নবীকে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যকারী কে এই নূপুর শর্মা

| আপডেট :  ০৯ জুন ২০২২, ১০:৪৬  | প্রকাশিত :  ০৯ জুন ২০২২, ১০:৪৬

ইসলামের নবীকে নিয়ে ভারতে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিতর্কিত মন্তব্য দেশটির জন্য এক কূটনৈতিক দুঃস্বপ্ন তৈরি করেছে। দিন দশেক আগে টেলিভিশনের এক বিতর্ক অনুষ্ঠানে নূপুর শর্মার মন্তব্য ভারতে এবং ভারতের বাইরে বারোটির বেশি মুসলিম দেশে মুসলমানদের চরম ক্ষুব্ধ করেছে।

রোববার (৫ জুন) বিজেপি মিজ শর্মাকে দল থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে। মিজ শর্মার টিভি অনুষ্ঠানে করা ওই আপত্তিকর মন্তব্যের স্ক্রিনশট টুইটারে শেয়ার করার জন্য দল দিল্লিতে তাদের মিডিয়া শাখার প্রধান নাভিন কুমার জিন্দালকেও দল থেকে বহিষ্কার করেছে।

এক বিবৃতিতে বিজেপি বলেছে, তাদের দল কোন সম্প্রদায় বা ধর্মকে হেয় করে বা অপমান করে এমন কোন আদর্শের বিরুদ্ধে এবং তারা আরও বলেছে যে তারা এ ধরনের দর্শন বা ব্যক্তিকে সমর্থনও করে না।

মুসলিম দেশগুলোর ক্ষোভ প্রশমন করার চেষ্টায় ভারতীয় কূটনীতিকরা বলছেন, এসব মন্তব্য সরকারের অবস্থানকে প্রতিফলিত করে না এবং এগুলো পার্টির ভেতরকার কোন ব্যক্তির মতামত নয়।

কিন্তু অনেকেই যেটা স্পষ্ট করে দিচ্ছেন সেটা হল – মিজ নূপুর শর্মা পার্টির ”বাইরের কেউ” নন, তিনি রীতিমত দলের ভেতরকার গুরুত্বপূর্ণ একটা কণ্ঠ।

কে এই নূপুর শর্মা : দল থেকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার হওয়ার আগে পর্যন্ত ৩৭ বছর বয়সী এই আইনজীবী ছিলেন “বিজেপির সরকারি মুখপাত্র”, যিনি ছিলেন দলের উঠতি এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় একজন মুখপাত্র, যিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সরকারের প্রতিনিধিত্ব করতে এবং সরকারের পক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য দেবার জন্য রাতের পর রাত টেলিভিশনের বিতর্ক অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছেন।

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়ার সময় মিজ শর্মা তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করেন ২০০৮ সালে। তখন তিনি হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ আন্দোলনের ছাত্র শাখা অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি)-এর ছাত্র ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হবার মাধ্যমে রাজনীতিতে ঢোকেন।

যেভাবে হয়ে উঠলেন বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র : লন্ডনের স্কুল অফ ইকনমিকস থেকে আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক আইন বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি পাশ করে ২০১১ সালে ভারতে ফেরার পর রাজনীতির জগতে তার দ্রুত উত্থান হতে থাকে।

সুবক্তা এবং রূঢ়ভাষী মিজ শর্মা ইংরেজি এবং হিন্দি দুই ভাষাতেই দক্ষতা এবং দৃঢ়তার সাথে তার মতামতের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বিজেপির কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ২০১৩ সালে দিল্লি বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপির মিডিয়া কমিটিতে তাকে গুরুত্বপূর্ণ একটা পদ দেওয়া হয়।

এর দু’বছর পরে যখন নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তখন তিনি ছিলেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের বিপক্ষে বিজেপির প্রার্থী।

কেউ আশা করেনি ওই নির্বাচনে তিনি মি. কেজরিওয়ালকে হারিয়ে দেবেন। তবে ওই নির্বাচনের জন্য তার ব্যাপক উদ্দীপনামূলক প্রচারাভিযান তাকে দলে আরও সামনের সারিতে নিয়ে আসে।

তিনি দিল্লিতে দলের সরকারি মুখপাত্র নিযুক্ত হন এবং ২০২০ সালে তাকে বিজেপির “জাতীয় মুখপাত্র” করা হয়।

টিভিতে পরিচিত মুখ : গত কয়েক বছরে ভারতের টিভি দর্শকদের কাছে অতি পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছিলেন নূপুর শর্মা। বেশিরভাগ সন্ধ্যাতেই টিভি ছাড়লে টিভির পর্দায় শোনা যেত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে উচ্চ কণ্ঠে তার চিৎকার এবং বিরোধী রাজনীতিকদের কোণঠাসা করতে নানা কৌশলের ব্যবহার- এমনকি তাদের প্রতি গালিগালাজ।

তার সমর্থকদের সম্প্রতি টুইটারে শেয়ার করা একটি ছোট ক্লিপে তাকে একজন প্যানেলিস্টকে উদ্দেশ্য করে বলতে শোনা যায় আপনি একজন “ব্লাডি হিপোক্রিট অ্যান্ড অ্যা লায়ার (ভণ্ড ও মিথ্যাবাদী) এরপর তিনি তাকে বলেন “শাট আপ”। এই ভিডিও ক্লিপটি ব্যাপক শেয়ার হয়।

নূপুর শর্মা যখন টুইটারে ওই ক্লিপটি শেয়ার করেন, তখন টুইটার প্ল্যাটফর্মে তার পাঁচ লাখের বেশি অনুসারীর মধ্যে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তার সমর্থকরা তার ভূয়সী প্রশংসা করেন। তাকে তারা আখ্যা দেন “একজন নারী সিংহ, এবং নির্ভীক ও কঠিন একজন লড়াকু”।

নূপুর শর্মাকে বরখাস্ত করার পর দেয়া এক বিবৃতিতে মিজ শর্মা লেখেন যে তিনি “নিঃশর্তভাবে” তার মন্তব্য প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। তবে তিনি ওই মন্তব্য করার পেছনে একটা যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করেন এই বলে যে ওই অনুষ্ঠানে “হিন্দুদের দেবতা শিবকে অনবরত যেভাবে অপমান আর অসম্মান করা হচ্ছিল, তার জবাব দিতে তিনি ওই মন্তব্য করেছেন।

জ্ঞানবাপী মসজিদ নিয়ে টিভিতে এক বিতর্ক অনুষ্ঠানে তিনি ওই অবমাননাকর মন্তব্য করেন।

জ্ঞানবাপী মসজিদ নিয়ে বিতর্ক : হিন্দুরা দাবি করছে পবিত্র বারাণসী শহরে এই মসজিদ বানানো হয় ষোড়শ শতাব্দীর এক হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের ওপর। তাদের দাবি – যে মন্দির ১৬৬৯ সালে ধ্বংস করেছিলেন মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব।

মসজিদের ভেতরে ভিডিও-র মাধ্যমে একটি জরিপ চালানোর জন্য আদালতের একটি রায় নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। ওই ভিডিওতে পাথরের একটি স্তম্ভ দেখা যায়। আবেদনকারীরা দাবি করেন ওটি একটি শিবলিঙ্গ- শিবের প্রতীক। কিন্তু মসজিদ কর্তৃপক্ষ জোর দিয়ে বলেন যে সেটি একটি পানির ফোয়ারা।

এই বিতর্ক নিয়ে শুনানি চলছে আদালতে। কিন্তু তার মধ্যেই এই দাবি আর পাল্টা দাবি নিয়ে টিভি চ্যানেলগুলোতে চলছে বিরামহীন বিতর্ক অনুষ্ঠান। এবং এসব অনুষ্ঠানে হিন্দু জাতীয়তাবাদী মতামতের প্রধান ও সোচ্চার প্রবক্তা হয়ে উঠেছেন নূপুর শর্মা।

এর মধ্যে ২৭শে মে-র এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে তিনি ইসলোমের নবীকে কটাক্ষ করে যেসব আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন তা এখন গলাধঃকরণ করা তার জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত