অডিও রেকর্ড ফাঁস, বেড়িয়ে এলো অবাক করা তথ্য

| আপডেট :  ০৩ জুলাই ২০২২, ১০:০৮  | প্রকাশিত :  ০৩ জুলাই ২০২২, ০৯:৫৩

প্রথম কণ্ঠ: ‘স্যার, আমি তো আপনেরে বলছি- আমি তারে টাকা দিতে বলছি। বলছি, এর নিচে আর হবে না।’

দ্বিতীয় কণ্ঠ: ‘শুধু মুখের কথায় আর চিড়ে ভিজবে না। টাকা দিতেই হবে।’

অডিও রেকর্ডিংটিতে দ্বিতীয় কণ্ঠে আরও শোনা যায়, ‘তুমি তো আমাকে অর্ধেক টাকা পাঠিয়ে দিতে পারতা। তুমি আমার এলাকার মানুষ; তুমি অল্প কিছু কম দিবে। নতুন এমপিও যারা পেয়েছে, তারা ৭ হাজার করে টাকা দিয়েছে। তুমি তো অর্ধেক টাকা পাঠিয়ে দিতে পারতে আগে।’ এভাবে কথোপকথনের একপর্যায়ে দ্বিতীয় কণ্ঠে বলতে শোনা যায়, ‘তুমি এখান থেকে কাগজ না নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে গেলেও কাজ হবে না।’

এই অডিওটা গত জানুয়ারি মাসে রেকর্ড করা এবং হাতে আসে সেই মাসেই। উভয় পক্ষে কথা হচ্ছিল বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার সরকারি অংশ এমপিও (মান্থলি পে-অর্ডার) সংক্রান্ত ঘুষ লেনদেন নিয়ে। অডিওর প্রথম কণ্ঠটা সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা উপজেলার গোলকপুর হাজী আবদুল হাফিজ স্কুল অ্যান্ড কলেজের শরীরচর্চা শিক্ষক রবিউল ইসলামের; আর দ্বিতীয় কণ্ঠটা একই উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবু তাহের মো. কামরুল হাসানের।

অনুমোদিত বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সেখানে কর্মরত শিক্ষক ও কর্মচারীদের জন্য তাঁদের পাওয়া বেতন-ভাতার সঙ্গে জাতীয় বেতন স্কেলের শতভাগ মূল বেতন, ১০০০ টাকা বাড়িভাড়া এবং ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা যোগ করে দেওয়া হয়। বেতন-ভাতার সরকারি এই অংশটুকুই হলো সেই বহু কাঙ্ক্ষিত এমপিও। দেশে এই এমপিওপ্রথার সূত্রপাত হয় ১৯৮০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে। তখন এর নাম ছিল টিবি (টিচার্স বেনিফিট)। শুরুতে টিবিপ্রাপ্তদের দেওয়া হতো সরকারি মূল বেতনের ৫০ শতাংশ। নব্বইয়ের দশকে এসে এর নামকরণ হয় এমপিও (মান্থলি পে-অর্ডার)। পরে সব সরকারের আমলেই কিছু কিছু বাড়িয়ে এমপিও এখন সরকারি মূল বেতনের শতভাগ যোগ করে ১ হাজার ৫০০ টাকা করা হয়েছে।

এ পর্যন্ত দেশে প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সেখানকার প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীকে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও শিক্ষক-কর্মচারীরা অবসরে যান আর সেখানে নতুন নিয়োগ দেওয়া হয়। চাহিদা বিবেচনায় দুই মাস পরপর- প্রতি বিজোড় মাসে সারাদেশে গড়ে প্রায় আড়াই হাজার নতুন শিক্ষক-কর্মচারীকে এমপিওভুক্ত করা হয়।

কিন্তু দেশে প্রায় সর্বব্যাপী দুর্নীতির আবহে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীর জীবনে অনন্য ‘এমপিও-সুখের’ অধ্যায়ে দুঃখের আঁচড় পড়তে দেরি লাগেনি। প্রথম থেকেই তাঁরা পড়ে যান ঘুষের জাঁতাকলে। শুরু থেকে টিবি বা এমপিওর কাজটা করত মাউশি (মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর), যাকে বলা হয় শিক্ষা ভবন। কিন্তু দিন দিন সেখানে ঘুষ-বাণিজ্যের অত্যাচারের মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে সমালোচনা, দাবি ও চাপের মুখে ২০১৫ সালের ৬ এপ্রিল থেকে এমপিওভুক্তির কাজটা বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়। দেশজুড়ে মাউশির ৯টি আঞ্চলিক অফিস থেকে এখন এমপিওভুক্তির আবেদন নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। যুক্তি হিসেবে তখন সরকারপক্ষ থেকেই বলা হয়েছিল, বিকেন্দ্র্রীকরণ হলে ঘুষ-দুর্নীতির অত্যাচার ও মাত্রা কমে যাবে। কিন্তু বিকেন্দ্রীকরণের সাত বছরের মাথায় এসে ঘুষ-যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ শিক্ষক-কর্মচারীদের আজ নাভিশ্বাস অবস্থা।

শিক্ষাবিষয়ক প্রতিবেদক হিসেবে অসংখ্য শিক্ষকের কাছ থেকে তাঁদের এই দুর্দশার কথা শুনে শেষমেশ সমকালের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত হয় দেশজুড়ে অনুসন্ধানের- কারা, কীভাবে এই ঘুষ-অত্যাচার চালাচ্ছে। কিন্তু ঘুষের তো কোনো প্রমাণ থাকে না; কোনো চিহ্নও রাখে না কেউ। ঘুষ আদায়কারী বা ঘুষদাতা স্বীকারও করবে না কখনও। তাহলে প্রমাণ হবে কী করে!

ঘুষ প্রমাণের অভিযানে সমকাল: ‘দেখা যাক’ বলে অনুসন্ধানী অভিযানে নেমে পড়া হয় চলতি বছরের শুরুতেই। প্রথম দফায় দেশের তিনটি জেলার ২৩ উপজেলার প্রায় ৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে অন্তত ৩০০ শিক্ষক-কর্মচারীর মুখোমুখি হয়ে জানতে চাওয়া হয় তাঁদের এমপিও পেতে হয়রানি এবং পরে ঘুষ দিতে বাধ্য হওয়ার কাহিনি। এর পরে নানা সূত্রে অনুসন্ধান চালানো হয় দেশের আরও ১০টি জেলায়।

লক্ষ্য করা যায়, ঘুষ-বাণিজ্যের কথা প্রত্যেকেই অকপটে জানাচ্ছেন; কিন্তু নিজের বেলায় ঘুষ দেওয়ার কথাটা স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার না করে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলছেন। কেউ কেউ আবার ঘুষ দেওয়ার কথা সাহসের সঙ্গে স্বীকার করেও পরে আবার সনির্বন্ধ অনুরোধ রাখছেন, ‘আমার নামটা লিখবেন না, ভাই। বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে আমার।’

অনুসন্ধানকালে পাওয়া একজন কর্মরত প্রধান শিক্ষকের উক্তি উল্লেখ করার মতো। রংপুরের পীরগাছা উপজেলার চণ্ডীপুর মডেল হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. শামসুল আলম তাঁর স্কুলচত্বরে দাঁড়িয়ে গত ১৬ জানুয়ারি বলেন, ‘বিশ্বাস করেন, সবাইকে ঘুষ দিতে হয়। ঘুষ না দিয়ে এমপিওভুক্ত হয়েছেন, এমন একজন শিক্ষকও আপনে খুঁজে পাবেন না। আবার নিজের এই অপ্রিয় সত্য ঘটনাটা আপনার কাছে স্বীকার করবেন, এমন একজনকেও পাবেন না।’

তবে অনুসন্ধানের বিভিন্ন পর্যায়ে ঘুষে অতিষ্ঠ কিছু শিক্ষকের নাগাল পাওয়া গেছে, যাঁরা নাম প্রকাশ করেই বলেছেন নিজেদের ঘুষ-যন্ত্রণার কাহিনি এবং তাঁদের বক্তব্যের সত্যতাও মিলেছে। অনুসন্ধানের শুরুর দিকেই ঘটনাচক্রে পাওয়া ওই অডিও রেকর্ডিংটা মোটামুটি শক্ত একটা প্রমাণ হিসেবে তাই প্রতিবেদনের শুরুতেই তুলে ধরা হলো। সাড়ে তিন মিনিটের এই অডিওর কথোপকথনে সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবু তাহের মো. কামরুল হাসান কোনো রাখঢাক ছাড়াই ঘুষ চান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রথম দফায় গত ১৮ জানুয়ারি এবং দ্বিতীয় দফায় ৮ জুন রবিউল ইসলাম এই কথোপকথনের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ‘আমার ও কয়েকজন সহকর্মীর এমপিও নিয়ে স্যারের সঙ্গে কথা হয়। স্যারের বাড়ি দিনাজপুর; আমার নীলফামারী। একই এলাকার হওয়ায় স্যার ঘুষ চাওয়ার দায়িত্ব আমাকে দিয়েছিলেন।’

তবে একই দিন ফোনে যোগাযোগ করলে শিক্ষা কর্মকর্তা আবু তাহের মো. কামরুল হাসান ওই কণ্ঠ তাঁর নয় বলে দাবি করেন। কিন্তু শিক্ষক রবিউল দৃঢ়তার সঙ্গে তাঁদের এই আলাপচারিতার পুরো প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে বলেন, ‘কয়েকজন শিক্ষক চাহিদামতো টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় স্যার ক্ষেপে গিয়েছিলেন। আমি তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করেছি।’ এক প্রশ্নেম্নর জবাবে রবিউল বলেন, ‘আমি নিজেও স্যারকে অন্যদের চেয়ে কম টাকা দিয়ে পার পেয়েছি। আমি প্রথমে দুই হাজার টাকা দিই। কিন্তু এমপিও না হওয়ায় পরের দফায় আরও এক হাজার টাকা দিয়েছি। অন্যরা মাথাপিছু আট-দশ হাজার করে দিয়েছে।’

অনুসন্ধানে দেখা যায়, এমপিওভুক্তির জন্য আগে শুধু শিক্ষা ভবনে ঘুষ দিতে হতো। আর এখন দফায় দফায় ঘুষ দিতে হচ্ছে কমপক্ষে তিনটি ঘাটে- উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস, জেলা শিক্ষা অফিস ও আঞ্চলিক উপপরিচালকের কার্যালয়ে (ডিডি অফিস নামেই বেশি পরিচিত)। একজন শিক্ষক প্রথমে অনলাইনে আবেদন করেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি কাগজপত্র পরখ করে সব ঠিক থাকলে তা পাঠান জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে। তিনি আবার সেগুলো যাচাই-বাছাই করে পাঠান মাউশির বিভাগীয় আঞ্চলিক উপপরিচালকের (ডিডি) কাছে। ডিডি সেগুলো আবারও যাচাই করে সব ঠিক থাকলে এমপিওভুক্তির জন্য নির্বাচন করেন। প্রতি বিজোড় মাসের ১৫ তারিখের পর মাউশি সব আঞ্চলিক উপপরিচালককে নিয়ে সভা করে এমপিওভুক্তি চূড়ান্ত করে। এভাবে একই শিক্ষকের একই কাগজপত্র এই তিন স্তরে, তিন অফিসে যাচাই-বাছাই করার সময় চলে হয়রানি ও ঘুষ আদায়।

বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. নজরুল ইসলাম রনি বলেন, ‘এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে এখন আগের চেয়ে ঘুষ-বাণিজ্য কয়েক গুণ বেড়েছে। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, আঞ্চলিক কার্যালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে কর্মচারী পর্যন্ত সবাই যেন ফাঁদ পেতে বসে আছে শিক্ষকদের হয়রানিতে ফেলে টাকা আদায়ের।’

ঘুষ শিকারের অস্ত্র ‘হয়রানি’: এমপিও পেতে ২৭ থেকে ৩৭ ধরনের কাগজ জমা দিতে হয় শিক্ষকদের। শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ধরন বুঝে কাগজের সংখ্যা কমবেশি হয়। প্রতিষ্ঠানে শ্রেণি ও শাখা বেশি থাকলে কাগজও বেশি লাগে। এতসব কাগজপত্রের প্যাঁচে ফেলে নিরীহ শিক্ষকদের কাছ থেকে ঘুষ আদায়ে শিক্ষা অফিসগুলোতে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী চক্র। কর্মকর্তারা নিজ হাতে ঘুষ নেন না; আদায় করেন অফিসেরই কোনো কর্মচারীকে অলিখিত ‘ক্যাশিয়ার’ বানিয়ে তাঁর মাধ্যমে। ওই তিন অফিসের প্রতিটিতেই আছে এ রকম ‘ঘুষের দালাল’। অথচ যোগ্যতা থাকার পরও এবং সব বৈধ কাগজপত্র থাকার পরও শুধু ঘুষ না দেওয়ায় এমপিও পেতে দিনের পর দিন ঘুরে ঘুরে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে অনেক সাধারণ শিক্ষককে।

যেমন- অনেক আন্দোলন-সংগ্রামের পর ডিগ্রি স্তরের ৮৪১ জন তৃতীয় শিক্ষক (এক বিষয়ে সিনিয়রিটির তালিকার ৩ নম্বর শিক্ষক) এমপিওভুক্ত হওয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আদেশ পান ২০২১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর। কিন্তু তাঁদের সবার এমপিও এখনও হয়নি। তৃতীয় শিক্ষকদের আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক পাবনার চাটমোহর মহিলা কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক রুমানা পারভীনের নিজের এমপিওভুক্তির আবেদন দুই দফায় নাকচ করেন মাউশির রাজশাহী আঞ্চলিক পরিচালক। অবশেষে গত মে মাসে তিনি এমপিওভুক্ত হন। প্রথম দুই দফায় রুমানা পারভীনের কী সমস্যা ছিল- জানতে চাইলে গত ১ জুন রাজশাহীর আঞ্চলিক পরিচালক অধ্যাপক কামাল হোসেন সমকালকে বলেন, ‘হয়তো প্রথম দুই দফায় তিনি সব কাগজপত্র দেননি। পরে হয়তো দিয়েছেন।’ ঠিক কিনা জিজ্ঞেস করলে রুমানা পারভীন এ বিষয়ে আর মুখ খুলতে চাননি।

একইভাবে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ঢাকা স্টেট কলেজের আইসিটি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আলাউদ্দিন আল আজাদের এমপিওভুক্ত হওয়ার আবেদনও ‘কাগজে ত্রুটি’র কথা বলে এক দফা বাতিল করেন ঢাকার আঞ্চলিক পরিচালক অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন। পরে মে মাসের এমপিওতে এই শিক্ষক তালিকাভুক্ত হন।

গত ২০ ফেব্রুয়ারি বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে একযোগে ৩৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগ পান। এই শিক্ষকদের বেশির ভাগই এমপিওভুক্ত হতে গিয়ে চরম হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হন। প্রথম দফায় এমপিও না হওয়া শিক্ষকের তালিকায় দেখা যায়, অধিকাংশরই কাগজ আটকে গেছে মামুলি কারণে; অনেক ক্ষেত্রে অযৌক্তিক কারণেও।

আবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর কাদেরিয়া আলিয়া কামিল মাদ্রাসার সামিয়া আক্তার নামের এক শিক্ষক হয়েছেন হয়রানির শিকার। যোগাযোগ করা হলে গত ৬ মার্চ তিনি বলেন, ‘যোগ্যতার বলে চাকরি পেয়েছিলাম। টাকা দিয়ে কেন এমপিওভুক্ত হবো? হারাম খেতে চাই না। তাই চাকরি ছেড়ে দিয়েছি।’ হাসিনা বেগম পটুয়াখালীর দুমকী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় সহকারী মৌলভি পদে নিয়োগ পান। পরে এমপিওভুক্তি নিয়ে হয়রানিতে পড়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এনটিআরসিএ থেকে আমার নিয়োগের নির্দেশ আসে। কিন্তু আমি নাকি জনবল কাঠামো নীতিমালা অনুযায়ী নির্বাচিত হইনি। প্রশ্ন হচ্ছে, আমি যদি নীতিমালাতেই না পড়ি, তাহলে কেন চূড়ান্ত নিয়োগের সুপারিশ করা হলো? পুলিশ ভ্যারিফিকেশন কেন করা হলো?’

জাল সনদেই নিয়োগ-এমপিও: অথচ যে সরকারি সংস্থা এনটিআরসিএর (বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ) পরীক্ষায় পাস করে সনদ না পেলে নিয়োগই হওয়ার কথা নয়, সেই সংস্থার জাল সনদ দিয়েও শিক্ষক পদে নিয়োগ শুধু নয়, এমপিওভুক্তি পর্যন্ত হয়ে গেছে- এমন উদাহরণও মিলেছে অনুসন্ধানে। মো. তৌকির আহমদ শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার নন্নী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। গত ৬ ফেব্রুয়ারি তিনি নিয়োগ পান। এরপর এমপিওভুক্ত হতে আবেদন করেন। কিন্তু এর মধ্যেই তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে শুরু হয় কানাঘুষা। অভিযোগ ওঠে, তৌকিরের এনটিআরসিএ সনদটি জাল। অভিযোগটি সমকালের কাছে আসার পর গত এপ্রিল মাস থেকে এই শিক্ষকের চলমান এমপিও প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। গত ৮ মে নালিতাবাড়ী গিয়ে খুঁজে বের করা হয় তৌকিরকে। সঙ্গে ছিলেন তাঁর দু’জন সহকর্মী ও ময়মনসিংহের একজন প্রধান শিক্ষক। নন্নী উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়েই সাংবাদিক পরিচয় লুকিয়ে আলাপচারিতার একপর্যায়ে সঙ্গী প্রধান শিক্ষক প্রশ্ন করেন, ‘তোমার এমপিওর কী খবর?’ তৌকির সবার সামনেই বলেন, ‘জায়গামতো পয়সা ঢালছি; কাজ আমার হবেই।’ কোথায় কত ঢালছ- প্রশ্নে তৌকির অকপটে বলেন, ‘ডিডি অফিসে শ্যামল নামের একজন কর্মচারীর সঙ্গে তিন লাখ টাকায় মৌখিক চুক্তি করে আসছি।’

জাল অভিযোগ ওঠা সত্ত্বেও উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে জেলা শিক্ষা অফিস হয়ে ময়মনসিংহ আঞ্চলিক উপপরিচালকের অফিসে চূড়ান্তভাবে শিক্ষক তৌকির আহমদ গত ২২ মে এমপিওভুক্ত হন।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে শেরপুর জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. রেজওয়ান ৮ জুন বলেন, ‘ওই শিক্ষকের সনদ জাল কিনা, তা যাচাই-বাছাই করে বলতে হবে। এনটিআরসিএ সনদ এখন আমাদের কার্যালয় থেকেই দেওয়া হয়। আগে দেখতে হবে, তিনি আমাদের কার্যালয় থেকে সনদ নিয়েছেন কিনা।’

আর মাউশির ময়মনসিংহের আঞ্চলিক উপপরিচালক আবু নূর মো. আনিসুল ইসলাম বলেন, ‘এনটিআরসিএ নিয়োগ হলে সনদ আমাদের আর যাচাইয়ের প্রয়োজন পড়ে না।’

গত ৩০ মে আবার ফোন দিয়ে এবার সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর নালিতাবাড়ীর নন্নী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. তৌকির আহমদ দাবি করেন, তাঁর সমস্ত কাগজপত্র ঠিক আছে। তিনি কারও সঙ্গে ঘুষের রফা করেননি।

অনুসন্ধানকালে জানা যায়, শেরপুর জেলার নকলা উপজেলার বানেশ্বরদী খন্দকারপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের দুই সহকারী শিক্ষক জহিরুল ইসলাম (হিসাববিজ্ঞান) ও মাহফুজা বেগম (সমাজবিজ্ঞান) ২০২০ সালের নভেম্বরে মাউশির ময়মনসিংহ আঞ্চলিক উপপরিচালকের কার্যালয় থেকে এমপিওভুক্ত হয়েছেন। এ দু’জনের সনদও জাল বলে অভিযোগ আছে। এর মধ্যে জহিরুল ইসলামের এনসিআরসিএ সনদ আর মাহফুজা বেগমের জমা দেওয়া বিদ্যালয়ে শ্রেণি/শাখার অনুমোদন-সংক্রান্ত সনদ জাল।

শিক্ষক তৌকির, জহিরুল ও মাহফুজার বিষয়ে শেরপুরের জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ে যাচাই করতে যাওয়া হয় গত ৩০ মে। অফিস সহকারী আলী আহমেদ কাগজপত্র দেখেই ওই তিন শিক্ষককে চিনতে পারেন। তিনি সমকালকে নিশ্চিত করেন, এই শিক্ষকরা ‘জাল’ কাগজপত্র দিয়েই এমপিওভুক্ত হয়েছেন।

এ নিয়ে প্রশ্ন করলে শিক্ষক জহিরুল ইসলাম ক্ষেপে যান। তিনি বলেন, এসব বিষয়ে আপনার প্রয়োজন কী? যাদের যাচাই করার, তারা করেছে। তিনি প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে আর কিছু বলতে চাননি। আর মাহফুজা বেগম বলেন, তাঁর শ্রেণি/শাখার অনুমোদন জাল কিনা, তা তিনি বলতে পারবেন না। এটা তাঁর প্রতিষ্ঠানের বিষয়; তাঁর ব্যক্তিগত কোনো বিষয় নয়।

তবে শেরপুর জেলা শিক্ষা অফিসের স্টাফদের মধ্যে অফিস সহকারী আলী আহমেদ ও হিসাবরক্ষক কাম ক্লার্ক মো. রেজোয়ান ইবনে আলমসহ আরও কয়েকজন সমকালকে জানান, এখান থেকে তিন কিলোমিটার দূরে থানার মোড় নামক স্থানে কয়েকটি কম্পিউটার, ফটোকপির দোকান আছে। এমপিওভুক্তির সময় এলে ওই দোকানগুলোতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন আদেশের স্মারকে জাল আদেশ বসিয়ে প্রিন্ট করা হয়। আর এমপিওভুক্তির পুরো কাজই অনলাইনে হয়। স্ক্যান করে কাগজপত্রসহ আবেদনপত্র অনলাইনে পাঠাতে হয় বলে জাল স্মারকের শ্রেণি/শাখার অনুমোদন সঠিক কিনা, তা যাচাই করা কঠিন হয়ে পড়ে। রেজোয়ান ইবনে আলম বলেন, আগে সনাতনী পদ্ধতিতে এমপিওভুক্তির সময় তাঁরা নথি দেখার, সনদ ও কাগজপত্র যাচাই করার সুযোগ পেতেন। এখন কেবল জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাই ই-নথি দেখার সুযোগ পান।

চুক্তির জন্য আছে ‘ক্যাশিয়ার’: গত ৮ মার্চ ময়মনসিংহ জেলার ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার ফানুর আশরাফুল উলুম বহুমুখী দাখিল মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে এই মাদ্রাসার একজন সহকারী শিক্ষক সমকালকে বলেন, চাকরি পাওয়ার পর ২০১৯ সালে তিনি এমপিওভুক্তির আবেদন করলে প্রথমে ঘুষ দিতে রাজি হননি। পরে পদে পদে তাঁকে হয়রানি করা হয়। ঢাকার শিক্ষা ভবনে তাঁর কাগজপত্র পাঠানো হয়। সেখানে গিয়ে তিনি এক দফা ঘুষ দিতে বাধ্য হন। তবু তাঁর এমপিও হয়নি। পরে তিনি বুঝতে পারেন, ময়মনসিংহ আঞ্চলিক অফিসেই তাঁকে ঘুষ দিতে হবে। পরের বছর তিনি ওই অফিসের ‘ক্যাশিয়ার’ কম্পিউটার অপারেটর শ্যামলের সঙ্গে চুক্তি করে তাঁকে ৪০ হাজার টাকা দেন। পরে তাঁর এমপিও হয়।

ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর, জামালপুর ও নেত্রকোনা জেলার অন্তত অর্ধশত শিক্ষকের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাঁরা সবাই জানিয়েছেন, ময়মনসিংহ আঞ্চলিক অফিসে এমপিওভুক্ত হতে তাঁরা কর্মচারী শ্যামল ও প্রোগ্রামার আখতারুজ্জামানকে ঘুষ দিয়েছেন। কিন্তু কেউ নিজের নাম পত্রিকায় প্রকাশে নারাজ।

‘টাকার চুক্তিতেই সব এমপিও দেওয়া হচ্ছে’- এ অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য চাইলে মাউশির ময়মনসিংহ আঞ্চলিক উপপরিচালক আবু নূর মো. আনিসুল ইসলাম গত ৮ জুন সমকালকে বলেন, ‘কেউ কারও সঙ্গে চুক্তি করেছে কিনা, আমি জানি না। শ্যামলের সঙ্গে তারা চুক্তি করে কেন? শ্যামল তো এমপিওভুক্তির কাজ করে না। করি আমি, বিদ্যালয় পরিদর্শক ও প্রোগ্রামার। অনলাইনের আইডি, পাসওয়ার্ড আমাদের কাছে। শ্যামল কীভাবে কাউকে এমপিওভুক্তি দেবে?’

কিন্তু উপপরিচালক এমন দাবি করলেও সমকালের অনুসন্ধানে জানা যায়, তাঁর অফিসের সামান্য কম্পিউটার অপারেটরের চাকরি করেও ‘ক্যাশিয়ারগিরির’ মাধ্যমে এই শ্যামল রীতিমতো আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে উপপরিচালক আবু নূর মো. আনিসুল ইসলাম বলেন, যতদূর জানি শ্যামলের বাবা বিশাল ঠিকাদার। কোটি কোটি টাকার কাজ করেন। শ্যামল তাঁর একমাত্র পুত্র। তাই সে পারিবারিকভাবেই ধনী। ‘কোটিপতির পুত্র কেন কেরানির চাকরি করতে এসেছেন’- প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, সেটা তো বলতে পারব না।

গত মার্চে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে রইছ উদ্দিন শ্যামল বলেন, ‘ঈর্ষাবশত কেউ তাঁর বিরুদ্ধে ঘুষের অভিযোগ তুলতে পারে। এসব আদৌ সত্য নয়।’ তিনি এর বেশি কিছু বলতে চান না। কিন্তু গত ৮ ও ৯ মার্চ দু’দফায় অফিসে গিয়েও অফিসে না থাকায় কম্পিউটার অপারেটর আখতারুজ্জামানের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। পরে আরেকবার ওই অফিসের ওয়েবসাইট থেকে নম্বর সংগ্রহ করে ফোন দিলে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।

রংপুর অঞ্চলের উপপরিচালক মো. আখতারুজ্জামানের গাড়িচালক শাহীনের বিরুদ্ধেও ঘুষের অভিযোগ করেছেন পীরগাছা ও পীরগঞ্জ অঞ্চলের দু’জন শিক্ষক। এমপিওভুক্তির জন্য এ দুই শিক্ষকের কাছে গত অক্টোবরে ১ লাখ টাকা ঘুষ নেন শাহীন।

কিন্তু গত ১৬ জানুয়ারি নিজ কার্যালয়ে বসে উপপরিচালক আখতারুজ্জামান বলেন, শাহীন নামে তাঁর কোনো গাড়িচালক নেই। তাঁর গাড়ি চালায় সফিকুল আলম।

এ নিয়ে অভিযোগকারী দুই শিক্ষকের কাছে আবার জানতে চাওয়া হলে দু’জনই নিশ্চিত করেন, তাঁরা ওই অফিসে গিয়ে গাড়িচালক শাহীনকেই টাকা দিয়েছেন। শাহীনকে উপপরিচালকের গাড়িও চালাতে দেখেছেন তাঁরা। পরে অফিসে খোঁজ-খবর করলে একাধিক সূত্র জানায়, গাড়িচালক সফিকুল আলমের ডাকনাম শাহীন।

খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ে ঘুষের ‘ক্যাশিয়ার’ হিসেবে কাজ করেন উচ্চমান সহকারী মনির হোসেন। তাঁর সহযোগী একই অফিসের প্রোগ্রামার সাইফুল ইসলাম ও হিসাবরক্ষক মো. আনোয়ারুল ইসলাম। এখানকার উপপরিচালক এ এস এম আবদুল খালেক বলেন, মনিরের দায়-দায়িত্ব তিনি নেবেন না।

কুষ্টিয়া সদরের পিয়ারপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের একজন নারী শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে গত এপ্রিলে মোবাইল ফোনে বলেন, তিনি আট মাস আগে ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়েছেন। কাকে দিয়েছেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, খুলনা আঞ্চলিক অফিসের মনির হোসেনকে।

কুষ্টিয়ার একটি স্থানীয় দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিক ও স্থানীয় একটি বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক গত মে মাসে জানান, তিনিও মনিরকে ৪০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়েছেন।

গত মার্চে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার পিয়ারপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওর জন্য আবেদন করেন। তাঁদের অভিযোগ, উপজেলা শিক্ষা অফিসে তাঁদের কাছে জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা করে দাবি করা হয়। টাকা না পেয়ে প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন শিক্ষা কর্মকর্তা ফজলুল হক। পরে জেলা অফিস থেকে খুলনায় উপপরিচালকের কার্যালয়ে ফাইল যাওয়ার পর সেখানে কর্মচারী মনির হোসেন প্রধান শিক্ষককে ফোন করে শিক্ষকপ্রতি ১৫ হাজার টাকা নিয়ে দেখা করতে বলেন। পরে ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার চাপের কারণে অর্থ নিতে ব্যর্থ হন মনির। পরে অবশ্য তাঁদের এমপিও হয়েছে।

এভাবে খুলনা বিভাগের ১০ জেলার অন্তত দুই ডজন শিক্ষক নাম না ছাপার অনুরোধ রেখে জানান, তাঁরা এমপিওর জন্য ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছেন ‘ক্যাশিয়ার’ মনিরের কাছে। তাঁর সহযোগী হিসেবে রয়েছেন একই অফিসের প্রোগ্রামার সাইফুল ইসলাম ও হিসাবরক্ষক মো. আনোয়ারুল ইসলাম।

মন্ত্রী-ডিজিরও অসহায় স্বীকারোক্তি: এই সর্বগ্রাসী ঘুষ-সংস্কৃতির বিষয়ে মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদের কাছে জানতে চাইলে গত ৮ জুন মোবাইল ফোনে তিনি বলেন, যেসব কথা বলা হচ্ছে, এই বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই। সত্যিকারের কিছু দুষ্টচক্র শিক্ষকদের রক্ত চুষে খাচ্ছে। শিক্ষা কর্মকর্তা, আমাদের নিম্নশ্রেণির কর্মচারীরাও এ থেকে পিছিয়ে নেই। আবার যারা ঘুষ দেয়, তারা কোনো প্রমাণ রাখে না। প্রমাণ ছাড়া তো প্রশাসনিক অ্যাকশন নেওয়া যায় না।

শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি গত ৫ জুন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিকেন্দ্রীকরণের কারণে এমপিও নিয়ে শিক্ষকদের হয়রানি বেড়েছে স্বীকার করে বলেন, ‘আমরা সব সময় মনে করেছি, বিকেন্দ্রীকরণ করাটাই মনে হয় ভালো। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিকেন্দ্রীকরণ ভালো, কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণে হয়রানি বেড়ে যেতে পারে। আমাদের কাছে মনে হচ্ছে, এমপিওভুক্তি বিকেন্দ্রীকরণে এ ঘটনাই ঘটেছে।’

সূত্র: সমকাল

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত