেকে বিচ্যুত হয়েছে। জাতিসংঘের চিলড্রেন এজেন্সির এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। এছাড়া সংঘাতের কারণে উপত্যকাটির শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব পড়ছে। শুক্রবার (২ জানুয়ারি) জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) এ তথ্য জানিয়েছে।

রাষ্ট্রসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থাটি জানায়, চলমান লড়াইয়ে গাজায় অন্ততপক্ষে ১৭ হাজার শিশু মা-বাবা হারিয়ে একা কিংবা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত পর্যায়ে নেমে এসেছে।

গাজায় ইউনিসেফের যোগাযোগবিষয়ক প্রধান কর্মকর্তা জোনাথন ক্রিকস বলেন, প্রতিটি শিশুর হারানোর এবং দুঃখের একটি হৃদয়বিদারক গল্প আছে। শিশুদের ১৭ হাজারের এই সংখ্যাটি অঞ্চলটিতে সামগ্রিক বাস্তুচ্যুত জনসংখ্যার ১ শতাংশ।

তবে জনাথান জানান, পরিবার থেকে বিচ্যুত হওয়া শিশুর সংখ্যাটি একটি অনুমান। কেননা চলমান পরিস্থিতিতে একেবারে নির্দিষ্ট করে সংখ্যা যাচাই করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে উপত্যকাটির প্রত্যকটি শিশুকেই একটি ভয়ঙ্কর নতুন বাস্তবতার সাথে মানিয়ে নিতে হচ্ছে।

জনাথান বলেন, সঙ্গীহীন শিশুদের সনাক্ত করা ‘অত্যন্ত কঠিন’। কেননা তাদের মাঝে মাঝে আহত বা হতবাক অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিল। এক্ষেত্রে অনেকে নিজের নামও বলতে পারে না।

এক্ষেত্রে জনাথান বলেন, যুদ্ধের সময় মা-বাবা হারানো শিশুদের দায়িত্ব গ্রহণ করে থাকে বর্ধিত পরিবারের সদস্যরা। তবে গাজার বর্তমানে চলছে খাবার, পানি ও বাসস্থানের তীব্র সংকট। এমতাবস্থায় তারা নিজেদের পরিবার ও সন্তানের দায়িত্ব সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে অন্য শিশুর দায়িত্ব নেওয়া যেন আরও চ্যালেঞ্জের ব্যাপার।

মোটাদাগে ইউনিসেফের হিসাব মতে, নিজের পরিবার থেকে আলাদা হলেই ঐ শিশুকে বিচ্যুত বলা যাবে না। বরং যেসব শিশু অন্য আত্মীয়দের জিম্মায় নেই তাদেরকেই বিচ্যুত বলা যাবে।

জেরুজালেম থেকে ভিডিও লিংকের মাধ্যমে সংবাদমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ইসরাইলের চলমান হামলা গাজার শিশুদের মনের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে। এই অঞ্চলের প্রায় এক মিলিয়ন শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা প্রয়োজন।

জনাথান বলেন, গাজার শিশুদের ক্রমাগত উদ্বেগ, ক্ষুধা হ্রাস ও ঘুমাতে না পারার মতো সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তারা যখনই বোমা হামলার শব্দ শুনে তখন তারা মানসিকভাবে আতঙ্কিত হয়।

এমনকি হামলা শুরু হওয়ার আগেই ইউনিসেফ অনুমান করেছিল যে, গাজার ৫ লাখেরও বেশি শিশুর সামাজিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা প্রয়োজন।

জনাথান জানান, এখন পরিস্থিতি এমনটা দাঁড়িয়েছে যে, উপত্যকাটির প্রায় সকল শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা প্রয়োজন। যা সংখ্যায় ১০ লাখেরও অধিক।

ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরায়েলি হামলায় গাজায় ২৭,১০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। যাদের মধ্যে প্রায় ১১,৫০০ জন শিশু।

এক্ষেত্রে কার্যকরী চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা সুবিধার গুরুতর অভাবের মধ্যেই প্রায় ৬৬,২০০ জনেরও বেশি শিশু আহত হয়েছে। আর নিখোঁজ ও ধ্বংসস্তূপের নিচে রয়েছে আরও অনেকে।

এদিকে স্থলভাগে ইসরায়েলি সৈন্যরা উত্তর, মধ্য এবং পূর্ব গাজার বেশিরভাগ অঞ্চল ঘিরে ফেলেছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে উপত্যকাটিতে বসবাসরত পরিবারগুলি বেশ কয়েকবার তাদের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। অনেকেই এখন দক্ষিণে রাফাহ সীমান্তে আটকে আছে। এটিকেও ইসরায়েল তাদের আক্রমণের পরবর্তী লক্ষ্য বলে বিবেচনা করছে।

এক্ষেত্রে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় অনেক ফিলিস্তিনিকে গুলি করে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাস্তুচ্যুতদের মধ্যে যারা দক্ষিণাঞ্চলের দিকে যাচ্ছে তারা প্রায়শই উপত্যকাটির অন্যান্য অংশে তাদের আত্মীয় বা পরিচর্যাকারীদের সাথে কোন যোগাযোগ করতে পারছে না। বিশেষ করে ব্ল্যাকআউটের সময় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।

জনাথান বলেন, চলমান যুদ্ধের সাথে শিশুদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তবুও তারা এমনভাবে ভুক্তভোগী হচ্ছে যা কোনো শিশুর ক্ষেত্রেই হওয়ার কথা নয়। ৭ অক্টোবর কিংবা তারপর থেকে আমরা যে সহিংসতা দেখেছি তা কোনো শিশুর জন্য কখনই কাম্য নয়।

এক্ষেত্রে জনাথান একটি যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান। যাতে করে ইউনিসেফ পরিবার কিংবা আত্মীয়দের থেকে বিচ্ছিন্ন শিশুদের সনাক্ত করতে পারে এবং তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা দিতে পারে।

উপত্যকাটির ১০ লক্ষ শিশুর এখন মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সহায়তা প্রয়োজন। গাজার শিশুদের মধ্যে উচ্চমাত্রায় অবিরাম উদ্বেগের বোধ, খিদে নষ্ট হয়ে যাওয়া, নিদ্রাহীনতা, বোমার শব্দ শুনলেই আতঙ্কে কেঁদে ওঠা, মাঝেমধ্যে প্রচণ্ডভাবে খেপে যাওয়াসহ নানা ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। একলা হয়ে পড়া শিশুদের পরিবারের সদস্যদের সন্ধান করা অত্যন্ত কঠিন। যেমন- প্রায়ই অনেক শিশুকে আহত কিংবা ভয়ার্ত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। অনেকে তখন নিজের নামটুকুও বলতে পারে না। ইউনিসেফের এই কর্মকর্তা বলেন, যুদ্ধের মধ্যে মা-বাবা হারা শিশুদের দেখভাল করে সাধারণত আত্মীয়-স্বজনরা। তবে গাজায় খাদ্য, জল, মাথা গোঁজার ঠাঁই পেতে এই শিশুদের আত্মীয়-স্বজনরাও তীব্র চাপ ও হতাশার শিকার।

বিবার্তা/লিমন

© BBARTA24.NET
Developed by : ORANGEBD
  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত