বরখাস্তের খবর পেয়েই প্রাথমিকের প্রধান শিক্ষকের মৃত্যু

| আপডেট :  ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০২:১৮  | প্রকাশিত :  ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০২:১৮

লক্ষ্মীপুরে স্কুল কমিটির সভাপতি ও নবনির্বাচিত চেয়ারম্যানকে সংবর্ধনার মিথ্যা অভিযোগে প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসেন মোর্শেদকে সাময়িক বরখাস্ত করেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা। এ খবর শুনে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ওই শিক্ষক।

এলাকাবাসী জানান, লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার পূর্ব চররুহিতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে সুনামের সঙ্গে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছিলেন আনোয়ার হোসেন মোর্শেদ। গত ২৬ ডিসেম্বর ওই বিদ্যালয়ের সভাপতি মাহফুজুর রহমান পার্শ্ববর্তী ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর গত ২১ জানুয়ারি বিদ্যালয়ে যান তিনি। তখন সরকারি বিধিনিষেধ মেনে বিদ্যালয়ে মা সমাবেশ ও করোনা প্রতিরোধে সচেতনতামূলক সভা হচ্ছিল।

সমাবেশকে সংবর্ধনা সভা বানিয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মুনছুর আলী চৌধুরী সহকারী শিক্ষকদের কাছ থেকে ২৫ জানুয়ারি একটি অভিযোগ নিতে বলে। পরে তা তদন্ত করে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাকে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।

সে অনুযায়ী প্রধান শিক্ষককে কোনো শোকজ নোটিশ না দিয়ে ২৭ জানুয়ারি বিদ্যালয়ে যান উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা ফরিদ আহমেদ। ওই দিনেই বিদ্যালয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন প্রধান শিক্ষক আনোয়ার হোসেন মোর্শেদ। পরদিন পরিবারের সদস্যরা প্রধান শিক্ষককে চিকিৎসার জন্য ঢাকা নিয়ে যান। এরই মধ্যে দুই কার্যদিবসের মধ্যে গতকাল সোমবার বিকেলে প্রধান শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা। এ খবর শুনে রাত ৮টার দিকে ঢাকার একটি হাসপাতালে মারা যান তিনি। সাময়িক বরখাস্ত করার সময় সরকারি কোনো নিয়মনীতি মানা হয়নি। নিজের মনগড়াই প্রধান শিক্ষককে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

নিহত ব্যক্তির বড় ছেলে জামিল মাহমুদ বলেন, ‘আত্মপক্ষ সমর্থন ও কোনো কারণ দর্শানো নোটিশ ছাড়াই তড়িঘড়ি করে মিথ্যা ঘটনাকে সত্য বানিয়ে পরিকল্পিতভাবে প্রতিবেদন তৈরি করে আমার বাবাকে শাস্তি দেওয়া হয়। এ খবর শুনে হাসপাতালে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন এবং মারা যান তিনি। এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।’

মেয়ে জান্নাতুল ফেরদাইস অভিযোগ করেন বলেন, ‘আমার বাবাকে মানসিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে। অভিযুক্ত শিক্ষা কর্মকর্তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। যেন এভাবে আর কোনো বাবাকে হারাতে না হয়।’

জান্নাতুল ফেরদাইস আরও বলেন, ‘উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা ফরিদ উদ্দিন অফিসে আমার বড় বোনকে ডেকে নিয়ে জোর করে বাবার বরখাস্তের আদেশ দেন। সেই সঙ্গে বিষয়টিও জানাতে বাধ্য করেন। দুই দিনের মধ্যে তড়িঘড়ি ও কারণ দর্শানোর নোটিশ ছাড়াই পরিকল্পিতভাবে এ শাস্তি দেওয়া হয়। বরখাস্তের বিষয়টি শুনে জ্ঞান হারিয়ে দুনিয়া ছেড়ে চলে যান আমার বাবা।’

এ বিষয়ে সদর উপজেলা শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও শাকচর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক মো. হারুনুর রশিদ বলেন, ‘আনোয়ার মোর্শেদ ছিলেন ভালো মানের একজন প্রধান শিক্ষক। তাঁর এভাবে মৃত্যু হবে সেটা কল্পনা করা যায় না। মিথ্যা কল্পকাহিনি তৈরি করে তাঁকে শাস্তি দেওয়া আইন মেনে হয়নি। এটিকে একটি হত্যাকাণ্ড বলে দাবি করছি।’

সাবেক প্রধান শিক্ষক আরও বলেন, এর আগেও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার মানসিক নির্যাতনে আরও দুই শিক্ষক হৃৎক্রিয়া বন্ধ হয়ে একইভাবে মারা যান। ওই শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শিক্ষকদের সঙ্গে অসদাচরণ করার অভিযোগ রয়েছে। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে সঠিক বিচারের দাবি করছি। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী।

স্কুল ম্যানেজিং কমিটির নেতা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘চেয়ারম্যানকে কোনো সংবর্ধনা দেওয়া হয়নি। উল্টো প্রধান শিক্ষকের এ শাস্তির বিষয়টি লজ্জাজনক। এটি কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনের কাছে জোর দাবি করছি।’

সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও জজকোর্টের আইনজীবী রহমত উল্যাহ বিপ্লব বলেন, ‘যেভাবে প্রধান শিক্ষককে শাস্তি দেওয়া হয়েছে, সেটি আইনগতভাবে হয়নি। কাউকে শাস্তি দেওয়ার আগে তাঁকে একাধিকবার কারণ দর্শানোর নোটিশ দিতে হয়। কিন্তু এখানে সেটি মানা হয়নি। এটি অন্যায় হয়েছে।’

সব অভিযোগ অস্বীকার করে সদর উপজেলা প্রাথমিক সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা ও তদন্ত কর্মকর্তা মো. ফরিদ উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, আনোয়ার হোসেন মোর্শেদের বিরুদ্ধে তাঁর সহকর্মীরা বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ দিয়েছেন। সে অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হয়। প্রমাণের আলোকে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মুনছুর আলী চৌধুরী বলেন, ‘অভিযোগের আলোকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে বিষয়টি দুঃখজনক বলা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। এ ছাড়া ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ রয়েছে। করোনাকালীন চেয়ারম্যানকে সংবর্ধনা দেওয়ার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।’

উল্লেখ্য, আজ মঙ্গলবার সকালে সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জে পারিবারিক কবরস্থানে আনোয়ার হোসেন মোর্শেদের দাফন সম্পন্ন হয়েছে

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত