জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ : জামায়াতের অর্থসংস্থান ও ধর্মভিত্তিক সকল রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি

| আপডেট :  ০১ আগস্ট ২০২৪, ০৫:৪৭  | প্রকাশিত :  ০১ আগস্ট ২০২৪, ০৫:৪৭


জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ : জামায়াতের অর্থসংস্থান ও ধর্মভিত্তিক সকল রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি

জাতীয়

বিবার্তা প্রতিবেদক


ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। চলতি বছরের জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে দেশে ঘটে যাওয়া সহিংসতা ও নাশকতায় এখনো স্তব্ধ জনজীবন। অথচ দুর্বার অপ্রতিরোধ্য গতিতে, সক্ষম অর্থনীতি ও নিরাপদ সমাজব্যবস্থা নিয়ে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলছিল বাংলাদেশ। কেন হলো এই ছন্দপতন? শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলনে ভর করে দেশের রাজনৈতিক অপশক্তি জামায়াত-শিবির দেশজুড়ে চালায় তাণ্ডবলীলা, ধ্বংসযজ্ঞ ও নাশকতা। এবার নিষিদ্ধ হলো সেই রাজনৈতিক অপশক্তি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীপক্ষ ও ধ্বংসাত্মক রাজনীতির হোতা ধর্মভিত্তিক দল ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ এবং উহার অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির’কে। এতে দেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের জনগণের বহুদিনের দাবি পূরণ হয়েছে, আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে বলেই মনে করছেন বিশিষ্টজনেরা।

বর্তমানে ‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত হলেও এই দলটির জন্ম পাকিস্তানে। কিন্তু পাকিস্তানে ১৯৪১ সালে সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদীর হাত ধরে জন্ম নেওয়া দলটি জন্মভূমিতেও অবৈধ হিসেবেই রয়েছে। নিজেদের ইসলামভিত্তিক রাজনৈতিক দল বললেও প্রকৃত অর্থে জামায়াত পরিচালিত হতো মওদুদীবাদের ওপর ভিত্তি করে। আর অন্যকোনো বড় দলের ওপর নির্ভর করে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য জামায়াত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের হাতিয়ার।

অতীতের দিকে তাকালে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের বর্বরোচিত কার্যক্রম ভুলে যাওয়া কোনো উপায় নেই। দেশের সূর্যসন্তানদের ধরে ধরে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন, নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করার পেছনে জামায়াতের অপকর্মের কথা বাংলাদেশের সচেতন সকল নাগরিকের জানা। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানের সেনাদের গণহত্যায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আটক করে অত্যাচারের জন্য,  নারী নির্যাতনের পৈশাচিক কর্মকাণ্ডে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে জামায়াত। অর্থাৎ, ধর্ষণ, খুন, গুম, অগ্নিসংযোগ, অত্যাচার, লুণ্ঠন থেকে শুরু করে যুদ্ধাপরাধের সব করে জামায়াত।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে সারাদেশে যে নাশকতা, আগুন দেয়ার ঘটনা ও পুলিশের ওপর আক্রমণ হয়েছে, এর পেছনে জামায়াত-শিবির রয়েছে। এ বিষয়ে তাঁর কাছে গোয়েন্দা প্রতিবেদন আছে। এক মাস ধরে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে জামায়াত-শিবিরের প্রশিক্ষিত লোকজনকে ঢাকায় জড়ো করা হয়। তারাই এসব অপকর্ম করেছে।

৩০ জুলাই, মঙ্গলবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক জানান, জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতি হবে না। আদালত নয়, কোন দলকে নিষিদ্ধ করতে পারে সরকার। বলেন, এর আগে জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধী হিসাবে ট্রাইব্যুনাল যে রায় দিয়েছিল সেটা সঠিক আছে। জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হলে দেশে ধ্বংসাত্মক কাজ বন্ধ হবে বলেও উল্লেখ করেন আনিসুল হক।

এর আগে শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন ঘিরে সংঘাত-সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার (২৯ জুলাই) রাতে গণভবনে মহাজোটের প্রধান ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে ১৪ দলের শীর্ষ নেতাদের এক বৈঠকে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধে একমত হয়। এসময় সরকারকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধ করা হয়।

জাতীয় পার্টি-জেপির সাধারণ সম্পাদক শেখ শহীদুল ইসলাম জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তুলে ধরেন। এ সময় কমিউনিস্ট কেন্দ্রের যুগ্ম আহ্বায়ক ডা. অসীত বরণ রায় দাঁড়িয়ে এ প্রস্তাব সমর্থন করেন এবং উপস্থিত ১৪ দল নেতারা এতে সমর্থন করলে হাত তুলে জানানোর আহ্বান জানান। বৈঠকে উপস্থিত ১৪ দলের নেতৃবৃন্দ দুই হাত তুলে এর সঙ্গে একমত পোষণ করেন।

এর আগে তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী তার দলের পক্ষে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের দাবিতে ২০০৯ সালে হাইকোর্টে রিট এবং ২০১৩ সালে এ-সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের আংশিক রায় ও ২০২৩ সালে পূর্ণাঙ্গ রায়ের কথা তুলে ধরেন।

১৪ দল নেতাদের ঐকমত্য পোষণের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়ভাবে বলেন, তিনিও জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের পক্ষে। দু-এক দিনের মধ্যে সরকারের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত আসবে। আক্ষেপ করে তিনি আরও বলেন, উচ্চ আদালত থেকে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের রায়ের পরই এই অপশক্তির রাজনীতি নিষিদ্ধের সুযোগ ছিল। তখনই জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করলে আজ এতগুলো লাশ দেখতে হতো না।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, দেশবিরোধী নৈরাজ্য, অস্থিরতা সৃষ্টির অভিযোগে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সুযোগ নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক জোট ১৪ দল।

উল্লেখ্য, সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে ফায়দা হাসিলের কৌশল গ্রহণ করায় উপমহাদেশে এখন পর্যন্ত চারবার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে জামায়াতকে। ১৯৪১ সালের আগস্ট মাসে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় উসকানির অভিযোগে প্রথমবার পাকিস্তানে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয় ১৯৫৯ সালে। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান প্রণীত মুসলিম পরিবার আইনের বিরোধিতার কারণে ১৯৬৪ সালের ৪ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর কর্মকাণ্ড আবারও নিষিদ্ধ হয়।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সেনাদের সঙ্গে পরাজিত শক্তি হিসেবে জামায়াতকে শাস্তির আওতায় আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে ৯০ হাজার পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করলে জামায়াত কার্যত সেই সময়ই ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তাদের বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শাস্তির ব্যবস্থা করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিদ্বেষ থেকে অসংখ্য সাধারণ মানুষ যেন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে না জড়িয়ে পড়ে, এটাই ছিল বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে জামায়াতের নেতা-কর্মীদের শাস্তির আওতায় আনার মূল কারণ। কেননা জাতি নিজেদের মধ্যে হত্যার সংস্কৃতি চালু করলে তা কারও জন্যই মঙ্গল ডেকে আনতে পারে না। বঙ্গবন্ধু ওই সময় স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন কারা শাস্তির আওতায় আসবে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে যেন জামায়াতের সাম্প্রদায়িক কার্যক্রম না চালাতে পারে অন্যকোনো নামে, সেই জন্য ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয় ১৯৭২ সালের সংবিধানে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চেতনা থেকেই ১৯৭২ সালে কার্যত জামায়াতের সাংগঠনিক কার্যক্রম শেষ হয়ে যায়।

কিন্তু ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনরুত্থান ঘটে জামায়াতের। বিদেশি অর্থায়ন ও নিজেদের সাংগঠনিক কার্যক্রমের মাধ্যমে খুব দ্রুত দেশে ত্রাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় দলটি। ১৯৭৬ সালের ৩ মে রাষ্ট্রপতি এ এস এম সায়েম একটি অধ্যাদেশ জারি করেন, যেখানে বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। ১৯৭২ সালের সংবিধানের এই ধারার কারণে জামায়াতের রাজনীতি অঘোষিতভাবেই নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশে। সেসময় ক্ষমতার মূল চাবি ছিল জিয়াউর রহমানের হাতে। এরপর জামায়াতে ইসলামীর আত্মপ্রকাশ করা ছিল শুধুই সময়ের ব্যাপার; কিন্তু জামায়াত তখনই নিজেদের দলীয় নাম ব্যবহার করে রাজনীতিতে আসেনি। কেননা তখনও সাধারণ মানুষের স্মৃতিতে বেশ স্পষ্ট ছিল মুক্তিযুদ্ধ সময়কালে জামায়াতের মানবতাবিরোধী কার্যক্রমের কথা। তাই কৌশলী হয়ে দলটি একই বছর ২৪ আগস্ট বেশ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দল মিলে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আইডিএল) নামের একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠন করে। মুক্তিযুদ্ধের মাত্র ৬ বছরের মাথায় একটি দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর সদস্যরা এই প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফিরে আসে।

তবে, এবার জামায়াতের সকল রাজনীতির অপ-রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার ফলে দেশে সুস্থধারার রাজনীতি এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে বলেই মনে করা হচ্ছে।

১ আগস্ট, বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টার দিকে সরকারের নির্বাহী আদেশে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮(১) ধারা অনুযায়ী জামায়াতে ইসলামী, দলটির ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ও তাদের অন্যান্য অঙ্গসংগঠনকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাঙ্গীর আলমের সই করা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এ আদেশ দেয়া হয়।

জামায়াত নিষিদ্ধ করার রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বিবার্তাকে বলেন, জামায়াতকে নিষিদ্ধের উদ্যোগটি খুবই ভালো, কিন্তু এটা অনেক আগেই করা উচিত ছিল। এটা অনেক আগেই করলে, জামায়াত সাম্প্রতিক সময়ে যে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ করল, সেগুলো হয়তো করতে পারত না। এতদিন ধরে জামায়াত বৈধ দল ছিল, যদিও নির্বাচনের ব্যাপারে তাদের উপর সুপ্রিমকোর্টের নিষেধাজ্ঞা ছিল, কিন্তু দল হিসেবে এটিকে অবৈধ করা হয়নি। ফলে, তারা দল হিসেবে তাদের যে কার্যক্রম তা চালিয়ে যেতে পেরেছে। প্রচারণা চালিয়ে গেছে, প্রশিক্ষণ নিয়েছে এবং তারা প্রচুর টাকা দেশ-বিদেশ থেকে পাচ্ছে। আর এভাবেই তারা সংগঠিত থেকে তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছিল। এটা তো ইতোমধ্যে প্রমাণিত যে, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে যে ধ্বংসযজ্ঞ হলো, দেশীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা মেট্রোরেল, হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজা, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর এবং মানুষ হত্যাসহ যে সহিংসতা ও নৃশংসতা হয়েছে- সাধারণ ছাত্রদের উপর ভর করে এসব কর্মকাণ্ড তারাই করেছে। আগেই তাদের অবৈধ ঘোষণা করা উচিত ছিল।

তিনি বলেন, শুধু জামায়াতকে নিষিদ্ধ করলেই হবে না, তাদের যে শীর্ষস্থানীয় নেতা সেসকল ব্যক্তির তালিকা তৈরি করে তাদেরও নিষিদ্ধের আওতায় আনতে হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই ১৯৭২ সালেই বলেছেন, ধর্মের ভিত্তিতে কোনো রাজনীতি করা যাবে না। সেক্ষেত্রে, শুধু জামায়াতকে নিষিদ্ধ করলেই হবে না, ধর্মভিত্তিক যে দলগুলো রয়েছে, তাদের মতোই ভাবধারা যে দলগুলো রয়েছে যারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করছে, চরমোনাইয়ের দল, হেফাজতসহ অন্য দলগুলো ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করছে সেসব দলকে নিষিদ্ধ করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বিবার্তাকে বলেন, বাংলাদেশের সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯-এর ধারা ১৮(১)-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরসহ এর সব অঙ্গসংগঠনকে রাজনৈতিক দল ও সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর মূল কারণ, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এই রাজনৈতিক দলটি ত্রিশ লক্ষ মানুষ হত্যাকাণ্ডের সাথে বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে সম্পৃক্ত ছিল। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে  মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য এই দলটি নিষিদ্ধ হয়। পরবর্তীতে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে এই দলটি সন্ত্রাসী দল হিসেবে নিষিদ্ধ চিহ্নিত হয়।

আমরা দেখেছি যে, এদেশে বিভিন্ন সময় হত্যাকাণ্ড, নাশকতা, বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের সাথে এই দলটি এবং তাদের ছাত্র সংগঠন সম্পৃক্ত ছিল। এবং অতি সম্প্রতি দেশে যে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ হয়েছে সেটিতে এই দলের যারা সমর্থক, এই দলের যারা নেতাকর্মী তাদের নানা অপকর্মের খবরাখবর পত্রপত্রিকায় এসেছে। আজকে সরকারের প্রজ্ঞাপন এলো সেটা আমরা দেখলাম। আমার মনে হয়, ধর্মভিত্তিক কোন দল আমাদের দেশে থাকাটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনারও পরিপন্থি। সুতরাং, বহু বিলম্বে হলেও এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং জনগণ মনে করে, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী এবং ত্রিশ লক্ষ শহীদের হত্যাকাণ্ডের সাথে যারা জড়িত তাদের এদেশের রাজনীতিতে অধিকার থাকা উচিত নয়।

জামায়াত নিষিদ্ধ হওয়ায় জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে জানিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য ও জাতীয় সংসদের হুইপ এডভোকেট সানজিদা খানম এমপি বিবার্তাকে বলেন, জামায়াতের নিবন্ধন ২০১৩ সালেই হাইকোর্ট নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। তাদের রায় অনুযায়ী ২০১৮ সালে নির্বাচন কমিশন তাদের নিবন্ধন বাতিল করে। নিবন্ধন বাতিল করার পর তারা নির্বাচনে অংশ নেয় কিন্তু ‘বাই নেম-এ’ নিতে পারে না। এরপর বিএনপির সাথে জোট করে তারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে জামায়াতের যে অবস্থান, নারী নির্যাতন, জ্বালাও-পোড়াও, যে ঘৃণিত কর্মকাণ্ড তা এখনো বহাল আছে, যা সাম্প্রতিক সময়েও দেখা গেছে। সন্ত্রাসী সংগঠন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করায় বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার স্বপক্ষে অবস্থান রয়েছে দেশের যেসকল মানুষের এবং যেসকল রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠনের- তাদের সকলের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে।

একই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মশিউর রহমান বিবার্তাকে বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যখন কার্যকর করা হয়, সেইসময়েই বাংলাদেশের মানুষের এক ধরনের আকাঙ্ক্ষা এবং দেশের আবশ্যিক দিক ছিল জামায়াত নিষিদ্ধ হোক। যে যুক্তিতর্ক ও বাস্তবতাকে মাথায় রেখে অনেকদিন ধরে মনে করা হচ্ছে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক ধরনের যুক্তি ছিল যে এদের যদি নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে এরা এদের হিংসাত্মক, ধ্বংসাত্মক রাজনীতির সাথে গোপনে সংশ্লিষ্ট থাকতে পারে এবং জামায়াত একটি মডারেটেড ইসলামিক কান্ট্রি-এর দল সেটাও কোনো কোনোসময় উপাধি দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, অর্থাৎ জামায়াত যেন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে পারে সে ব্যাপারে সবসময়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক ধরনের অভিভাবকত্ব পেয়েছে, যেটা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল।

তিনি আরো বলেন, যে দলের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ যুদ্ধাপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট তাদের রাজনৈতিক পরিচয় বা রাজনীতি করার অধিকার বাংলাদেশে না থাকাটাই প্রয়োজন ছিল এবং কাঙ্ক্ষিত ছিল। সেই বিবেচনায় যদি বলি, এই সিদ্ধান্ত সঠিক এবং যথার্থ। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ধর্মভিত্তিক যে অপ-রাজনীতি, যে সংঘাতপূর্ণ রাজনীতি তার অবসান ঘটবার সম্ভাবনা থাকবে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে শুদ্ধতা, সুস্থধারা ও স্থিতিশীলতা ফিরবে। সুতরাং দেরিতে হলেও এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই।

মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন গৌরব ’৭১ এর সাধারণ সম্পাদক এফ এম শাহীন বিবার্তাকে বলেন, জামায়াতের নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তে সরকারকে অভিনন্দন জানাই। একইসাথে বলতে চাই শুধু জামায়াতের রাজনীতি বন্ধ করলে হবে না, তাদের অর্থের রাজনীতিটা বন্ধ করতে হবে। অর্থাৎ, তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।

এফ এম শাহীন আরো বলেন, ২০১৩ সালে যখন আমাদের গণজাগরণ মঞ্চ হয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি জামায়াতকে নিষিদ্ধের দাবিতে সারা বাংলাদেশ উত্তাল ছিল। তারপর সরকার নানা টালবাহানা করে, তাদের সাথে আপসের রাজনীতি করে, অনেক নেতা তাদের সাথে ব্যাবসা করে, অনেকে ছেলে-মেয়ে বিয়ে দেয়। আমাদের দীর্ঘ সময় হতাশায় রাখলেও শেষ পর্যন্ত সরকারের শুভ বুদ্ধির উদয় হয়েছে। এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু জামায়াতের অর্থনীতিটা বন্ধ করতে হবে।

তিনি আরো বলেন, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যদি বন্ধ করতে হয়, তাহলে জামায়াতের সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে নিষিদ্ধ করতে হবে। জামায়াতের সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে তাদের সকল সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে, সেই সম্পদ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করতে হবে।  সাম্প্রতিক সময়ে জামায়াত দেশে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালাল, যে নাশকতা করল, দেশের যে ক্ষতি করল, এইসব কর্মকাণ্ডের জন্য আর্থিক সহায়তা যেসকল প্রতিষ্ঠান থেকে পেয়েছে ক্ষতিপূরণ হিসেবে সেসব প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে সেই অর্থ দিয়ে সাম্প্রতিক ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশের সবকিছু পুনঃনির্মাণের দাবি জানাই গৌরব ’৭১ এর পক্ষ থেকে।

বিবার্তা/এসবি/রোমেল/

© BBARTA24.NET
Developed by : ORANGEBD
  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত