দেশে-বিদেশে সম্পদের পাহাড়, বিয়েও করেছেন চারটি সেই পুলিশ কর্মকর্তা

| আপডেট :  ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১১:৫৭  | প্রকাশিত :  ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৯:২৩

ই-কমার্সভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের অন্যতম পরিচালক বনানী থানার পরিদর্শক শেখ সোহেল রানার বিপুল অর্থ-সম্পদের খোঁজ মিলছে। নামে-বেনামে দেশে-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তিনি। থাইল্যান্ডের পাতায়ায় হিলটন হোটেলের পাশে একটি পাঁচতারকা হোটেল করার জন্য শতকোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে তার। দেশেও একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ রয়েছে। এই অঙ্কও প্রায় একশ কোটি টাকার কাছাকাছি। এ ছাড়া পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে সুপারশপ, বার ও রেস্টুরেন্টও রয়েছে। সম্প্রতি ই-অরেঞ্জে গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের বিষয়টি সামনে আসার পরপরই সোহেলের অর্থ-সম্পদ নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে একাধিক সংস্থা। বনানী থানার ওই পুলিশ কর্মকর্তার অর্থবিত্তের খোঁজ নিচ্ছে এমন একটি সূত্র থেকে গতকাল রোববার এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এখন পর্যন্ত ই-অরেঞ্জের দুটি ব্যাংক হিসাব থেকে প্রায় ৩৪৯ কোটি টাকা বেহাত হওয়ার তথ্য মিলেছে। এই অর্থ ই-অরেঞ্জ থেকে সরিয়ে দেশে-বিদেশে অন্যান্য ব্যবসায় সোহেল বিনিয়োগ করেছেন- এমনটি বলছেন সংশ্নিষ্টরা।

ই-অরেঞ্জের অর্থ আত্মসাতের মামলায় আসামি হওয়ার পরপরই দেশ থেকে পালাতে গিয়ে শুক্রবার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের চ্যাংড়াবান্ধা এলাকায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের হাতে আটক হন সোহেল। বিনা ভিসায় ভারতে প্রবেশের দায়ে করা মামলায় দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে বর্তমানে তিনি তিন দিনের হেফাজতে রয়েছেন। ভারতে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের সময় সোহেলের কাছ থেকে থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের পাঁচটি ডেবিট কার্ড জব্দ করা হয়। তার পাসপোর্টে ভারতের ভিসা না থাকলেও ছিল থাইল্যান্ড, সৌদি আরব, চীন ও শেনজেন ভিসা।

এদিকে, সোহেলকে ভারতে গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর গতকাল তাকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। বনানী থানায় তার পদে নতুন কর্মকর্তা হিসেবে উত্তরা-পূর্ব থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আলমগীর গাজীকে বদলি করা হয়েছে।

সোহেলের ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, এখন চাইলেই আমরা ভারত থেকে সোহেলকে আনতে পারছি না। যেহেতু সেখানে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাই আদালতের অনুমতি ছাড়া তাকে ফেরত আনা সম্ভব নয়। প্রথমে আমরা বিজিবির মাধ্যমে বিএসএফের সঙ্গে যোগাযোগ করে ফেরত আনার চেষ্টা করব। সেটা সম্ভব না হলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, ই-অরেঞ্জের অর্থ আত্মসাতের মামলায় সোহেলের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। এর বাইরে যদি সে অবৈধ অর্থ-সম্পদের মালিক হয়ে থাকে, তাও তদন্ত করে দেখবে দুদক।

ই-অরেঞ্জের প্রতারণার অভিযোগে ৩১ আগস্ট ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোর্শেদ আল মামুন ভূঁইয়ার আদালতে মামলার আবেদন করেন ইসতিয়াক হোসেন টিটু নামের এক ভুক্তভোগী। সেখানে তিনি পুলিশ কর্মকর্তা সোহেল রানাসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে গুলশান থানার ওসিকে এফআইআর হিসেবে গ্রহণ করার নির্দেশ দেন। তদন্ত করে আগামী ১০ অক্টোবর প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য করেন আদালত। এর পরপরই গ্রেপ্তার এড়াতে অবৈধ পথে দেশ ছাড়েন সোহেল। যদিও সোহেলসহ ই-অরেঞ্জ সংশ্নিষ্ট কয়েকজনের বিরুদ্ধে দেশের সব বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে দেশত্যাগের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে মামলা নথিভুক্ত করার পর সোহেল রানাকে গ্রেপ্তারের জন্য খুব বেশি সময় আর সুযোগ আমরা পাইনি। থানায় নথিভুক্ত হওয়ার আগেই আদালতে আবেদনের খবর কোনোভাবে তার কাছে যায়। এরপর সে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বলে ধারণা করছি। এরই মধ্যে ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে করা মামলায় গ্রেপ্তার তিনজনকে রিমান্ড পেতে আজ সোমবার আদালতে আবেদন করা হবে। সোহেলের স্ত্রীসহ পলাতক আরও ছয়জনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

দেশে যেসব সম্পদের খোঁজ মিলছে
এখন পর্যন্ত সোহেল রানার যেসব সম্পদ থাকার তথ্য মিলছে তার মধ্যে রয়েছে পূর্বাচলে ৩ নম্বর সেক্টরে প্লট ও নিকেতনে দুটি ফ্ল্যাট। একটি ফ্ল্যাটে তার ছোট খালু মো. সাগর থাকেন। একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে তার বিনিয়োগ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ডিলারশিপ নিয়ে ব্যবসা করে আসছেন তিনি। তার অফিস গুলশান ২ নম্বরে ডিসিসি মার্কেটের কাঁচাবাজারের পেছনে। এ ছাড়া গুলশানের শাহজাদপুরে আছে তার তিনটি ফ্ল্যাট। খাগড়াছড়িতে একটি রিসোর্টের জন্য জায়গা কেনা রয়েছে সোহেলের। গোপালগঞ্জে প্রায় ৫০০ বিঘার বেশি জমির মালিক তিনি। গুলশান এলাকায় ব্যবসা করছে এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ডিলারশিপ আছে তার। তিনি আমেরিকান, জার্মান ও কোরিয়ান ক্লাবের সদস্য।

বিদেশে যত সম্পদ
বিদেশে সোহেল রানার সম্পদের মধ্যে রয়েছে থাইল্যান্ডের পাতায়ায় জমি, ফ্ল্যাট ও সুপারশপ। সেখানে হিলটন হোটেলের পাশে আরেকটি পাঁচতারকা হোটেলে শতকোটি টাকার বিনিয়োগ, পর্তুগালে দোকান ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসা, প্যারিসে রেস্টুরেন্ট ও বার ব্যবসা, ফিলিপাইনের ম্যানিলায় স্ট্রিট বার এবং নেপালেও নানা ব্যবসায় তার বিনিয়োগ আছে। তদন্ত-সংশ্নিষ্ট একটি দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, ই-অরেঞ্জ থেকে সরিয়ে নেওয়া অর্থের একটি বড় অংশ থাইল্যান্ডে পাচার হয়েছে।

চারটি বিয়ের তথ্য মিলেছে
জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য অনুযায়ী, পুলিশ কর্মকর্তা সোহেল সর্বশেষ শাহজাদপুরের সুবাস্ত নজরভ্যালির টাওয়ার-৩- এর ফ্ল্যাট ১০/বি-এ বসবাস করতেন। এখন পর্যন্ত কাগজপত্রে তার চারটি বিয়ে করার তথ্য পাওয়া যায়। তার প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে ১০ বছর ধরে সম্পর্ক নেই। তার দ্বিতীয় স্ত্রী একজন অভিনেত্রী। লন্ডনে পড়তে গিয়ে তৃতীয় বিয়ে করেন সোহেল। চতুর্থ স্ত্রীর নাম নাজনীন নাহার বীথি। তিনি ই-অরেঞ্জের অর্থ আত্মসাতের মামলার আসামি হিসেবে বর্তমানে পলাতক। এ ছাড়া সোহেলের ছোট বোন সানিয়া মেহজাবিন জুঁই ই-অরেঞ্জের প্রধান নির্বাহী ছিলেন। তার স্বামী মুসফিকুর রহমান সুমন অনলাইন ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের ডিজিএম। তবে দীর্ঘদিন ধরে ছোট বোন মেহজাবিনকে সামনে রেখেই নেপথ্যে থেকে ই-অরেঞ্জ পরিচালনা করে আসছিলেন তিনি। চতুর এই পুলিশ কর্মকর্তা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে পুলিশে যোগ দেন। ছাত্রাবস্থায় ক্যাম্পাসে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন তিনি। অভিযোগ আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিও হন জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে পুলিশ থেকে চাকরি হারান সোহেল। এর পরই আবার চাকরি ফেরত পান। দীর্ঘদিন ঘুরেফিরে গুলশানে নানা পদে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। গুলশান-বনানীকেন্দ্রিক অবৈধ ভিওআইপি কারবার, স্পা সেন্টার, হোটেল-বার ও বিভিন্ন দূতাবাস থেকে ভিসা পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে কোটি কোটি টাকা আয় করেন তিনি।

নেপথ্যে আরেক রাঘববোয়াল
তদন্ত-সংশ্নিষ্ট সূত্র বলছে, সোহেলের এই অবৈধ কারবারের সূত্র ধরে আমান উল্লাহ নামে আরেক রাঘববোয়ালের খোঁজ মিলেছে। ছলচাতুরী করে নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে চলতি বছরের জুনে আমান উল্লাহ ও বীথি নামের এক তরুণীর কাছে ই-অরেঞ্জ বিক্রি করে দেওয়া হয়। ই-কমার্সভিত্তিক প্রতিষ্ঠান নগদ হাট ও আমান টেল এবং ডিজিটাল কমিউনিকেশন নেটওয়ার্কসহ নানা ধরনের ব্যবসা রয়েছে আমানের। নামে-বেনামে তারও অঢেল সম্পদ থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। বিদেশে তিনি টাকা পাচার করেছেন- এমন তথ্য পেয়েছে একাধিক সংস্থা। তার বিরুদ্ধে প্রতারণা ও জালিয়াতির একাধিক মামলাও রয়েছে। এক সময়ের প্রতারক আমান বিয়ে করেন পুলিশের এক কর্মকর্তাকে। পরে ওই কর্মকর্তা তাকে ডিভোর্স দেন। এখন পর্যন্ত তিনটি বিএমডব্লিউ, দুটি মার্সিডিজ ও এক প্রাডো গাড়ির মালিকানা থাকার তথ্য আছে আমান উল্লাহর। তার গ্রামের বাড়ি ভোলার চরফ্যাসন পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডে। আমান উল্লাহর বাবা মৃত মোছাদ্দেক চৌধুরী। আমানের শৈশব কেটেছে নানার বাড়ি নলছিটিতে। তিনি ভোলা জেলার জাতীয় পার্টির সভাপতি কেফায়েত উল্লাহর আপন ভাতিজা। এরই মধ্যে ঢাকায় তার হেফাজত থেকে একটি মার্সিডিজ গাড়ি জব্দ করা হয়েছে। বসবাস করেন ঢাকার কাঁঠালবাগানের ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে। আমানের বিত্তবৈভব দেখে তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা বিস্মিত।

কে এই বীথি
ই-অরেঞ্জের প্রতারণার বিষয়টি সামনে আসার পর ভুক্তভোগীদের ধারণা ছিল, বীথি আক্তার, যিনি প্রতিষ্ঠানটি কিনেছেন, তিনি সোহেলের স্ত্রী। তবে তদন্তে উঠে এসেছে বীথি আক্তার নামে সোহেলের একজন স্ত্রী থাকলেও আমান উল্লাহ যে বীথিকে নিয়ে ই-অরেঞ্জের মালিক হয়েছেন, তিনি আসলে সোহেলের স্ত্রী নন। এই বীথি আরেকজন। তার বয়স ২০-২৫ বছরের মধ্যে। তার গ্রামের বাড়ি খুলনায়। এই বীথির সঙ্গে আমান উল্লাহর দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। এখন সোহেলের স্ত্রী বীথি ছাড়াও আমানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত বীথিকে খোঁজা হচ্ছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পুলিশের গুলশান বিভাগের ডিসি মো. আসাদুজ্জামান বলেন, দুই বীথিকেই আমরা খুঁজছি। তাদের গ্রেপ্তার করা হলে ই-অরেঞ্জ নিয়ে আরও তথ্য পাওয়া যাবে। আর আমান উল্লাহ একজন বহুরূপী প্রতারক। তার অনেক সম্পদ থাকার তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে।

গ্রাহকের প্রায় এগারোশ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর আলোচনায় আসে ই-কমার্সভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জ। মূলত অরেঞ্জ বাংলাদেশ লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হলো ই-অরেঞ্জ। শুরু থেকেই অরেঞ্জ বাংলাদেশের সঙ্গে শেখ সোহেল রানার নাম আসে। তবে বরাবর তিনি তা অস্বীকার করে আসছিলেন।

প্রতিষ্ঠানটির কিছু নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অরেঞ্জ বাংলাদেশ নামের প্রতিষ্ঠান খুলতে যে টিআইএন সনদ নেওয়া হয়, সেখানে পরিচালক হিসেবে সোহেল রানার নাম আছে। ই-অরেঞ্জের দুটি ব্যাংক হিসাব থেকে তুলে নেওয়া ৩৪৯ কোটির টাকার হদিস নেই। দুটি বেসরকারি ব্যাংকে ই-অরেঞ্জের অ্যাকাউন্ট থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ২০ জুলাই পর্যন্ত একটি ব্যাংকের হিসাবে জমা পড়ে ৬২০ কোটি ৬৭ লাখ ২০ হাজার ৭২৯ টাকা। ব্যাংকের হিসাব বিবরণীর তথ্য অনুযায়ী, মোট ৬২০ কোটি ৪৪ লাখ ৭১ হাজার ৯৯২ টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। ওই হিসাব নম্বরে এখন মাত্র ২২ লাখ ৪৮ হাজার ৭৩৭ টাকা জমা আছে। আরেকটি ব্যাংক হিসাবে ৩০ জুন পর্যন্ত জমা পড়ে ৩৯১ কোটি ৬৭ লাখ ৬১ হাজার ৮৭৯ টাকা। সেখানেও জমা আছে দুই কোটি ৮৯ লাখ ৬৫ হাজার ৬১৯ টাকা। তুলে নেওয়া হয়েছে বাকি ৩৮৮ কোটি ৭৭ লাখ ৯৬ হাজার ২৫৯ টাকা।
সূত্র: সমকাল

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত