কোটা আন্দোলন: নজিরবিহীন তাণ্ডব, হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি

| আপডেট :  ২৫ জুলাই ২০২৪, ০২:১২  | প্রকাশিত :  ২৫ জুলাই ২০২৪, ০২:১২


কোটা আন্দোলন: নজিরবিহীন তাণ্ডব, হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি

জাতীয়

বিবার্তা প্রতিবেদক


সরকারি চাকরির সকল গ্রেডে নিয়োগে কোটা সংস্কারের দাবিতে লাগাতার কর্মসূচির অংশ হিসেবে জুলাই মাসের শুরুতে আন্দোলন শুরু করে কোটাবিরোধীরা। ১০ জুলাই সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিয়োগে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) কোটার বিষয়ে পক্ষগুলোকে চার সপ্তাহের জন্য স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ। কিন্তু দাবি না মানা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন কোটাবিরোধীরা।

এরপর গত ১৬ জুলাই কোটাবিরোধীদের চলমান আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নেয়। ওইদিনই সারা দেশে দিনভর চলে ব্যাপক বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ। কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা শুরু হয়। স্থাপনা ভাঙচুরের পাশাপাশি দেওয়া হয় আগুন। পরে ২০ জুলাই দেশজুড়ে কারফিউ জারি করে সেনা মোতায়েন করা হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। ঘোষণা করা হয় সাধারণ ছুটি।

কিন্তু এরই মধ্যে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, উত্তরা, বাড্ডা, মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে আন্দোলনকারীদের সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সহিংসতার সময় একের পর এক ভবনকে লক্ষ্য করে তাণ্ডব চালাতে দেখা যায়। এতে আগুনে পুড়েছে বিপুল সংখ্যক গাড়িসহ সরকারি নানা স্থাপনা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনের এই সুযোগ নিয়েছিল রাজনৈতিক অপশক্তি বিএনপি ও জামায়াত। তারা ১৬ থেকে ২০ জুলাই রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে যে তাণ্ডব চালিয়েছে তা এককথায় নজিরবিহীন।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) এর সাবেক সভাপতি ও আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান বিবার্তাকে বলেন, বাংলাদেশ যাতে সামনের দিকে এগিয়ে না যেতে পারে সেই চেষ্টাটাই হয়েছে। সরকারি স্থাপনায় হামলা চালানো হয়েছে। মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো মেগাপ্রকল্পে হামলা হয়েছে, স্থাপনা পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াও করে দেশের অর্থনীতিকে পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অতীতে বাংলাদেশকে দাবায়ে রাখা যায়নি ভবিষ্যতেও যাবে না। এই আন্দোলনে দেশের অর্থনীতির সাময়িক ক্ষতি হয়েছে কিন্তু সবাই মিলেমিশে কাজ করলে দেশ এগিয়ে যাবে।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি’র (বিজিএমইএ) সভাপতি ও ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম মান্নান কচি বিবার্তাকে বলেন, কোটা আন্দোলনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে একটি অশুভ চক্র এই ধ্বংসলীলায় মেতেছিল। নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে গার্মেন্টস বন্ধ রাখতে হয়েছে। আমাদের হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশকে ভালোবাসেন, দেশের মানুষকে ভালোবাসেন। তাই এই দেশে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো মেগাপ্রজেক্ট বাস্তবায়িত হয়েছে। এখন এগুলো ধ্বংস করা তাদের টার্গেট।

কোটাবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ শুরু হলে ১৭ জুলাই রাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেট এবং ১৮ জুলাই রাত সাড়ে ৯টার দিকে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় একদল তরুণ মোবাইল অপারেটর গ্রামীণফোনের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেছিলেন। আরেক অপারেটর রবির একটি গ্রাহক সেবা কেন্দ্র বা কাস্টমার কেয়ার সেন্টার ভাঙচুর করা হয়।

ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক জানান, সারা দেশে চারটি ডেটা সেন্টার এবং ৪০টির মতো সার্ভার ক্ষতিগ্রস্ত করেছে সন্ত্রাসী ও নাশকতাকারীরা। এতে কয়েক’শ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এদিকে, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) জানিয়েছে, ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকার কারণে পাঁচ দিনে সফটওয়্যার খাতের ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫০০ কোটি টাকার ওপরে।

সোমবার রাজধানীর বিদ্যুৎ ভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে দেশে বিভিন্ন সরকারি স্থাপনার পাশাপাশি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এসব ঘটনায় বিদ্যুৎ খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অন্তত হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

টানা পাঁচদিন ধরে আন্দোলনকারীদের চলা কর্মসূচিতে নাশকতা থেকে রেহাই পায়নি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভি’র প্রধান কার্যালয়ে আগুন, মেট্রোরেলের কাজীপাড়া ও মিরপুর-১০ নম্বর স্টেশন, সেতু ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবন, বিআরটিএ ভবনের মত সরকারি স্থাপনায় একের পর এক হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।

এছাড়া যাত্রাবাড়ীতে মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজা, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বনানী ও মহাখালী টোলপ্লাজা, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়সহ বিভিন্ন স্থাপনা, মিরপুর ফায়ার সার্ভিস স্টেশন ও মিরপুরের ইনডোর স্টেডিয়ামেও হামলা করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুরের পাশাপাশি একাধিক থানা ও পুলিশ ফাঁড়িতে আগুন দেয়া হয়।

ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্রে জানা যায়, কয়েকদিনের সহিংসতায় ডিএমপির ট্র্যাফিক বিভাগের বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন দিয়ে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকার ক্ষতি করা হয়েছে। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে গুলশানে ট্র্যাফিক উপকমিশনারের অফিস। এছাড়া এসি রমনা, রামপুরা, মহাখালী ও উত্তরা অফিস পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পুরো ঢাকা শহরে মোট ৫৪টি ট্র্যাফিক পুলিশ বক্স পুড়িয়ে দেয়া হয়।

গত ১৮ জুলাই, বৃহস্পতিবার ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বনানী ও ২০ জুলাই, শনিবার মহাখালী টোলপ্লাজা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। এ দুটি টোলপ্লাজা আপাতত বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প পরিচালক এএইচএস আকতার।

ওইদিন বিকালে ঢাকার মহাখালীতে সেতু ভবনের সামনে থাকা যানবাহন, ভবনের নিচতলায় আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এসময় সেতু বিভাগের ৫৫টি গাড়ি সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। সেতু ভবনের নিচতলায় থাকা বঙ্গবন্ধু কর্নার, অভ্যর্থনা কেন্দ্রে, মিলনায়তন, ডে-কেয়ার সেন্টার একেবারে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। উপরের ফ্লোরগুলো পুড়েছে কম, তবে সেখানেও ক্ষতি হয়েছে। লুট করা হয়েছে ভবনের মূল্যবান জিনিসপত্র।

সেতু ভবনে আগুন সন্ত্রাসের ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণসহ সার্বিক বিষয় তদন্তে অতিরিক্ত সচিব রাশিদুল হাসানকে প্রধান করে ৭ সদস্যের কমিটি করেছে সেতু বিভাগ।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কয়েকটি আঞ্চলিক কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ৩০ গাড়িতে আগুন দেয়া হয়, ভাঙচুর করা হয় ১৭টি গাড়ি। মশার ওষুধ ছিটানোর স্প্রে মেশিন ও ওষুধ নষ্ট করা হয়েছে। তুলে নেয়া হয় সড়কবাতি। হামলায় ডিএনসিসির প্রায় ২০৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজে নিয়োজিত এতগুলো গাড়ি নষ্ট করে ফেলায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম ব্যাহত হবে।

হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিআরটিএর প্রধান কার্যালয়। শুক্রবার হামলা করা হয় বিআরটিএর মিরপুর কার্যালয়ে। এ সময় বিআরটিএ ভবনের বিভিন্ন তলায় ভাঙচুর চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় হামলাকারীরা। লুট করা হয় মূল্যবান জিনিসপত্র। ভাঙচুর, আগুনে বিআরটি এর ডেটা সেন্টার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে বিআরটিএর সব ধরনের সেবা বন্ধ হয়ে গেছে।

বৃহস্পতিবার বিকেলে মহাখালীর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনের সামনে এবং বেইজমেন্টে থাকা যানবাহনে আগুন দেয় আন্দোলনকারীরা। হামলায় ৫৩টি গাড়ি ও ১৬টি মোটরসাইকেল সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া আগুনে ভবনের বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন, সার্ভার, ইমার্জেন্সি রেসপন্স কোঅর্ডিনেশন সেন্টার, অফিসের যন্ত্রপাতিও নষ্ট হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রেজওয়ানুর রহমান জানান, প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি আমাদের অন্তত ৫০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ভবনটি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।

আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতার মধ্যে গত শুক্রবার বেলা সাড়ে ৩টার পর মেট্রোরেলের মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনে হামলা হয়। এতে টিকেট বিক্রির মেশিন, কম্পিউটার, প্রিন্টার, সময়সূচির মনিটর ভেঙে ফেলা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অ্যাকসেস কন্ট্রোল গেট। ওই ঘটনায় শনিবার আট সদস্যের কমিটি করে দিয়েছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড।

২০ জুলাই, শনিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন সিদ্দিক। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, দুটি স্টেশন পুনরায় সচল করতে আরো অন্তত এক বছর সময় লাগবে। যেসব যন্ত্রপাতি ভাঙচুর করা হয়েছে সেগুলো বাংলাদেশে নেই। ওইগুলো জাপান ও ইউরোপ থেকে আনতে হবে। এজন্য দরপত্র আহ্বান করত হবে। কেনার প্রক্রিয়া শেষ হলে এগুলো স্টেশনে সংযোজন করতে হবে।

২২ জুলাই, সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জনগণের জানমাল রক্ষায় কারফিউ দিতে বাধ্য হয়েছি। বিএনপির প্রত্যক্ষ মদদে এবং জামায়াত-শিবিরের পরিকল্পনায় এসব ধ্বংসযজ্ঞ হয়েছে। এই সহিংসতাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে এটাকে দমন ও প্রতিহত করব।

তিনি বলেন, যতগুলো আইকনিক স্থাপনা তৈরি করে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছিলাম, হামলা চালিয়ে তা সুপরিকল্পিতভাবে নষ্ট করা হয়েছে। অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমরা যত উন্নয়ন করেছিলাম, তা তারা ধ্বংস করতে চেয়েছে। কারা এসব ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, তা সবার কাছে পরিষ্কার। শিবির-জামায়াত তো জঙ্গি সংগঠন। আর বিএনপির চেহারা এবার স্পষ্ট হয়েছে। এবার সহজে ছাড় দেয়া হবে না। নাশকতাকারীদের দমন করে দেশের পরিবেশ স্বাভাবিক করব।

সরকার প্রধান বলেন, বিটিভিতে আগুন দেওয়া হয়েছে, সেতু ভবনে আগুন দেয়া হয়েছে, মহাখালী ডেটাবেজ স্টোরেজে হামলা-আগুন, মেট্রোরেলের স্টেশনে হামলা, শনির আখড়ায় হানিফ ফ্লাইওভারের টোল বক্সে হামলা, পিবিআই অফিসে আগুন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরে আগুন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজায় আগুন। নরসিংদীতে কারাগারে হামলা করে ৮২৬ কয়েদিকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

বিবার্তা/সোহেল/রোমেল/জবা

© BBARTA24.NET
Developed by : ORANGEBD
  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত