ফেসবুকে ‘হা-হা’ রিঅ্যাক্টের জেরে গাজীপুরে খু’ন

| আপডেট :  ১৫ মার্চ ২০২২, ০৭:৩৮  | প্রকাশিত :  ১৫ মার্চ ২০২২, ০৭:৩৮

মাত্র ১৬ মাস বয়সী ফুটফুটে শিশুকন্যা ফারিয়া। আধো আধো উচ্চারণে বাবা ডাকতে শুরু করেছে সে। বাবাকে কাছে পেলে তার কোলে উঠতে মরিয়া হয়ে ওঠে মেয়ে ফারিয়া। বাবাও একমাত্র মেয়েকে অনেক আদর করতেন। বাইরে থেকে বাড়ি ফিরলে ফারিয়া বাবার হাতে চেয়ে তাকে মজাদার কোনো খাবারের আশায়।

গত শনিবার রাতে রাত ১১টার দিকে ওয়াজ মাহফিল থেকে বাড়ি ফিরার পথে মেয়ে ফারিয়ার জন্য কয়েকটি সিঙারা কিনে নিতে ভুলেননি বাবা ফারুক হোসেন। কিন্তু সে সিঙারা নিয়ে বাবা বাড়ি ফিরতে পারেননি, ফিরেছে তার লাশ। সিঙারাগুলো পড়ে ছিল ঘটনাস্থলের অদূরেই। রাতে গাজীপুরের কাপাসিয়ার দক্ষিণগাঁও চরপাড়া গ্রামে এক তরুণীর ফেসবুক পোস্টে ‘হা-হা’ রিঅ্যাক্ট দেওয়া নিয়ে বিতর্কের জেরে প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত ৩ কিশোরের একজন ফারুক হোসেন।

সরজমিনে দেখা যায়, ফারুকের বাড়িতে শত শত মানুষ ছুটে আসছে তার শিশুকন্যা ফারিয়াকে দেখার জন্য। সে সবার দিকে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে এদিক-সেদিক খুঁজতে থাকে বাবাকে। এ দৃশ্য দেখে ছেলের শোকে পাগল দুলালী বেগম অনবরত কান্না করছেন। আর ফারুকের বাবা আলম হোসেনের দিশেহারা অবস্থায় দু চোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরছে।

শিশু ফারিয়ার মা নূরজাহান জানান, তার বাবার বাড়ি উপজেলার কড়িহাতা ইউনিয়নের পেচরদিয়া গ্রামে। ২ বছর তিন মাসের মাথায় শেষ হয়ে গেল তাদের দাম্পত্য জীবন। পারিবারিক সিদ্ধান্তে নির্মাণশ্রািমক ফারুক হোসেনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে বাড়ি ফিরে ফারুক বাড়তি আয়ের জন্য সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত একটি চায়ের দোকান পরিচালনা করতেন।

তিনি আরও জানান, দিনরাত পরিশ্রম করে সৎভাবে জীবনযাপন করছিলেন তার স্বামী। দুই ভাই এক বোনের পরিবারে বড় ছেলে হিসেবে তিনি পুরো দক্ষতার সঙ্গেই পরিবার পরিচালনা করছিলেন। নিজেদের সুখের সংসার গড়তে একটি টিনশেড বিল্ডিংও তৈরি শুরু করেছিলেন তিনি। স্বামীর উপার্জনের ওপর যে পরিবার নির্ভরশীল সেখানে শিশু ফারিয়াকে নিয়ে তার কীভাবে সংসার চলবে এখন?

নূরজাহান জানান, শনিবার রাত ১১টার দিকে ফারুক হোসেন ওয়াজ মাহফিল থেকে বাড়ি ফিরার পথে ঘটনাস্থলে পৌঁছে হট্টগোল দেখতে পান। এ সময় কিছু অপরিচিত যুবককে সেখানে কী হয়েছে, জানতে চাইলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছুরি দিয়ে তারা ফারুকের পেটে উপর্যপুরি আঘাত করে। পরে তাকে মনোহরদী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। রোববার রাত ১০টার দিকে জানাজা শেষে ফারুকের লাশ দাফন করা হয়।

প্রসঙ্গত, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের সূত্রে পরিচয় হয় মারিয়ার (২২) সঙ্গে নাঈমের (১৮)। কিছু দিন আগে মারিয়া ফেসবুকে একটি ছবি পোস্ট করলে নাঈম এতে হা-হা রিয়েক্ট দেয়। এ নিয়ে ফেসবুক ও ইমোতে তাদের নানা উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। এর পর মারিয়ার ছবি ব্যবহার করে নাঈম ‘টিকটক ভিডিও’ বানিয়ে তার কাছে পাঠিয়ে দেয়। এ নিয়ে তাদের মাঝে চলে চরম উত্তেজনা।

এ ঘটনায় মারিয়া ও তার স্বামী ক্ষুব্দ হয়ে নাঈমকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিলে সে তার অবস্থান জানান দিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। পরে দলবল নিয়ে মারিয়া ও তার স্বামী গত শনিবার রাত ১১টার দিকে কাপাসিয়ার আড়ালবাজারের পূর্ব পাশে দক্ষিণগাঁও চরপাড়া গ্রামে এসে হামলা চালায়। এতে নাঈমসহ তিনজন নিহত হন। এ সময় আরও ছয়জন আহত হন।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ফেসবুকে ছবিতে হা-হা রিয়েক্টের জেরেই উপজেলার সনমানিয়া ইউনিয়নের চরআলীনগর গ্রামের মারিয়া ও তার স্বামী জাহিদের সঙ্গে নাঈমের বিরোধ দেখা দেয়। পরবর্তী সময়ে নাঈম টিকটকে মারিয়ার ছবি ব্যবহার করলে সে বিরোধ চরম আকার ধারণ করে।

এর আগে শনিবার রাতে এ নিয়ে ইমোতে কথা কাটাকাটি হলে মারিয়া ও তার স্বামী পার্শ্ববর্তী মনোহরদী উপজেলার দৌলতপুর এলাকার ৮-১০ জন যুবককে নিয়ে দক্ষিণগাঁও গ্রামে আলম আহমেদের মসজিদের সামনে এসে নাঈম ও অন্যদের ওপর হামলা চালায়। তাদের ডাক চিৎকারে আশপাশের লোকজন ছুটে আসলে উভয় পক্ষ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এ সময় দেশীয় অস্ত্রের আঘাতে উভয় পক্ষের অন্তত নয়জন গুরুতর আহত হয়।

মুমূর্ষু অবস্থায় আহতদের কয়েকজনকে উদ্ধার করে মনোহরদী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক নাঈম হোসেন (১৮) ও ফারুক হোসেনকে (২৬) মৃত ঘোষণা করেন এবং অন্যদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন। নিহত নাঈম দক্ষিণগাঁও চড়পাড়া এলাকার মৃত আলম হোসেনের এবং ফারুক হোসেন একই গ্রামের আলম হোসেনের ছেলে। পরে রোববার সকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গুরুতর আহত রবিনের (১৬) মৃত্যু হয়।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত