কিছুতেই বদলি আদেশ মানছেন না কর্মকর্তারা

| আপডেট :  ০৪ জুলাই ২০২২, ০৮:৫৮  | প্রকাশিত :  ০৪ জুলাই ২০২২, ০৮:৫৮

জনস্বার্থে বদলি করা হলেও প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তাই তা অমান্য করছেন। কিছুতেই তাঁরা বদলি আদেশ মানছেন না। এ কারণে এক মাসে আট কর্মকর্তাকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়েছে। তার পরও তাঁরা আইনবহির্ভূতভাবে আগের কর্মস্থলেই রয়েছেন। এ ছাড়া গত তিন মাসে আরও শতাধিক কর্মকর্তা বদলি আদেশের পরও কর্মস্থলে যোগ দেননি। এই কর্মকর্তাদের কয়েকজন তদবির করে বদলি আদেশই বাতিল করিয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শূন্য পদে বদলি করা হলেও বেশিরভাগ কর্মকর্তাই পছন্দের কর্মস্থলে থাকতে আগ্রহ দেখান। ফলে বদলি করা পদগুলো দীর্ঘদিন শূন্য থাকায় সরকারি সেবা ও কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। অথচ সার্ভিস রুলের ৮১ ধারা অনুযায়ী, বদলি আদেশের পর নতুন কর্মস্থলে যোগদানের প্রস্তুতির জন্য একজন কর্মকর্তা সর্বোচ্চ ছয় দিন সময় পান। একই শহরে বদলি হলে প্রস্তুতির সময় পান না।

বদলির আদেশ না মানায় গত মে মাসে দু’জন করে অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও চারজন উপসচিবকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়। এর মধ্যে দু’জন করে অতিরিক্ত সচিব ও উপসচিব বদলির তিন মাস পর নতুন কর্মস্থলে যোগ দেন। স্ট্যান্ড রিলিজ করা হলেও নোয়াখালীর স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক আবু ইউসুফ নতুন কর্মস্থলে যোগ দেননি। উল্টো তদবির করে তিনি স্ট্যান্ড রিলিজের আদেশ বাতিল করিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

এদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব এ বি এম সফিকুল হায়দারকে গত ২৪ মার্চ বদলি করা হয় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জয়িতা ফাউন্ডেশনের সক্ষমতা বিনির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক পদে। তিনি এখন পর্যন্ত যোগ দেননি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে চাননি এ বি এম সফিকুল হায়দার। এই কর্মকর্তাকে স্ট্যান্ড রিলিজ করার তথ্যও জানা নেই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমানের। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি সচিবের কাছ থেকে জানতে হবে। কারণ অফিসারদের ব্যবস্থাপনা সচিব করেন।’

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সংযুক্ত যুগ্ম সচিব হুমায়ুন কবিরকে ২৩ মার্চ বদলি করা হয় মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তৃণমূল পর্যায়ে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে নারী উদ্যোক্তাদের বিকাশ সাধন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক পদে। তিনিও বদলি করা কর্মস্থলে যোগ দেননি। তিনি রাখঢাক না করেই বলেন, ‘যোগদান করিনি, এটাই সত্য। এর বেশি কিছু বলতে পারছি না।’ নোয়াখালীর স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক আবু ইউসুফকে ২৮ এপ্রিল বদলি করা হয় কক্সবাজারে ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ে। তিনিও ওই পদে যোগ দেননি। বিদ্যুৎ বিভাগে সংযুক্ত উপসচিব আইরিন পারভীনকে শিল্প মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি যোগ না দেওয়ায় ৩০ মে তাঁকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে বদলি করা হয়। তবুও নতুন কর্মস্থলে যোগ দেননি এই কর্মকর্তা।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজম বলেন, স্ট্যান্ড রিলিজের পর কর্মস্থলে যোগ না দিলে চাকরি অনিয়মিত হয়ে যাবে। সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া জানান, বদলি করা কর্মস্থলে যোগ না দিলে তা অসদাচরণ বলে গণ্য হবে। এ জন্য সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলারও সুযোগ রয়েছে। আর স্ট্যান্ড রিলিজের অর্থই হলো অব্যাহতি দেওয়া। স্ট্যান্ড রিলিজের পর পুরোনো কর্মস্থলে কাজ করা আইনবহির্ভূত। বেতন-ভাতাও বিধিসম্মত হবে না।

গত মে মাসে আটজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) বদলি করা হলেও পাঁচজন বদলি হওয়া কর্মস্থলে যোগ দেননি। তাঁরা হচ্ছেন- শেরপুরের নকলার মোস্তাফিজুর রহমান, মানিকগঞ্জ সদরের ইকবাল হোসেন, গাইবান্ধার সাঘাটার সরদার মোস্তফা শাহিন, পিরোজপুর সদরের বশির আহমেদ ও ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গীর যোবায়ের হোসেন। এর মধ্যে ইকবাল হোসেনকে ১৩ এপ্রিল মাদারীপুরের এডিসি এবং পরে এই আদেশ বাতিল করে ৮ মে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে বদলি করা হলেও তিনি যোগ দেননি। বশির আহমেদকে প্রথমে র‌্যাবের আইন কর্মকর্তা পদে এবং পরে ঝালকাঠি জেলা পরিষদের সচিব পদে বদলির পরও তিনি যোগ দেননি।

নতুন কর্মস্থলে যোগ না দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সদুত্তর দেননি সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা। নকলার ইউএনও মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আপনি আমাকে অযৌক্তিক প্রশ্ন করবেন কেন? আপনি কি আমার কর্তৃপক্ষ? আর যোগদান না করার কারণ আপনাকে কেন বলব?’ পিরোজপুর সদরের ইউএনও বশির আহমেদ জানান, এটা তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়। বালিয়াডাঙ্গীর ইউএনও যোবায়ের হোসেন বলেন, ঠাকুরগাঁওয়ের ডিসি রিলিজ না করায় তিনি বদলীকৃত কর্মস্থলে যোগ দিতে পারেননি। তবে নতুন কর্মকর্তা পদায়ন না করায় ওই কর্মকর্তাকে রিলিজ করা হয়নি বলে জানান ডিসি মাহবুবুর রহমান। মানিকগঞ্জ সদরের ইউএনও ইকবাল হোসেন বলেন, ডিসির রিলিজ না দেওয়ায় তিনি নতুন কর্মস্থলে যোগ দিতে পারছেন না। এ প্রসঙ্গে সরাসরি মন্তব্য করেননি মানিকগঞ্জের ডিসি আব্দুল লতিফ। তিনি বলেন, এটা প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ বিষয়।

এদিকে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগে সংযুক্ত উপসচিব আসমা নাসরীনকে ৭ মার্চ কৃষি মন্ত্রণালয়ে এবং একই বিভাগের উপসচিব ইব্রাহিম ভূঞাকে ১৪ মার্চ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হলেও তাঁরা যোগ দেননি। দীর্ঘ আড়াই মাস পর তাঁদের বদলি আদেশই বাতিল করা হয়েছে। নরসিংদীর স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক ভূঞা মোহাম্মদ রেজাউর রহমান ছিদ্দিককে ২৬ এপ্রিল ধর্ম মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হলেও তিনি যোগ দেননি। ২৬ মে তাঁর বদলি আদেশই বাতিল করা হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ছাদেক আহমদকে ৮ মার্চ কৃষি মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হলেও তিনি যোগ দেননি। তাঁর বদলি আদেশও বাতিল করা হয়েছে ৯ মে।

এদিকে বদলি এবং স্ট্যান্ড রিলিজের পরও নতুন কর্মস্থলে যোগদান না করার ঘটনাকে রীতিমতো জুনিয়র কর্মকর্তাদের আস্পর্ধা হিসেবেই দেখছেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব জাকিয়া সুলতানা। তিনি বলেন, জুনিয়র কর্মকর্তারা যেভাবে আদেশ লঙ্ঘন করছেন, সেটা তাদের চাকরিজীবনে কল্পনাও করেননি। তাঁর আক্ষেপ, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিলের সচিব থাকা অবস্থায় তিনজন পিএসকে বদলি করার পরও কেউ যোগদান করেনি। সাবেক সচিব এ কে এম আবদুল আউয়াল মজুমদারের দৃষ্টিতে, প্রশাসনের দুর্বলতার কারণেই বদলি এবং স্ট্যান্ড রিলিজের পরও নতুন কর্মস্থলে যোগ না দেওয়ার মতো অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটছে। আর সমন্বয় এবং কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল না থাকায় এমনটা হচ্ছে।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত