দেশে কালোটাকা ৮৯ লাখ কোটি, বিদেশে অর্থপাচার ৮ লাখ কোটি

| আপডেট :  ২৩ মে ২০২২, ১০:১২  | প্রকাশিত :  ২৩ মে ২০২২, ১০:১২

দুর্নীতির মাধ্যমে গত ৪৬ বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকা পাচার করা হয়েছে। একই সময়ে দেশে কালোটাকার অঙ্ক দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৯ লাখ কোটি টাকা। এসব টাকা উদ্ধারে একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করার সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি। পাশাপাশ্নি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য সাড়ে ২০ লাখ কোটি টাকার বেশি বিকল্প বাজেট প্রস্তাব করেছে সংগঠনটি।

রোববার অর্থনীতি সমিতির অডিটোরিয়ামে ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা ২০২২-২৩ : একটি জনগণতান্ত্রিক বাজেট প্রস্তাব’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত এসব তথ্য উপস্থাপন করেন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. আইনুল ইসলাম।

দেশের আয় বৃদ্ধি ও বাজেট ঘাটতি পূরণের বিষয়ে অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বলেন, অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণে অন্যতম উৎস হলো সম্পদ কর ও অতিরিক্ত মুনাফার ওপর কর। এ ছাড়া কালোটাকা উদ্ধার থেকে প্রাপ্ত অর্থ এবং পাচার ও বিদেশি নাগরিক থেকে প্রাপ্ত কর।

কালোটাকা ও অর্থ পাচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৯৭২-৭৩ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত দেশে কালো টাকার অঙ্ক ৮৮ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে গত ৪৬ বছরে পুঞ্জিভূত কালোটাকার মাত্র দুই শতাংশ উদ্ধারের প্রস্তাব করছি। যেখান থেকে ১ লাখ ৭৭ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা আসবে। ওই ৪৬ বছরে বিদেশে অর্থ পাচারের অঙ্ক প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকা। পাচার করা অর্থের ১০ শতাংশ উদ্ধার করে বাজেটে আয় খাতে ব্যবহার করার জন্য প্রস্তাব করছি। যার অঙ্ক ৭৯ হাজার ৮৩২ কোটি টাকা। দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও কালোটাকা উদ্ধারে একটি স্বাধীন কমিশন গঠনেরও প্রস্তাব করছি।

আবুল বারকাত বলেন, ২০ লাখ ৫০ হাজার ২৬ কোটি টাকার জনগণতান্ত্রিক বিকল্প বাজেট প্রস্তাব করছি। যা বর্তমান বাজেটের ৩.৪ গুণ বেশি। যেখানে ৩৩৮টি সুপারিশ রয়েছে। এসব সুপারিশের মধ্যে উলে­খযোগ্য হচ্ছে- সমাজ থেকে চার ধরনের বৈষম্য (আয়, সম্পদ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা) ক্রমাগত হ্রাস করে নির্মূলের দিকে যাওয়া। এ লক্ষ্যে আয় ও ব্যয় খাতে মৌলিক কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে। দ্বিতীয়ত, বাজেটে অর্থায়নের প্রান্তিক, দরিদ্র, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্য মধ্যবিত্তের ওপর কর দাসত্ব আরোপ করা যাবে না। এরপর রয়েছে সামাজিক সুরক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়নের সুপারিশ।

মূল্যস্ফীতির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বার্ষিক মূল্যস্ফীতি ৫ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে রাখতে হবে। শর্ত হলো কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে এবং ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে। সরকার মূল্যস্ফীতির যে হিসাব দিচ্ছে তা বাস্তবসম্মত নয়। দ্বিতীয়ত খাদ্য মূল্যস্ফীতি কোনো অবস্থাতে বাড়ানো যাবে না।

সরকারের চলমান মেগাপ্রকল্প প্রসঙ্গে বারকাত বলেন, ‘দেশের মেগা প্রকল্পের বৈদেশিক ঋণ যখন শোধ করা শুরু হবে, বিশেষ করে ৪-৫টি মেগা প্রকল্পের সুদ পরিশোধ শুরু করলে তখন আমরা সরাসরি রেড ঝুঁকিতে চলে যাব। যা আনুমানিক হিসাবে ২০২৭-২৮ সালে শুরু হওয়ার কথা। আর ২০৩২ সালে যখন ১২টি মেগা প্রকল্পের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে যাব, তখন বিপদ আরও প্রকট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বৈশ্বিক মহামন্দা, বৈশ্বিক মহামারি ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব ভবিষ্যতে বৈদেশিক ঋণের রেড ঝুঁকিতে ফেলবে কি না- তা নিয়ে কঠিন চিন্তার প্রয়োজন রয়েছে।

আবুল বারকাত বলেন, বিকল্প বাজেট প্রস্তাবে প্রত্যক্ষ করের ওপর জোর দিতে বলেছি। কারণ পরোক্ষ করের কারণে মানুষে মানুষে বৈষম্য বৃদ্ধি পায়। প্রস্তাব করছি দরিদ্র ও অতি দরিদ্রদের আগামী কয়েক বছর কর জালের বাইরে রাখার।

রাজস্ব আয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অর্থনীতি সমিতির বাজেটের আকার, যা বর্তমান বাজেটের ৩.৪ গুণ বেশি। বিকল্প বাজেটে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ১৮ লাখ ৭০ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। যা প্রস্তাবিত বিকল্প বাজেটের ৯২ শতাংশের বেশি। প্রস্তাবিত বাজেটে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আয়ের ৭৭ শতাংশ আসবে প্রত্যক্ষ কর থেকে, বাকিটা পরোক্ষ কর। যেখানে প্রত্যক্ষ কর থেকে আসে মাত্র ৪৬ শতাংশ। বাজেট ঘাটতি ৭ শতাংশ, যা সরকারের চলতি বাজেটে ঘাটতি তুলনায় অনেক কম। বাজেট ঘাটতি পূরণে বৈদেশিক ঋণ কিংবা দেশীয় ব্যাংক থেকে ঋণের প্রয়োজন নেই। সমস্যাটা অর্থনৈতিক হলেও সমাধান তার রাজনৈতিক। বাজেট ঘাটতি পূরণে তিনি কালোটাকা ও বিদেশে পাচার করা অর্থ ফেরতের প্রতি জোর দেন।

সমিতির সভাপতি বলেন, ‘আমাদের আরেকটি বড় কষ্ট হলো, সবকিছু এককেন্দ্রিক ও ঢাকামুখী, যা উন্নয়ন সহায়ক নয়। তাই সমিতির প্রস্তাবে কোন মন্ত্রণালয় কোন বিভাগে যাবে, সেটি রয়েছে।’

বারকাত বলেন, বাজেটে মোট বরাদ্দে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে। এখানে মোট বরাদ্দ বাজেটের ২১ শতাংশ। দ্বিতীয় অগ্রাধিকার খাত হচ্ছে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাত, তৃতীয় হচ্ছে কৃষি। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ সব ধরনের বৈষম্য বেড়েছে। এসব পালটাতে হবে, ঝুঁকি হ্রাস করতে হবে। সেজন্য গবেষণা ও বিজ্ঞান চর্চায় অধিক গুরুত্ব দিয়েছি। গবেষণা উন্নয়নের গুরুত্ব বিবেচনায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে নতুন মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব করছি। যার নাম গবেষণা উদ্ভাবন বিচ্ছুরণ ও উন্নয়ন। এই মন্ত্রণালয়ের জন্য আগামী পাঁচ বছরে ৫ লাখ কোটি টাকা বরাদ্দের কথা বলছি। আরেকটি মন্ত্রণালয় হতে পারে সেটি হলো গণপরিবহণ মন্ত্রণালয়। দেশীয় শিল্পে সুরক্ষা দিতে হবে। এ খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।

বিকল্প বাজেট সংবাদ সম্মেলনের ভিডিও কনফারেন্সে দেশের ৬৪টি জেলা, ১০৭টি উপজেলা এবং ২১টি ইউনিয়ন থেকে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সদস্য এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিরা ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়েছেন।

২০২১-২২ অর্থবছরে জাতীয় বাজেটের আকার বা মোট ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছিল ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১৭.৫ শতাংশ। পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট বরাদ্দ রাখা হয় ৩ লাখ ৭৮ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা।
সূত্র: যুগান্তর

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত