পুঁজি ভেঙে খাওয়ার পাশাাপশি ব্যাংক ঋণের প্রতি ঝুঁকছে মানুষ

| আপডেট :  ২২ মার্চ ২০২২, ০৫:৫৯  | প্রকাশিত :  ২২ মার্চ ২০২২, ০৫:৫৯

করোনা মহামারী ও দ্রব্যমূল্যের জাঁতাকলে আয়ের পাশাপাশি ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে সাধারণ মানুষের। ফলে সংসার চালানোসহ নানা প্রয়োজনে ব্যাংক থেকে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ঋণ নেওয়ার প্রবণতা অনেক বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, করোনার পৌনে দুই বছরে ভোক্তা ঋণ বেড়েছে প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে গত বছরেই বেড়েছে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা।

এ সময়ে ক্রেডিট কার্ড ও স্যালারি অ্যাকাউন্টের বিপরীতে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। প্রবণতা বেড়েছে ব্যাংকে জমানো সঞ্চয় লিয়েন রেখেও। এ ছাড়া ফ্ল্যাট, টিভি, ফ্রিজ, এসি, কম্পিউটার ও আসবাবপত্র কেনার ক্ষেত্রেও ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বাড়ছে। সাধারণভাবে ভোক্তা ঋণ অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যবহৃত হয়। ভোক্তা ঋণ বাড়লে মূল্যস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কা থাকে।

এ কারণে ভোক্তা ঋণ নিয়ন্ত্রণের পক্ষে মত দেন অর্থনীতিবিদরা। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘করোনাকালে অনেক মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। অনেকের আয়ও কমেছে। কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় থেমে ছিল না। দীর্ঘদিনের ভোগব্যয়ের ন্যূনতম স্ট্যান্ডার্ড বজায় রাখার জন্য অনেকেই পুঁজি ভেঙে খাওয়ার পাশাাপশি ব্যাংক থেকে ঋণও

করেছেন। ভোক্তা ঋণ বৃদ্ধির সার্বিক চিত্র থেকে বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে।’ দেশে মূল্যস্ফীতির বর্তমান ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার পেছনে ভোক্তা ঋণের কিছুটা প্রভাব আছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বেসরকারি ব্যাংকের একজন শাখা ব্যবস্থাপক বলেন, ‘স্যালারি অ্যাকাউন্টের বিপরীতে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ আগের চেয়ে বেড়েছে। সংসারের প্রয়োজনে সঞ্চয় স্কিম ও এফডিআর লিয়েন রেখেও ঋণ নিচ্ছেন অনেকে। বাড়তি ব্যয়ের চাপে ক্রেডিট কার্ডের ঋণের সীমা দ্রুত খরচ করে ফেলার ঘটনাও ঘটছে। ঋণ নিয়ে অনেকে হাসপাতালের বিলও দিচ্ছেন। কিন্তু আয় না বাড়ার কারণে ঋণের কিস্তিও সঠিক সময় ফেরত দিতে পারছেন না অনেকেই।’

জানা যায়, কয়েক বছর ধরেই ভোক্তা ঋণে খানিকটা কড়াকড়ি আরোপ করে আসছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে করোনার কারণে স্থবির অর্থনীতিতে চাহিদা তৈরিতে ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর ভোক্তা ঋণের বিপরীতে ব্যাংকের প্রভিশন সংরক্ষণে ছাড় দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগে সব ধরনের অশ্রেণিকৃত ভোক্তা ঋণে ৫ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হতো, যা ওই সময় কমিয়ে ২ শতাংশ করা হয়। এ ছাড়া ক্রেডিট কার্ড ছাড়া অন্য ভোক্তা ঋণে সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। এর পর থেকে ভোক্তা খাতে ঋণ বিতরণে বেশ আগ্রহ দেখাচ্ছে ব্যাংকগুলো। অন্যদিকে সুদের হার কমে আসায় সংকট উত্তরণে সাধারণ মানুষও এই ঋণ নিতে উৎসাহিত হচ্ছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘করোনার পর অর্থনৈতিক কর্মকা-ে গতি ফেরানোই ছিল মূল কাজ। তাই অর্থনীতিতে চাহিদা তৈরিতে ভোক্তা ঋণের প্রভিশন সংরক্ষণে কিছুটা ছাড় দেওয়া হয়। তাই ভোক্তা খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি নিয়ে আমরা চিন্তিত নই। বিষয়টি আমাদের নজরদারিতে আছে। তা ছাড়া ভোক্তা ঋণ বাড়ার কারণেই মূল্যস্ফীতি বেড়েছে এমনটিও নয়। বরং মূল্যস্ফীতি যেটা বেড়েছে, সেটা আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও সরবরাহ ঘাটতির কারণে। তাই এখনই ভোক্তা ঋণে কড়াকড়ি আরোপের কথা ভাবছে না বাংলাদেশ ব্যাংক।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক খাতে ভোক্তা ঋণের পরিমাণ ছিল ৮১ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা, যা ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে দাঁড়িয়েছে ৯৫ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। ফলে গত এক বছরে ভোক্তা খাতে ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৩ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধির হার প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ। অথচ একই বছরে বেসরকারি খাতে সার্বিক ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। মূলত দেশে করোনার আঘাত আসার পর থেকেই ব্যক্তিগত ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। যেমন ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ভোক্তা ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৮ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। সেই হিসাবে করোনার গত পৌনে দুই বছরে ভোক্তা খাতে ব্যাংকের ঋণ বিতরণ বেড়েছে প্রায় ২৭ হাজার ১৬৫ কোটি টাকা। শুধু ভোক্তা ঋণের পরিমাণই নয়, এ সময়ে ভোক্তা ঋণের গ্রাহকও বেড়েছে বেশ। ২০২০ সালের মার্চে ভোক্তা ঋণের মোট গ্রাহক ছিল ২৫ লাখ ৯ হাজার ৮৯৪ জন, যা ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বেড়ে হয়েছে ২৮ লাখ ১০ হাজার ৪৭২ জন। এ হিসাবে করোনার গত ২১ মাসে ভোক্তা ঋণের গ্রাহক বেড়েছে ৩ লাখ ৫৭৮ জন। এর মধ্যে গত বছরই বেড়েছে ২ লাখ ৩৭ হাজার ৪৮ জন।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘করোনার কারণে মানুষের আয়ে একটা প্রভাব পড়েছে। সেগুলো কাভার করতে অনেকে ঋণ নিয়েছেন। আবার ঋণ নিয়ে অনেকে ভোগ্যপণ্যও কিনেছেন। ফ্ল্যাট কেনায়ও ভোক্তা ঋণের চাহিদা বেড়েছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত ১ লাখ ৬৫ হাজার ৩৮৬ জন চাকরিজীবী স্যালারি অ্যাকাউন্টের বিপরীতে ঋণ ৪ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। গত ডিসেম্বর শেষে এমন ঋণ নেওয়া চাকরিজীবীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ২২ হাজার ২৩৮ জন। আর ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ১৪ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা।

করোনাকালে ব্যাংকে জমানো সঞ্চয়ী হিসাবের বিপরীতে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বেড়েছে ৩১৫ কোটি টাকা। এ সময়ে সঞ্চয়ী হিসাবের বিপরীতে ঋণ নেওয়া ব্যক্তির সংখ্যা ১১ হাজার ৮৬৫ জন থেকে বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৯৯ হাজার ৩৫৩ জন। একই সময়ে স্থায়ী আমানতের বিপরীতে ঋণ নেওয়া ব্যক্তির সংখ্যা না বাড়লেও ঋণের পরিমাণ বেশ বেড়েছে। ২০২০ সালের মার্চে স্থায়ী আমানতের বিপরীতে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ২ কোটি টাকা, যা গত বছরের ডিসেম্বরে বেড়ে হয়েছে ১৫ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। করোনাকালে শিক্ষার ব্যয়নির্বাহে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ ৫৩৪ কোটি টাকা বেড়েছে। এ সময়ে শিক্ষার ব্যয় মেটাতে ঋণ নেওয়া ব্যক্তির সংখ্যা বেড়েছে ২ হাজার ২১৫ জন।

ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতেও ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বেশ বেড়েছে। ২০২০ সালের মার্চে ক্রেডিট কার্ডের বিপরীতে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বরে তা বেড়ে হয়েছে ৬ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা। এ হিসাবে করোনার পৌনে দুই বছরে ক্রেডিট কার্ডে ব্যাংকের ঋণ বেড়েছে প্রায় ১ হাজার ৪৭৭ কোটি টাকা। আর ক্রেডিট কার্ডের গ্রাহক ১ লাখ ৪৭ হাজার ৯১৯ জন থেকে বেড়ে হয়েছে ১১ লাখ ১৯ হাজার ৩৩৫ জন।

বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য তথা টিভি, ফ্রিজ, এসি, কম্পিউটার ও ফার্নিচার ক্রয়েও ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বেড়েছে করোনাকালে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনার শুরুর দিকে ২০২০ সালের মার্চে এসব ভোগ্যপণ্যের গ্রাহক ছিল ৬ লাখ ৮৮ হাজার ৯২২ জন, যা ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বেড়ে হয়েছে ৭ লাখ ২৬ হাজার ৭৫৫ জন। এ সময়ে এসব পণ্য কেনা বাবদ ঋণ বিতরণ বেড়েছে প্রায় ৫ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা। করোনাকালে ঋণ নিয়ে ফ্ল্যাট কেনার পরিমাণও বেড়েছে। এ সময়ে ফ্ল্যাট কেনায় ব্যাংকগুলোর ঋণ বেড়েছে প্রায় ৬ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। ফলে গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ফ্ল্যাট কেনা খাতে ব্যাংকের ঋণ বেড়ে হয়েছে ১৮ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা। ৪৭ হাজার ৬৮২ জন গ্রাহক এই ঋণ নিয়েছেন।

সূত্র: দৈনিক আমাদের সময়

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত