নেতৃত্বে আগ্রহী যুবকদের প্রতি শায়খ রাগিব সারজানির ১০ উপদেশ

| আপডেট :  ১৪ জুলাই ২০২২, ১২:১৪  | প্রকাশিত :  ১৪ জুলাই ২০২২, ১২:১৪

হে যুবক! তুমি কি ইসলামের সরল পথের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে চাও? সমগ্র মানব জাতিকে আলোর দিকে পথ দেখাবার স্বপ্ন দেখো? সর্বোপরি তুমি কি চাও যে, তোমার প্রতিপালক তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হন? তোমার উত্তর যদি হয় ‘হাঁ’ তাহলে তোমার করণীয় কী?

তোমাকে সঠিক পথে কদম রাখতে সহায়তা করবে এমন দশটি বিষয় তোমার সামনে উল্লেখ করছি। যেন রেখো হে যুবক! এই বিষয়গুলো জানার পূর্বে তুমি সমাজের একজন সাধারণ লোক। পক্ষান্তরে তুমি যদি এগুলো দিয়ে জীবন সাজাতে পারো তাহলে তুমিই যোগ্য নেতৃত্বের অধিকারী হবে। আর এর মাধ্যমে যদি তোমার অবস্থার পরিবর্তন ঘটে তাহলে-ইনশাআল্লাহ-জাতির অবস্থাও বদলে যাবে।

গোনাহ সম্পূর্ণরূপে বর্জন করা
কোন নেক কাজ করার অভ্যাস গড়ার আগে গোনাহ বর্জনের অভ্যাস করো। হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত রাসূল সা: বলেছেন, তোমাদের যে বিষয় থেকে নিষেধ করলাম তা থেকে সম্পূর্ণরূপে বেঁচে থাকো এবং যেসব বিষয়ের আদেশ করেছি তা যথাসম্ভব মেনে চলো। (বুখারি ও মুসলিম)

যে উম্মাহর ভাগ্য পরিবর্তনের স্বপ্ন লালন করে তার জন্য কখনোই সমীচিন নয় যে, সে গোনাহের মধ্যে নিমজ্জিত থাকবে, আল্লাহর রাস্তায় থেকে গোনাহের মধ্যে ডুবে থাকা এটা অকল্পনীয় আর এটাই সবচেয়ে বিপজ্জনক। এজন্য এখনই দৃঢ় সংকল্প করো যে, গোনাহের সাথে ফের জাড়াবে না। যদি তোমার গোনাহ হয় চোখের মাধ্যমে, কানের মাধ্যমে, জবানের মাধ্যমে, সঙ্গের মাধ্যমে অথবা যেভাবেই হোক, জেনো রেখো যে, দয়াময় প্রভুর নিকট তোমার খাঁটি তওবা তোমার জন্য একটি শুভ্র-সাদা পৃষ্টা উন্মুক্ত করে দিবে। এমন হবে যে, তুমি আজই পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হলে।

দ্বীনকে জানা
তোমার দ্বীন সর্বশ্রেষ্ঠ দ্বিন। এতে খেয়ালীপনা ও ধারণাপ্রসূত বিষয়ের কোন স্থান নেই। তোমার দ্বীন ইসলাম একটি শ্বাশত ধর্ম। এর সাথে কখনো বাতিল মিশ্রিত হওয়ার সুযোগ নেই, না সামনে থেকে কিংবা পশ্চাদ থেকে। তোমার দ্বিনে কোন ফাঁকফোঁকর নেই। দ্বিনে ইসলাম একটি অনন্য ও সুদৃঢ় ধর্ম।

যদি এমন হয় তোমার থেকে অনেক সময় হারিয়ে গেছে কিন্তু দ্বীন শিখতে ও জানতে পারো নি, তাহলে গোড়া থেকে দ্বীন শেখা আরম্ভ করো; আকিদা, ফিকহ, উত্তম চরিত্র এবং লেদদেনের ব্যাপারে শিক্ষাগ্রহণ করো। রাসূল সা:-এর জীবনচরিত পড়ো, সাহাবায়ে কেরাম ও ইসলামের অবিকৃত ও গৌরবময় ইতিহাস অধ্যয়ন করো। একইসাথে তুমি একটি দীর্ঘ সময় নাও এবং এরমধ্যে আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং তাঁর দ্বীনের পরিচয় ভালকরে রপ্ত করো। তোমার লেখাপড়া, ইলম অর্জন, প্রতিযোগিতা এবং আলাপ-আলোচনা সবকিছুই যেন আল্লাহকে জানা ও তাঁর দ্বিনকে চেনার জন্য হয়-এই লক্ষ্য স্থির করো।

মসজিদের সাথে হৃদয়কে বাঁধা
মসজিদ পৃথিবীতে আল্লাহর ঘর। মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তি মহান আল্লাহর জেয়ারত লাভে ধন্য হয়। সুতরাং তুমি কি চাওনা যে, প্রত্যহ অন্তত পাঁচবার তুমি আসমান সমূহ ও জমিনের স্রষ্টা, সব বাদশাহর বাদশাহ আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে? তোমার কি ইচ্ছা হয়না যে, তোমার সব সমস্যা এবং সংকট তাঁর কাছে বলবে এবং তাঁর কাছেই প্রয়োজন প্রার্থনা করবে?

তুমি যদি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে গিয়ে জামাতে আদায়ের অভ্যাস গড়ো, তাহলে এটা তোমার ইলম অর্জনে উৎসাহ সৃষ্টি করবে এবং জীবন ক্রমেই সুন্দর থেকে সুন্দরতর হয়ে উঠবে।

সবার সেরা হয়ে ওঠা
যেই মুসলিম যুবক উম্মাহকে পরিশুদ্ধ জীবনের পথ দেখাতে চায়, তার জন্য অবশ্যকর্তব্য হলো-বিশেষত পড়াশোনায় সে সবার সেরা হবে। কেননা, জাতি শুধু চিকিৎসক, প্রকৌশলী কিংবা শিক্ষক খোঁজে না; তাদের জন্য প্রয়োজন হলো-গবেষক চিকিৎসকের, উদ্ভাবক প্রকৌশলীর এবং বহুপ্রতিভাধর জ্ঞানী আলেমের। আর এর প্রত্যেকটা অর্জনেই পড়ালেখায় যথেষ্ঠ ভাল হতে হবে। তুমি নেতৃত্বের স্বপ্ন দেখো অথচ তুমি অলস-এটা অসম্ভব; বরং উন্নত উম্মাহ গঠনে তোমাকেও অতিউন্নত হতে হবে। নিজ জাতি ও উম্মাহকে নিয়ে তোমার যে চিন্তা-ফিকির কেয়ামতে এটা তোমার জন্য অফুরান কল্যাণ বয়ে আনবে। এর প্রতিদান গণনা করা যাবে না।

আত্মীতার বন্ধন আঁকড়ে রাখা
একজন সচেতন যুবক হিসেবে তোমার অন্যতম গুণ হবে, আত্মীয়তার সম্পর্ক আঁকড়ে রাখা। যার প্রকৃতিতে আত্মীয়-স্বজন ও আপনজনের প্রতি কল্যাণকামিতা নেই তার থেকে জাতি ও উম্মাহর জন্যও ভাল কিছু প্রত্যাশা করা যায় না। তোমার সবচেয়ে বড় আপনজন হলেন, পিতা-মাতা। ভুলক্রমেও যেন তোমার মুখ থেকে তাদের উদ্দেশ্যে ‘উফ’ শব্দটি বের না হয়, তোমার চোখ তাদের দিকে ক্রোধের দৃষ্টি নিক্ষেপ না করে কিংবা কোনভাবেই তারা যেন তোমার আচারণে অথবা ইশারা ইঙ্গিতে কষ্ট অনুভব না করে। কেননা, একজন মুসলিম যুবকের থেকে এরূপ আচরণ সমীচীন নয়। এ ছাড়া তোমার উপর অর্পিত অন্যান্য সব আত্মীয়ের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করো।

উত্তম সঙ্গী নির্বাচন
আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেছেন, ব্যক্তি তার সঙ্গীর দ্বিনদারির উপর বিবেচিত হয়। সুতরাং তোমাদের প্রতিটি ব্যক্তি যেন সঙ্গী নির্বাচনে খেয়াল রাখে। (তিরমিজি ও আবু দাউদ) তুমি এমন বন্ধু নির্বাচন করো যে তোমাকে বারবার আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তোমাকে একাকী থাকতে দেয় না। কেননা, শয়তান একজনের সাথে অবস্থান করে, একাধিক থেকে দূরে থাকে। হজরত ওমর রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেছেন, যে জান্নাতের সুখ-স্বচ্ছন্দ্য আশা করে সে যেন জামাতের সাথে লেগে থাকে।

সমকাল সম্পর্কে জানা
যে যুবক জাতির পরিবর্তন পরিকল্পনা করে অথচ তার নিকট সমকালের ধারণা নেই-এটাও হতে পারে না। সচেতন যুবক সর্বদা সময় সম্পর্কে অবগত থাকবে। তার দেশ, জাতি এবং গোটা বিশ্ব পরিস্থিতি খোলা বইয়ের মতো তার সামনে উন্মুক্ত থাকবে। মুসলিমবিশ্বের প্রতিটি ঘটনার দিকে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকবে। দেশ-বিদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এমনকি রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কেও সম্যক ধারণা রাখবে সে। ইরাক, আফগানিস্তান, কাশ্মীর এবং তুরস্কের বর্তমান পরিস্থিতি কি-এটাও যেন সে জানে। ইরান, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া, মালি, উজবেকিস্তান, আজারবাইজান এবং নাইজারের মতো মুসলিম দেশগুলোর সার্বিক অবস্থা কোন দিকে মোড় নিচ্ছে-সচেতন যুবক এটাও বলতে পারবে। রুয়ান্ডা, লাইবেরিয়া, কলাম্বিয়া, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং রাশিয়ার সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতিগুলো কি কি? ইহুদিরা কোন দিকে চক্রান্ত করছে? এগুলোও সে মাথায় রাখবে। এসব জানতে দৈনিক কিছু সময় তাকে পত্রিকা পড়তে হবে। এক্ষেত্রে ক্রীড়া ও শোবিজাঙ্গণের সংবাদ এড়িয়ে চলতে হবে। কেননা, জীবনের মূল্যবান সময় অপচয় করে এগুলো পড়ার সময় তার কাছে নেই। শুধুমাত্র সংবাদ এবং সংবাদের চ্যানেলের অনুসরণ করবে। সংগীত ও ফ্লিমের চ্যানেলের তো প্রশ্নই ওঠেনা।

শরীরচর্চা
শুরুতেই তোমাকে জানতে হবে, পত্রিকায় ক্রীড়াপাতা পড়া আর ক্রীড়াচর্চা করে উন্নত দেহ গঠন করা এবং শক্তিশালী হওয়া এক বিষয় নয়, এখানে বড় পার্থক্য আছে। একজন সচেতন যুবকের অন্যতম বৈশিষ্ট হলো-সে সুস্থ ও সুঠাম দেহের অধিকারী হবে। কেননা, জাতি ও উম্মাহ তোমার বিবেক বুদ্ধির মতো তোমার সুস্থ সবল দেহের প্রতিও মুখাপেক্ষী। কারণ, সবল শরীর ব্যতিত কার্যকরী জিহাদ অসম্ভব। এজন্য আমি আবারো উপকারী শরীরচর্চার মাধ্যমে উন্নত শরীর গঠনের তাকিদ দিচ্ছি। যেসব ক্রীড়াচর্চা তোমাকে গঠিত ও শানিত করবে-এগুলোর মধ্যে সাঁতার, তীরন্দাজ, আত্মরক্ষামূলক নানা কৌশল, ভারোত্তলন এবং অশ্বারোহণ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। অর্থাৎ তুমি এমন সব খেলাধূলা করো যা তোমাকে সবার থেকে আলাদা ও অনন্য করে তোলে। তবে খেয়াল রাখবে, এতেই যেন দীর্ঘ সময় ব্যয় না হয়। কেননা, শরীরচর্চা জীবনের অংশ, যার মাধ্যমে জীবনের লক্ষ্য ছোঁয়া সহজ হয়। এটিই জীবন নয়।

দ্বীনের প্রতি অন্যকে আহ্বান
যখন তুমি পবিত্র এই দ্বিনের স্বাদ ও মিষ্টতা অনুভব করতে শিখবে এবং নিজের উপর অর্পিত দ্বীনী দায়িত্বের মাহত্য বুঝতে পারবে, তখনই এর দিকে অন্যকে আহবান করা তোমার কর্তব্য। একথা মনে রাখবে, তুমি দ্বীন বোঝার আগে এরাই তোমার সঙ্গী ছিলো। এজন্য দ্বিনের মিষ্টতার দিকে অন্যকে আহবান করো, তুমি যে উৎকৃষ্ট জীবন লাভ করেছো সে সম্পর্কে তাকেও অবগত করো। এতে সে যদি আমল করে, তাহলে তুমিও তার অনুরূপ প্রতিদান লাভ করবে। আর তোমার অর্জিত সুখময় জীবনে এবং প্রতিদানে কোন কমতি আসবে না; বরং তাদের আমলেও তুমি সমপরিমাণ আজর ও প্রতিদান লাভ করবে। সুতরাং তোমাকে ভাবতে হবে, তোমার সঙ্গীদের নেক আমলের প্রতিদান তুমি অর্জন করবে কিনা? মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘আর তার চেয়ে কার কথা উত্তম যে আল্লাহর দিকে আহবান জানায় এবং সৎকাজ করে। আর বলে, অবশ্যই আমি মুসলিমদের অন্তর্ভূক্ত’। (সূরা ফুসসিলাত, আয়াত: ৩৩)

সময় নিয়ন্ত্রণ করা
উপরোল্লেখিত বিষয়গুলো যদি কোন পরিকল্পনা ও নিয়ম না মেনে করো, তাহলে কিছুতেই তা সম্পন্ন করতে পারবে না। যদি তোমার উপরের বিষয় সমূহ কল্যাণকর অনুভূত হয়, তাহলে সেগুলো বাস্তবায়নে তোমাকে অবশ্যই একটি সুদৃঢ় পরিকল্পনা সাজাতে হবে। মসজিদের জন্য কিছু সময়, চিন্তার জন্য কিছু সময়, ইসলামী বইপত্র অধ্যয়নের জন্য কিছু সময়, সাধারণ কিতাবাদির জন্য কিছু সময়, দেশ-বিদেশের খবরাখবর নেওয়ার জন্য কিছু সময়, আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে কিছু সময়, খেলাধুলার জন্য কিছু সময় এবং হালাল বিনোদনের জন্যও কিছু সময় তোমাকে নির্ধারণ করতে হবে।

এবং এক্ষেত্রে তোমাকে লক্ষ্য স্থির করে অগ্রসর হতে হবে। আগামী কয়েক ঘন্টা তোমার কি কাজ, আগামীকাল তুমি কি করবে, আগামী মাস এবং আগামী বছরে তোমার পরিকল্পনা কি এবং তোমার ভবিষ্যৎ জীবনের মূল লক্ষ্য কি-সেটাও তোমাকে স্থির করতে হবে। কেননা, তোমার মালিকানাধীন সবচেয়ে মূল্যবান হচ্ছে সময়। সুতরাং অত্যন্ত দামী এ সময়কে তুমি হেলায়-খেলায় অপচয় করতে পারো না। আর তোমার মূল সম্পদ হলো-তোমার জীবন। আর অচিরেই একটু একটু করে তোমার এ মূল্যবান জীবনও ফুরিয়ে আসবে। এজন্য সতর্ক হও এবং জীবনকে গড়ো। আল্লাহ তাওফিক দান করেন। আমিন

-ইসলাম স্টোরি থেকে অনুদিত

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত