দেশের মোট সম্পদের প্রায় ১৫ শতাংশই এখন গুলশানে কেন্দ্রীভূত

| আপডেট :  ২৯ মার্চ ২০২২, ০৪:০৪  | প্রকাশিত :  ২৯ মার্চ ২০২২, ০৪:০৪

দেশের সবচেয়ে বিলাসবহুল আবাসন ও করপোরেট অফিসগুলো গড়ে উঠেছে গুলশানে। আর্থিক খাতের ঋণ ও আমানতের বড় একটি অংশ কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে শুধু গুলশান থানার অন্তর্ভুক্ত শাখাগুলোয়। সরকারি-বেসরকারি তথ্য ও ব্যবসায়িক গোপন সূত্রগুলোর আনুমানিক পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, দেশের বেসরকারি খাতের প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত সম্পদের প্রায় ১৫ শতাংশই এখন কেন্দ্রীভূত গুলশানে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, ওই সময় তফসিলি ব্যাংকগুলোর গুলশান থানা এলাকাধীন শাখাগুলোয় ঋণ হিসাবের সংখ্যা ছিল ৭ লাখ ৯ হাজার ৩৫। এসব হিসাবের আওতায় বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৭ হাজার ৯৩৮ কোটি ১৫ লাখ ৬৪ হাজার টাকা, যা তফসিলি ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের ১৭ দশমিক ১৮ শতাংশ। ঋণের মতো আমানতেরও গুলশান এলাকায় বড় ধরনের কেন্দ্রীভবন রয়েছে। এলাকাটিতে তফসিলি ব্যাংকগুলোর মোট হিসাবের সংখ্যা ২৭ লাখ ১৬ হাজার ৯৩২। হিসাবগুলোর অধীনে মোট সংরক্ষিত আমানতের পরিমাণ ১ লাখ ৬৬ হাজার ৪৮৫ কোটি ৭৯ লাখ ২৩ হাজার টাকা, যা তফসিলি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মোট আমানতের ১১ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ।

দেশের সব অতিধনী ব্যবসায়ীর বাসস্থানও গুলশান এলাকাতেই। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের বসবাসও সেখানেই। এছাড়া রাজধানীতে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হাতে গোনা দু-একটি এলাকার অন্যতম গুলশান। কূটনৈতিক পাড়া হিসেবে এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাজধানীর অন্যান্য এলাকার চেয়ে অনেক উন্নত। নাগরিক সুযোগ-সুবিধা অনেক বেশি। বিপুলসংখ্যক ধনীর বসবাস, অভিজাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অত্যাধুনিক হাসপাতালের উপস্থিতি গুলশানকে প্রতিষ্ঠিত করেছে দেশের সবচেয়ে কুলীন এলাকা হিসেবে।

এছাড়া নগরের ক্রমবর্ধমান ট্রাফিক সমস্যা এলাকাটিকে বাণিজ্যিক অবয়ব দেয়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্যমতে, বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে গুলশানের আকর্ষণ বাড়িয়েছে নগরীর যোগাযোগ ব্যবস্থা। অভিজাত ব্যবসায়ীদের অনেকেই কর্মঘণ্টা বাঁচাতে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কার্যালয়গুলো আবাসনস্থলের কাছাকাছি নিয়ে এসেছেন। আবার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বাড়তে থাকায় এখানে ব্যাংকগুলোরও উপস্থিতি দিনে দিনে বেড়েছে। বর্তমানে অন্তত ১০টি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় রয়েছে গুলশানে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, এটা স্বাভাবিক। বিশ্বের সব জায়গায়ই দেখা গেছে, একটি নির্দিষ্ট এলাকায় সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে। ব্যাংক, করপোরেট গ্রুপের সবই গুলশানে আছে। যারা করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, তারাও চেষ্টা করেন কার্যালয়ের আশপাশে আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হলে তারা হয়তো অন্য জায়গায় থাকতে পারতেন। কিন্তু তা নেই বলে সবই গুলশানে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের সম্পদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশই আছে গুলশানে।

গুলশান ও এর আশপাশ এলাকাগুলোয় বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্যিক ভবনের ছড়াছড়ি। এর কোনোটির ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, আবাসিক প্লটকে রূপান্তর করে বাণিজ্যিক করা হয়েছে। আবার কোনো আবাসিক প্লটে অনুমতি ছাড়াই গড়ে উঠেছে বাণিজ্যিক ভবন। আবাসন ব্যবসায়ীদের বক্তব্য অনুযায়ী, গুলশানের প্রথম প্রজন্মের অধিবাসীরা এখানে জমি বরাদ্দ পেয়ে বাড়ি করে বসবাস শুরু করেন। তাদের ছেলেমেয়েরা এখানেই বড় হয়েছে। তারা গুলশান-বনানীর মতো পরিকল্পিত এলাকা ছেড়ে কোথাও যেতে চায় না। জমির স্বল্পতা রয়েছে। কিন্তু মানুষ বাড়ছে। জমির দামও আকাশচুম্বী। ফলে এসব জমি ডেভেলপার কোম্পানির কাছে দিয়ে দেয়া হয়, যাতে বেশি মানুষের একসঙ্গে বসবাসের উপযোগী স্থাপনা নির্মাণ করা যায়। আবার এখানে যেহেতু বাণিজ্যিক ভবন তৈরির সুযোগ আছে, অনেকে সে সুযোগটিও কাজে লাগাচ্ছেন।

এ বিষয়ে দেশের অন্যতম বড় আবাসন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান শেলটেক প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর আহমেদ বলেন, গুলশানে ব্যাংকিংয়ের বড় একটি জায়গা হলো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো। একটা সময়ে প্রথম প্রজন্মের ব্যবসায়ীদের কারোরই গুলশানে অফিস ছিল না। কিন্তু বর্তমানে প্রেক্ষাপট বদলানোয় অনেকেই গুলশানে কার্যালয় করছে। আবাসিক এলাকা হিসেবে গুলশান অনেক সুবিধাজনক। ঢাকার ক্রমবর্ধমান ট্রাফিক সমস্যাকে এড়াতে অনেকেই গুলশানে গিয়েছেন। এলাকাটিতে আবাসনের দাম অন্যান্য এলাকার চেয়ে অনেক গুণ বেশি। আবাসন গড়েই ওঠে সার্বিক ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশের ওপর কেন্দ্র করে। গুলশানে দাম বেশি, কারণ এলাকাটিতে কেন্দ্রীভবন অনেক বেশি। ব্যাংক, হোটেল, কূটনীতিক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কেনাকাটার শপিং মল, হাসপাতাল সবকিছুই আছে এলাকাটিতে।

সম্পদের এ কেন্দ্রীভবন ও আভিজাত্য দেশের সবচেয়ে দামি আবাসিক-বাণিজ্যিক এলাকা করে তুলেছে গুলশানকে। গোটা দেশের অন্য যেকোনো জায়গার চেয়ে প্লট ও ফ্ল্যাটের দাম গুলশানে বেশি। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ফ্ল্যাটের দাম পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২০ সালেও শান্তিনগরে ফ্ল্যাটের দাম ছিল প্রতি বর্গফুট ৮ হাজার ৫০০ টাকা। কলাবাগান ও শ্যামলীতে ছিল যথাক্রমে ৯ হাজার ৫০০ ও ৭ হাজার ৫০০ টাকা করে। একই সময়ে গুলশানে ফ্ল্যাটের মূল্য ছিল প্রতি বর্গফুট ১৫ হাজার টাকা। আবাসিক প্লটেও দামের তারতম্য অনেক। উত্তরা প্রথম-দ্বিতীয় পর্ব ও বারিধারা জে ব্লকে আবাসিক প্লটের দাম প্রতি কাঠা ২৪ থেকে ৭২ লাখ টাকা। গুলশানে এ দাম ছিল কাঠাপ্রতি দেড় কোটি টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ২ কোটি টাকা। বাণিজ্যিক প্লটের দাম আরো অনেক বেশি। বিভিন্ন উৎসের তথ্য অনুযায়ী, মূল সড়কের পাশে, বিশেষ করে গুলশান এভিনিউয়ে এখন প্রতি কাঠা জমির দাম ১০-১২ কোটি টাকা।

অথচ ষাটের দশকেও জায়গাটি ছিল জঙ্গলে ঘেরা এক গণ্ডগ্রাম। দেখা মিলত মেছোবাঘেরও। রাতের বেলায় ডাকত শিয়াল। পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে জায়গাটির ওপর নজর পড়ে শৌখিন ধনীদের। করাচির অভিজাত এলাকা গুলশানের আদলে গড়ে তোলা হয় জায়গাটিকে। এলাকাটির নামও ভোলা গ্রাম থেকে পাল্টে রাখা হয় গুলশান।

আশির দশকেও জায়গাটি পরিচিত ছিল ছিমছাম আবাসিক এলাকা হিসেবে। ওই সময়ই এলাকাটিকে পৌরসভার অধীনে নিয়ে একে একে বিভিন্ন দেশের দূতাবাস গড়ে তোলা হয়। দূতাবাসগুলোর আধিক্য এলাকাটিকে রাজধানীর অন্যান্য এলাকার চেয়ে নিরাপত্তা ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে এগিয়ে রাখে। একই সময়ে আবার সামরিক শাসনের অধীনে দেশে শিল্প খাতে ব্যাপক মাত্রায় বিরাষ্ট্রীয়করণ শুরু হয়। আর্থিক খাতে ঋণের প্রবাহ হয়ে ওঠে অবাধ ও নিয়ন্ত্রণহীন। রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে উদ্ভব ঘটে একদল নব্যধনীর। গুলশানের নাগরিক সুবিধা, জীবনযাত্রার মান ও নিরাপত্তা তাদের আকর্ষণ করে। নব্বইয়ের দশকের দিকে এসে আবাসিক এলাকাটিতে গড়ে উঠতে থাকে সুউচ্চ অট্টালিকা। বিভিন্ন ডেভেলপার কোম্পানির চোখ পড়ে এলাকাটিতে। বহুজাতিক ও স্থানীয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোও এখানে তাদের কার্যালয় খুলতে থাকে।

গুলশানের মতো এলাকায় বিপুল পরিমাণ সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ার বিষয়টিকে দেশে ক্রমবর্ধমান বৈষম্যেরই ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, বিষয়টিকে অতিধনীদের হাতে দেশের সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ার প্রতিফলন বলা চলে। এলাকা হিসেবে বিবেচনা করলে দেখা যায়, দেশের ধনীদের বড় একটি অংশ গুলশানের মতো জায়গায়ই বসবাস করছেন। আবার এলাকাটির নানা সুযোগ-সুবিধাও এখানে অনেক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে ডেকে এনেছে। যদিও খাতভিত্তিক বিশেষায়ণ ও সম্পদ বিকেন্দ্রীকরণের যথাযথ উদ্যোগ থাকলে দেশে বৈষম্যের ব্যাপারটিকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হতো।

প্যারিস স্কুল অব ইকোনমিকসের ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাবের বৈশ্বিক অসমতা প্রতিবেদন ২০২২-এর তথ্য অনুযায়ী, মোট জাতীয় আয়ের ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ দেশের শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীর দখলে। এ ১ শতাংশের বড় একটি অংশের অবস্থান গুলশানে।

একটি এলাকায় বিপুল পরিমাণ সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ার বিষয়টিকে উচিত বলে মানছেন না ব্যবসায়ী সমাজের প্রতিনিধিরাও। এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন এ বিষয়ে বলেন, বাংলাদেশে শিল্প, বাণিজ্য ও আর্থিক খাতের যথোপযুক্ত কোনো ক্লাস্টার হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যেক শহরে ফাইন্যান্সিয়াল ডিস্ট্রিক্ট থাকার কথা। সারা পৃথিবীতে বড় শহরগুলোয় এগুলোর বিশেষায়িত ক্লাস্টার হিসেবে আলাদা এলাকা গড়ে উঠতে দেখা যায়। কিন্তু তা বাংলাদেশে নেই। বরং এখানে গুলশান, বনানী বা মতিঝিলের মতো এলাকাগুলোয় সব কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়তে দেখা যায়। একসময় রাজধানীর বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিল মতিঝিল। কিন্তু শহরের কলেবর বৃদ্ধি ও যানজটসহ বিভিন্ন কারণে এখন তা স্থানান্তর হয়েছে গুলশানে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের বড় করপোরেট গ্রুপগুলোর প্রধান কার্যালয় এখন গুলশানে। কূটনীতিকদের দপ্তর ও আবাসন ব্যবস্থাও অনেক আগে থেকেই এখানে। বেশির ভাগ ব্যাংকের আগে প্রধান কার্যালয় ছিল মতিঝিলে। এখন দেখা যাচ্ছে তা গুলশানে। বড় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশেরই অফিস গুলশানে। পর্যায়ক্রমে সবই স্থানান্তর হচ্ছে এলাকাটিতে। গুলশান এখন জনপ্রিয় আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা। এলাকাটির প্লটগুলো পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়েছিল। অভিজাত পরিকল্পিত এলাকা হিসেবে সবাই সেখানে থাকতে চায়। অফিস-বাসা সবকিছুই গুলশানকেন্দ্রিক। দেখা যাচ্ছে, কোনো প্রতিষ্ঠানের কারখানা সাভার, গাজীপুরে হলেও অফিসগুলো গুলশান-বারিধারায়। অফিস, বাসাবাড়ি, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল সবকিছু এক জায়গায় হওয়া সঠিক বলে আমি মনে করি না।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, গুলশানের চেয়ে ঢাকার অনেক এলাকায় জনঘনত্ব অনেক বেশি। কিন্তু ওইসব এলাকায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীও বেশি। গুলশানে যত বড় বাড়ির মালিক ছিল তাদের প্রত্যেকের প্লট ছিল এক বিঘা করে। সেই এক বিঘা তারা বিক্রি করেছে ডেভেলপারের কাছে। ফলে মানুষ সেখানে স্বাভাবিকভাবেই গিয়েছে। গুলশান পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা একটি এলাকা। কূটনীতিকরাও সেখানে ভিড়েছেন। মানুষ তো চায়ই সব দিক থেকে নিরাপদ একটি এলাকায় বসতি গড়ে তুলতে। ফলে ঢাকার প্রাণকেন্দ্র এখন গুলশান। সবাই চায় এলাকাটিতে ফ্ল্যাট কিনতে। গুলশানের রেট চার্ট এখন বৃদ্ধির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ম্যানহাটন সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহরগুলোর একটি। সেখানেও অনেক মানুষ থাকছে। যাদের সামর্থ্য আছে, তারা থাকবে। এটাই মুক্ত বাজার অর্থনীতি। আমাদের গুলশানও সে রকমই একটি জায়গা।
সূত্র: বণিক বার্তা

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত