ফুল বিক্রি করে জীবন আর চলছে না বৃদ্ধাদের

| আপডেট :  ২২ জুন ২০২২, ১২:১৮  | প্রকাশিত :  ২২ জুন ২০২২, ১২:১৮

রাস্তার পাশে ডালায় সাজানো বর্ণিল ফুল। বিভিন্ন রঙের ফুল দিয়ে ছোট ছোট ভাগ করে রাখা হয়েছে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া নারীরা বসেছেন এই ফুলের পসরা নিয়ে। ডালার ফুলগুলো যত রঙিন, ফুল নিয়ে বসা নারীদের জীবন ততই ধূসর। ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে তাদের ফুলের দাম না বাড়লেও জীবন বাঁচিয়ে রাখার প্রত্যেকটি অনুষঙ্গ ক্রয় ক্রমশ ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। জীবনের ক্রান্তিলগ্নে সন্তানরা যখন আর খোঁজ নেন না, তখন ঝোপঝাড় থেকে কুঁড়ানো ফুল বিক্রি করেও নেভাতে যাওয়া তাদের জীবন আর বইয়ে বেড়াতে পারছেন না। দীর্ঘকাল ধরে পূজার জন্য ফুল বিক্রি করা ময়মনসিংহ নগরীর একটি ব্যতিক্রমী হাটের নারীদের সঙ্গে মঙ্গলবার সকালে আলাপে উঠে আসে এ বেদনার চিত্র।

নগরীর কে.বি ইসমাইল রোডের প্রাক্তন পৌরসভা ভবনের সামনে রয়েছে পৌর কাঁচাবাজার। কাঁচাবাজারটি ঘেঁষে প্রতিদিন পূজার ফুল নিয়ে বসেন একদল নারী। রাস্তার পাশে সারি করে নারীরা ভোর থেকে বসেন বর্ণিল ফুলের পসরা সাজিয়ে। বেলা ৯টা পর্যন্ত বেচাকেনা চলে। এই ফুল দেবতার অঞ্জলি দেওয়ার জন্য নিয়ে যান ভক্তরা।

নগরীতে বসবাসরত সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ঠাকুরকে অঞ্জলি দিতে প্রতিদিন ভোরে ছুটে আসেন ফুলের জন্য। শুধু হরেক রঙের ফুল নয়, বেলপাতা, তুলসীপাতা, দূর্বাঘাস, আমপাতা সবই বিক্রি হয় এখানে। এক ভাগ পূজার ফুল বিক্রি হয় মাত্র ১০ টাকায়। শহরের বসবাসকারীরা নিজ আঙিনায় ফুলের আবাদ করতে না পারায় অঞ্জলির জন্য ফুল-পাতা কিনতে যান ওই হাটে। কিন্তু গ্রামের বাড়ির আঙিনায় প্রতি বাড়িতেই ফুল গাছ থাকায় তারা সে ফুল দিয়ে পূজার কাজ সেরে ফেলেন। তাই হাটে কোনোদিন ক্রেতার আগমন বেশি, কোনোদিন কম। যেদিন কম হয়, সেদিন ফুল মন্দিরে দিয়ে দিয়ে শূন্য হাতে ঘরে ফেরেন তারা।

রাস্তার পাশে ফুল বিক্রি করতে কেউ সখের বসে বসেননি। বিক্রেতা নারীদের অধিকাংশের বয়স ৫০ থেকে ৭০ এর অধিক। সন্তানদের কাছে বাড়তি ঝামেলা হওয়ায় বৃদ্ধ বয়সে জীবন জাগিয়ে রাখার পথ হিসেবে বেছে নিয়েছেন পূজার জন্য ফুল বিক্রি করা। বেশ কয়েকজন ফুল বিক্রেতা নারীর সঙ্গে আলাপ করে এমনটিই জানা গেছে।

দুই ছেলেকে অবলম্বন করে জীবন কাটাবেন ভেবেছিলেন কল্পনা রানী ঘোষ (৭০)। অন্তত ৩০ বছর আগে স্বামী জ্যোতিন্দ্র ঘোষ মারা যাওয়ার পর ছেলের ভিটেমাটি সব বিক্রি করে দেওয়া হয়। মানুষের বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করে বয়সকালে সন্তানদের পাশে ছিলেন। কিন্তু সেই ছেলেরাও মাকে ফেলে চলে যান। এখন কল্পনা জুবলিঘাটে এক মুসলিম নারীর বাসায় কাজ করে দেবার শর্তে বসবাস করতে পারেন। আর নিজের ভাতের জোগান দিতে ফুল বিক্রি করেন। গত ৫ বছর ধরে ফুল বিক্রি করে নিজের জীবন চালিয়ে যাচ্ছেন। কল্পনা বলেন, ‘একদিন বেচতে পারলে আরেকদিন পারি না। বেচতে পারলে খাইতে পারি। নাইলে মাইনস্যের কাছে হাত পাতি খাওনের লাইগ্যা’।

নগরীর কেওয়াটখালী রেলসেতু এলাকায় ব্র‏হ্মপুত্র নদ ঘেঁষে সরকারি জমিতে ঘর বানিয়ে বসবাস করেন ৭০ বছর বয়সী কমলা রানী বর্মন। তার স্বামী অনাথ বর্মণ (৯৫) শয্যাশায়ী। আগে মাছ বিক্রি করলেও কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন অন্তত ১৫ বছর হল। দুই ছেলে ও চার মেয়ে থাকলেও কেউ বৃদ্ধ বাবা-মায়ের খোঁজ রাখেন না। দুই ছেলে অমল ও নির্মল বর্মন জেলে।

কমলা রানী বর্মন জানান, অন্তত ২০ বছর ধরে রাস্তার পাশে বসে ফুল বিক্রি করছেন তিনি। সকালে ফুল বিক্রি করে এখন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা আয় করেন। পরে ছুটে যান ব্র‏হ্মপুত্র পাড় ঘেঁষা বিভিন্ন ঝোপ-জঙ্গলে। সেখান থেকে কিছু ফুল সংগ্রহ করে এবং বাজার থেকেও কিছু ফুল কিনে সকালে হাটে বসেন বিক্রির জন্য। শুরুতে পাঁচ টাকা ভাগ ফুল বিক্রি করলেও এখন ১০ টাকায় বিক্রি হয়। এই ফুল বিক্রি করেই তাদের ভাতের জোগান হয়। স্বামীর চিকিৎসার ব্যবস্থাও হয়।

নগরীর স্টেডিয়াম এলাকার বাসিন্দা রাজ কুমারী গোয়ালা। ষাটোর্ধ্ব রাজ কুমারীও অন্তত ৫০ বছর ধরে ফুল বিক্রি করছেন। রাজ কুমারী বলেন, খুব ছোট বেলা থেকেই ফুল বিক্রি করি। তিন ছেলে তিন মেয়ে। জীবনের সুখের দিশা কোনোদিন দেখিনি। কষ্টেই দিন যাচ্ছে। যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, তাতে জীবন বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। গত দেড় বছর হল খাসির মাংস কিনতে পারেননি তিনি। সপ্তাহে ৭০০ টাকার ওষুধ লাগে তার। একদিন চাল কিনলে বাকি দিনের টাকা জমিয়ে ওষুধ কিনে খান। কোনোদিন ফুল বিক্রি না হলে সেই ফুল মন্দিরে দিয়ে চলে যেতে হয়।

নগরীর পুলিশ লাইন্স এলাকার বাসিন্দা ফুলবাসি রাজভর (৮৫)। তার স্বামী গত হয়েছেন বহুবছর হল। দুই ছেলে ও দুই মেয়ে থাকলেও বৃদ্ধ বয়সে পেটের ক্ষুদা মেটাতে ফুল বিক্রি করতে বসতে হয়েছে রাস্তায়। গত ১৪ বছর ধরে ফুল বিক্রি করতে হচ্ছে তাকে। অশ্রুসজল ফুলবাসি বলছিলেন, তার শেষ জীবন ফুলের মতো হল না।

হাট থেকে ফুল কিনতে আসা নগরীর আমপট্টি এলাকার বাসিন্দা মানিক দেবনাথ বলেন, এই হাট থেকে বছরখানেক ধরে ফুল কিনি। ১০ টাকার ফুল নিয়ে অঞ্জলি দিই। বৃদ্ধ নারীদের দেখে খুব কষ্ট হয়। কিন্তু তাদের কিছুই করার নেই। মাঝে মাঝে পুলিশ বা সিটি করপোরেশনের লোকজন এসে তাদের সরিয়ে দেয়। বৃষ্টিতে ভিজে কষ্ট করে ফুল বিক্রি করে বৃদ্ধা নারীরা, যা দেখে আরও কষ্ট হয়।

নগরীর বলাশপুর কবরখানা এলাকার মঞ্জু বসাক বলেন, গ্রামের বাড়িতে ফুল বাগান করা গেলেও বাসা-বাড়িতে তা করা যায় না। তাই এখান থেকে কিনে নিয়ে অঞ্জলি দিই। গত পাঁচ বছর ধরে এই হাট থেকে ফুল নিই। তবে বর্তমান দ্রব্যমূল্যের বাজারে ফুল বিক্রি করে বৃদ্ধ বয়সে স্বাভাবিক জীবন চালানো কঠিন তাদের।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত