গুলশানের ১৪০ কোটি টাকার প্লট জোচ্চুরি করতে যা করলেন তিনি

| আপডেট :  ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৯:০৮  | প্রকাশিত :  ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৯:০৮

গুনতে হবে প্রায় ১৪০ কোটি টাকা! সেই অঙ্কটা খুব মনোযোগে কষেই জোচ্চুরির পথে বেশ খানিকটা পথ হেঁটেছেনও পারভেজ আহমেদ জাহান। তার বয়স কমবেশি ৬৬! মা কাশ্মিরি বেগম আর বাবা মৃত শাহ জাহানের ‘গুণধর’ সন্তান।

তবে মা-বাবা, দাদা ও নিজের নাম-পরিচয় খোলনলচে বদলে জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট এবং জন্মনিবন্ধন সনদ নতুন অবয়ব দিয়েছেন পারভেজ। সেখানে খান বাহাদুর পরিবারের নাতি সেজে নিজের নাম বানিয়েছেন ‘ইফতেখার আহমেদ খান’। কাগজপত্রে মায়ের নাম বদলিয়ে করেছেন মৃত তাহমিনা বেগম, আর মৃত ডা. মমতাজুল হক খানকে বলছেন বাবা।

এই চতুর ছদ্মবেশী ইফতেখারকে গতকাল সোমবার গ্রেপ্তার করেছে তেজগাঁও থানা পুলিশ। তার নামে পুলিশ ঠুকেছে মামলাও। ওই মামলায় তার সাত দিনের রিমান্ড চাওয়া হলে আদালত এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

স্বাধীনতার আগে গুলশানের ৪৪ শতক ওই জমির বরাদ্দ পেয়েছিলেন বিলকিছ বেগম। তার স্বামীর নাম খান বাহাদুর নুরুল হক। বিলকিছের মেয়ের নাম তাহমিনা বেগম। আর তাহমিনার স্বামী ছিলেন ড. মমতাজুল হক। নকল ইফতেখারের ভাষ্য, তারা দুই ভাই। আরেক ভাই ইনতেখাব আহমেদ খান যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী।

তাদের মা তাহমিনা বেগম তার সন্তান ইনতেখাব আহমেদকে এই জমি ‘উইল’ করে গেছেন। এরপর ভাইয়ের কাছ থেকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়ে রাজউক, ভূমি অফিস, সরকারি সব দপ্তরে খান বাহাদুর পরিবারের নাতি পরিচয়ে কাগজপত্র জমা দেন। এরপর রাজউক তার নামে প্লটটি বরাদ্দও দেয়। ইফতেখারের করা অন্য এক মামলার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ বের করে আনে থলের বিড়াল! গুলশানের ওই দামি প্লটটি হাতিয়ে নিতে বেছে নেওয়া হয় জালিয়াতির পথ।

এ ব্যাপারে জানতে প্রকৃত পারভেজের ছেলে আরিফ পারভেজের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘বাবার সঙ্গে ২১ বছর ধরে আমার যোগাযোগ নেই। মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। একসময় আমার পরিবার পুরান ঢাকায় থাকত। তার বাবার নাম পারভেজ আহমেদ জাহান। তার প্রতারণার দায় আমরা নেব কেন?’

কেন, কীভাবে তার বাবা নিজের পদবির সঙ্গে ‘খান বাহাদুর’ যুক্ত করে নাম-পরিচয় পাল্টে ফেলেছেন- এ নিয়ে তিনি মন্তব্য করতে চাননি।

গতকাল তেজগাঁও থানায় গিয়ে দেখা যায়, ধবধবে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা পারভেজকে পুলিশের গাড়িতে তুলে চলছে আদালতে নেওয়ার প্রস্তুতি। তার কথাবার্তা, বেশভূষায় কৃত্রিম আভিজাত্যের ছাপ। খান বংশের লোক- এটা বোঝাতে হাতে ছিল একখানা খানদানি লাঠি। জালিয়াতির কথা জানতে চাইলে বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, ‘কতজন কত কিছুই তো করে। এসবের পেছনে কেন লাগছেন।’

তদন্ত-সংশ্নিষ্ট পুলিশের একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, গুলশান ২ নম্বরে ৫১ নম্বর রোডের এনডব্লিউ (জে) ৫ নম্বর প্লটটির মূল মালিক তাহমিনার প্রকৃত কোনো উত্তরাধিকারীর খোঁজ কারও কাছে নেই। এই সুযোগে বেশ কয়েক বছর প্লটটি দখলে রাখেন সাব্বির আহমেদ। তিনি এখানে ‘সেফরন’ নামে একটি হোটেল চালাতেন। বর্তমানে এটির দখলে রয়েছে ‘বে ডেভেলপার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের মালিকও নোয়াখালীর আরেক ‘ইফতেখার আহমেদ খান’। আর সেফরনের সাব্বির বর্তমানে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে করছেন হোটেল ব্যবসা। পুলিশ বলছে, এ প্লটটির ওপর রাঘববোয়ালদের চোখ পড়েছে। নানা মাত্রিক জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে এটি কবজায় নেওয়ার চেষ্টা করছে প্রভাবশালী একটি চক্র।

পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, গত ৩০ আগস্ট ইফতেখার আহমেদ খান বাদী হয়ে তেজগাঁও থানায় মামলা করেছিলেন। তার অভিযোগ ছিল, জনৈক আবু হানিফসহ চার সদস্যের একটি চক্র তার গুলশানের প্লটের মূল দলিলপত্র ফটোকপির নামে নিয়ে আর ফেরত দিচ্ছে না। জমির বায়নাসূত্র ধরে তাদের সঙ্গে ইফতেখারের পরিচয়। ওই মামলার তদন্ত শুরু করে পুলিশ। উদ্ধারের পর কাগজপত্র দেখে তদন্তে সন্দেহ হয় তেজগাঁও থানার ওসির।

১৯৬৪ সালে বিলকিছের নামে বরাদ্দ হওয়ার পর কীভাবে পরবর্তী সময়ে ইফতেখার তার মালিক হলেন, ধারাবাহিক সব নথি সেখানে ছিল। পুলিশ ওই জমির দলিলপত্র উদ্ধারের পর তা ফেরত পেতে আদালতের শরণাপন্ন হন ইফতেখার। এরপর পুলিশের পক্ষ থেকে আদালতকে বলা হয়, মামলার তদন্ত শেষ করতে আরও সময়ের প্রয়োজন। আর জমির কাগজপত্রও খতিয়ে দেখা দরকার। এর পরই বেরিয়ে আসে ১৮১, পূর্ব তেজতুরী বাজারের ঠিকানায় জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর থেকে চারিত্রিক সনদ নেন ইফতেখার আহমেদ খান। ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর ভুয়া নাম-ঠিকানায় এনআইডি তৈরি করেছিলেন।

তদন্ত কর্মকর্তারা এরই মধ্যে ইফতেখারের হেফাজত থেকে বেশ কিছু জালিয়াতির নথিপত্র জব্দ করেছেন। এসব নথি জমির ক্রেতাদের দেখিয়ে তিনি যে খান পরিবারের নাতি, এটা তাদের বিশ্বাস করাতেন।

ইফতেখারের কাছ থেকে পাওয়া নথির মধ্যে আছে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে তার কথিত নানা খান বাহাদুর নুরুল হকের একটি সাদাকালো ছবি। ছবিটির নিচে লেখা- ‘১ জুলাই ১৯১৩ সালে লন্ডনের নানাজীর সঙ্গে গান্ধীজী’। সোফায় বসে আছেন খান বাহাদুর নুরুল হক। ক্যাপশনে লেখা- ‘৫ অক্টোবর ১৯৫৭’। এ ছাড়া তার কথিত মা-বাবা ও নানার একটি ছবি তার হেফাজতে রয়েছে। ক্যাপশনে লেখা- ‘৭ মে ১৯৬৩’। জানা যায়, এরই মধ্যে অন্তত ১৫-১৬টি পার্টির কাছে গুলশানের ওই প্লট বিক্রির বায়না বাবদ ১০ কোটি টাকার মতো হাতিয়ে নেন ভুয়া খান বাহাদুরের নাতি ইফতেখার। সর্বশেষ এক শিল্পগোষ্ঠীর কাছে ওই জমির বিক্রি বাবদ ১৩৫ কোটি টাকার একটি চুক্তি হয় ইফতেখারের।

গুলশানের ওই প্লটের সামনে ‘বে ডেভেলপমেন্টে’র সাইনবোর্ড সাঁটানো। সেখানে লেখা- ‘এই প্লটের মালিক ইনতেখাব আহমেদ খান। তার বাবা ড. মমতাজুল হক খান। পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়ে এর মালিক ইফতেখার আহমেদ খান।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বে ডেভেলপমেন্টের এক কর্মকর্তা বলেন, তারা জানেন, এই প্লটের বর্তমান মালিক তাদের প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার ইফতেখার আহমেদ খান। তার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী। বিলকিছ বেগম হলেন বে ডেভেলপমেন্টের মালিক ইফতেখারের নানি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তেজগাঁও থানার ওসি অপূর্ব হাসান বলেন, জাল কাগজপত্র তৈরি করে রাজউক থেকে এই জমির বরাদ্দ নিয়েছেন খান বংশের পরিচয়ধারী ইফতেখার। এ ছাড়া একই জমির মালিকানা দাবিদার আরও দু’জন ইফতেখারের সন্ধানও আমরা পেয়েছি। আসলে এরা সবাই বড় ধরনের জালিয়াত চক্রের সদস্য। তদন্তের মাধ্যমে সরকারের সংশ্নিষ্ট দপ্তরে প্রকৃত নথিপত্র জমা দেওয়া হবে। প্রয়োজনে সব ইফতেখারের ডিএনএ পরীক্ষা করাব।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত