ঢাকা মহানগর বিএনপির কমিটির সব হিসাব ওলটপালট

| আপডেট :  ০৮ আগস্ট ২০২১, ০৪:০৭  | প্রকাশিত :  ০৮ আগস্ট ২০২১, ০৪:০৭

রাজনীতির হিসাব-নিকাশ, দলে ভারসাম্য রক্ষা, সর্বোপরি দুই নেতাকে খুশি করতে গিয়ে ঢাকা মহানগর বিএনপির কমিটির সব হিসাব ওলটপালট হয়ে গেছে। ক্ষেত্রবিশেষে উল্টে গেছে বিএনপির হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তও।

নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মূলত দলের স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী দুই সদস্য মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে খুশি করতে গিয়ে বিএনপির হাইকমান্ডের সিদ্ধান্ত শেষ মুহূর্তে বদল করা হয়েছে। সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে আমানউল্লাহ আমানের জায়গায় ঢাকা মহানগর দক্ষিণে আহ্বায়ক করা হয়েছে আবদুস সালামকে। আর দক্ষিণের আহ্বায়ক করার সিদ্ধান্ত বদলে আমানকে পাঠানো হয়েছে উত্তরে। একই কারণে উত্তরের আহ্বায়ক করার সিদ্ধান্ত প্রায় চূড়ান্ত হলেও শেষ মুহূর্তে বাদ পড়ে গেছেন শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি। দলের তরুণ দুই নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন ও তাবিথ আউয়ালকে সদস্যসচিব করে দুই মহানগরে কমিটি ঘোষণার আলোচনাও এ কারণে বাদ দিতে হয়েছে বিএনপির হাইকমান্ডকে। দক্ষিণের আগের কমিটির সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত আগেই নিয়ে রেখেছিল বিএনপির হাইকমান্ড। বলা হয়, তিনি দলের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি।

গত ২ আগস্ট বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমানউল্লাহ আমান ও দলের ক্রীড়া সম্পাদক আমিনুল হকের নেতৃত্বে ঢাকা মহানগর বিএনপির উত্তর এবং বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আবদুস সালাম ও যুবদল দক্ষিণের সভাপতি রফিকুল ইসলাম মজনুর নেতৃত্বে দক্ষিণের কমিটি ঘোষণা করা হয়। তবে এমন কমিটি ঘোষণার সিদ্ধান্ত বিএনপি হাইকমান্ডের ছিল না বলে জানা যায়।

বিদেশে চলে যাওয়ায় দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালামের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলা সম্ভব হয়নি। দক্ষিণের সদস্যসচিব রফিকুল ইসলাম মজনু বলেন, ‘উত্তর-দক্ষিণের নেতা বদলের খবর আমি জানি না। তবে ঘোষিত কমিটি সঠিক হয়েছে বলে আমি মনে করি।’

আমানউল্লাহ আমান বলেন, ‘আমি উত্তর-দক্ষিণ বুঝি না। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যেখানে দিয়েছেন, সেখানেই দায়িত্ব পালন করব।’

বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, আমানউল্লাহ আমানকে ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক করার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত ছিল। কিন্তু এমন সিদ্ধান্তে আপত্তি তোলেন বিএনপির প্রভাবশালী দুই নেতা মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। এমনিতেও ঢাকা মহানগরের অধিবাসী না হওয়ায় কমিটিতে আমানের অন্তর্ভুক্তি নিয়েই দলের নানা স্তরে প্রশ্ন আছে।

মূলত কেরানীগঞ্জের স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে আমান ও গয়েশ্বরের মধ্যে বহু বছর ধরে বিরোধ চলছে। আব্বাসের সঙ্গে আমানের সরাসরি কোনো বিরোধ নেই। তবে বিএনপির রাজনীতিতে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এবং মির্জা আব্বাসকে ‘একই বৃন্তে দুটি ফুল’ বলে মনে করা হয়। অনেকের মতে, অপেক্ষাকৃত সহজ-সরল আব্বাসের রাজনৈতিক পথ চলার নেপথ্যের মূল কারিগর গয়েশ্বর। সংগত কারণেই তাঁর স্বার্থের অনুকূলে দাঁড়ান ঢাকা দক্ষিণে বসবাসকারী মির্জা আব্বাস।

সূত্রে জানা যায়, সম্ভাব্য কমিটিতে আমান আসছেন—এমন খবর জেনে আব্বাস ও গয়েশ্বরের পাশাপাশি তাঁদের সমর্থকরাও ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেন। নানা মাধ্যমে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে তাঁরা বার্তা পাঠান যে আমানকে সভাপতি করা হলে তাঁরা মেনে নেবেন না। এমনকি দুই নেতা প্রচ্ছন্নভাবে পদত্যাগের হুমকি দেন—এমনটাও দাবি করেন একটি সূত্র।

তবে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এ বিষয়ে বলেন, ‘আমাদের দুজনকে খুশি করার জন্য কমিটির নেতা বদল করা হয়েছে—এটা সঠিক না। কমিটি গঠনের দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন তাঁরা বিভিন্ন বিষয় পর্যালোচনা করে কমিটি দিয়েছেন। এখানে আমাদের সন্তুষ্ট করার কোনো বিষয় নেই।’

সূত্র মতে, দুই নেতার এই অনড় অবস্থানের পর তারেক রহমান বিষয়টি নিয়ে দলের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলেন। বিএনপির এই দুঃসময়ে ওই নেতারাও দলে বিরোধ তৈরির বিপক্ষে দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত ‘রিভিউ’ করার পরামর্শ দেন তারেককে। ফলে আমানের বদলে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালামকে দক্ষিণের সভাপতি করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।

জানা যায়, দুটির যেকোনো একটিতে আহ্বায়ক পদে সালামের নাম আলোচনায় থাকলেও তাঁর বিষয়টি নানামুখী হিসাব-নিকাশের মধ্যে ছিল। একইভাবে দক্ষিণের সদস্যসচিব পদে অবিভক্ত ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইঞ্জিনিয়ার ইসরাক হোসেনের নামও ছিল। আর উত্তরে ছিল তাবিথ আউয়ালের নাম। তবে তরুণ ওই দুই নেতা মহানগরে শীর্ষ পদে যেতে এখনই খুব বেশি আগ্রহী ছিলেন—এমন নয়। এ কারণে তাঁদের ১ নম্বর সদস্য করা হয়েছে। নতুন কমিটিকে ইসরাক অভিনন্দন জানিয়েছেন।

সালাম আগে থেকেই আলোচনায় থাকার নেপথ্যের বড় কারণ হলো, এর আগে দুই দফায় তিনি অবিভক্ত মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক পদে ছিলেন। আবার সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে সালাম বেশ কৌশলীও। এখন তিনি সবদিকে ভারসাম্য রক্ষা করে চলেন বলে জানা যায়। ফলে আমানের জায়গায় সালাম এবং এর সঙ্গে আব্বাসের ঘোরতর সমর্থক রফিকুল ইসলাম মজনুকে দক্ষিণের সদস্যসচিব করার আশ্বাস দেওয়া হলে আব্বাস-গয়েশ্বর কমিটি মেনে নেওয়ার ব্যাপারে নমনীয় হন বলে জানা যায়। অন্যদিকে ভারসাম্য রক্ষায় বিএনপির হাইকমান্ডও শেষ পর্যন্ত সালামকেই বেছে নেয়।

ওদিকে বেশ কয়েক বছর দলে কোণঠাসা থাকলেও মহানগর রাজনীতির মধ্য দিয়ে আমানকে সামনে আনার সিদ্ধান্ত বিএনপির হাইকমান্ড আগেই নিয়ে রেখেছিল বলে জানা যায়। তবে দক্ষিণে না দিতে পেরে শেষ পর্যন্ত তাঁকে উত্তরে নিয়ে আসা হয়।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ বিষয়ে বলেন, ‘মহানগর বিএনপির কমিটি গঠনে কোনো নেতার চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টি প্রাধান্য পায়নি। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নেতাদের রাজনৈতিক যোগ্যতা বিবেচনায় নিয়ে এবং যাচাই-বাছাই করে কমিটি দিয়েছেন।’

দলের কেন্দ্রীয় কমিটির ক্রীড়া সম্পাদক সাবেক ফুটবলার আমিনুল হক মহানগর বিএনপির রাজনীতিতে নতুন মুখ হলেও তিনি তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ বলে জানা যায়। কারও কারও মতে, ভোলার অধিবাসী আমিনুলকে সামনে আনার নেপথ্যে তারেকের বন্ধু কারাবন্দি গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের হাত থাকতে পারে। কারণ তাঁদের উভয়ের বাড়ি ভোলা জেলায়।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত