বাজেটের প্রধান ৬ চ্যালেঞ্জ

| আপডেট :  ১০ জুন ২০২২, ১২:১১  | প্রকাশিত :  ১০ জুন ২০২২, ১২:১১

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে যে বাজেট পেশ করেছেন তা মূলত সংকোচনমূলক এবং টিকে থাকার বাজেট। অঙ্কের সংখ্যায় বাজেটের আকার ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার। সেখানে ঘাটতি দুই লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এর জন্য বিদেশি আর ব্যাংকঋণই ভরসা।

কভিডে হাত না গুটাতেই শুরু হয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ। এ অবস্থায় অর্থনীতির ভিলেন এখন মূল্যস্ফীতি। বাজেটের নায়ক অর্থমন্ত্রী এই ভিলেন দমনে কী দাওয়াই রেখেছেন, তা-ই এবার আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল। সেখানে অর্থমন্ত্রী অর্থনীতিবিদদের কাছ থেকে ভালো নম্বর পাবেন কি না তা নিয়ে সন্দেহ থাকছে। অর্থমন্ত্রীও মূল্যস্ফীতিকেই বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বলা হয়েছে, আগামী অর্থবছর মূল্যস্ফীতিকে ৫.৬ শতাংশের ঘরে বেঁধে রাখা হবে। মূল্যস্ফীতি বাগে রাখা এবং সামাজিক সুরক্ষা মিলে সার্বিক ভর্তুকির প্রস্তাব করা হয়েছে ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা।

ছয় চ্যালেঞ্জ

চলমান প্রেক্ষাপটে আগামী অর্থবছরের জন্য ছয়টি বিষয়কে প্রধান চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছেন অর্থমন্ত্রী। সেসব চ্যালেঞ্জ মাথায় রেখে এই অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। বাজেটের মাল্টিমিডিয়া উপস্থাপনায় ও লিখিত বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, আগামী অর্থবছরের জন্য ছয়টি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করেছেন তিনি। এগুলো হলো—মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা ও অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বাড়ানো; গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের মূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে বর্ধিত ভর্তুকির জন্য অর্থের সংস্থান; টাকার বিনিময় হার স্থিতিতিশীল ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সন্তোষজনক পর্যায়ে রাখা; বৈদেশিক সহায়তার অর্থ ব্যবহার এবং মন্ত্রণালয়/বিভাগের উচ্চ-অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ে শেষ করা; শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্পগুলো যথাসময়ে বাস্তবায়ন; অভ্যন্তরীণ মূল্য সংযোজন কর সংগ্রহের পরিমাণ ও ব্যক্তি আয়করদাতার সংখ্যা বাড়ানো। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কৌশলী হতে হবে জানিয়ে বাজেটে বেশ কিছু পদক্ষেপ স্থান পেয়েছে বলে জানান অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, কোনো একটি সমস্যাও সঠিকভাবে সমাধান করা না গেলে তা সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করতে পারে।

মূল্যস্ফীতি

সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় কয়েক গুণ বৃদ্ধির বিপরীতে আরাধ্য কেবল স্বস্তি। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে সেই স্বস্তির কথা আছে। কিন্তু জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং সারের দাম পর্যায়ক্রমে সমন্বয়ের প্রস্তাব বাস্তবে অস্বস্তির বার্তা দিচ্ছে। কারণ সমন্বয় নামি এই মূল্যবৃদ্ধি জীবনযাত্রার ব্যয় আরো বাড়াবে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মুস্তাফিজুর রহমানও মনে করেন প্রস্তাবিত বাজেটে প্রয়োজন অনুযায়ী মূল্যস্ফীতি কমানোর পদক্ষেপগুলো পর্যাপ্ত নয়। নিত্যপণ্যের শুল্কে যে ধরনের ছাড় দরকার ছিল তা নেওয়া হয়নি। মূল্যস্ফীতির নিরিখে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বাজেট কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু নবসৃষ্ট প্রয়োজনের তুলনায় তা স্বস্তিকর নয়। গত তিন মাস ধরে টানা ৬ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি হয়েছে। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তব্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছেন। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ ও আওতা বাড়ানোর প্রস্তাব আছে। কিন্তু আদতে প্রতিবন্ধী ভাতা ছাড়া অন্য কোনো ভাতা বাড়েনি। বরং খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে নিম্ন আয়ের মানুষের চাল কিনতে বেশি টাকা খরচ করতে হবে। এই কর্মসূচির ১০ টাকা কেজির চাল ১৫ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতির বিপরীতে মজুরি বেড়েছে ৬ শতাংশের বেশি। যদিও মূল্যস্ফীতি এই বাড়তি মজুরিকে পকেটে রাখতে দেয়নি। তবু আশা ছিল বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হবে। কিন্তু তা আগের মতোই রাখা হয়েছে। মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, সাধারণ মানুষের স্বার্থের দিক থেকে বাজেটকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, মূল্যস্ফীতির যে চাপ এবং মানুষের কর্মসংস্থানের যে প্রয়োজনীতা তা বাড়ানোর তেমন কোনো চেষ্টা বাজেট প্রস্তাবে নেই।

করপোরেট কর কমছে

প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যবসায়ীদের জন্য করপোরেট কর কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। আর বিনিয়োগ বাড়লে কর্মস্থানের সুযোগ বাড়বে। বাড়বে আয়ও। টানা তিন বছর করপোরেট কর কমানো হচ্ছে। বিনিয়োগ বৃদ্ধির আশায় এটা করা হচ্ছে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কম্পানির করহার ২.৫ শতাংশ কমিয়ে ২০ শতাংশ করার কথা বলা হয়েছে। আর শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত নয় এমন কম্পানির করহার ৩ শতাংশ কমিয়ে ২৭.৫ শতাংশ করা হয়েছে। একক ব্যক্তির কম্পানির করহার ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২২.৫ শতাংশ করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যক্তিসংঘ ও কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তা এবং অন্যান্য করযোগ্য সত্তার করহার ২.৫ শতাংশ কমে ২৭.৫ শতাংশ করা হয়েছে। ব্যাংক-বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, সিগারেট, মোবাইল ফোন অপারেটর প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য শ্রেণির করপোরেট করের হার অপরিবর্তিত রয়েছে।

প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ৭.৫ শতাংশ

বাজেটে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭.৫ শতাংশে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। আবার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ‘চাহিদা কমিয়ে আনা হবে’ বলেও বলছেন অর্থমন্ত্রী। অর্থনীতির স্বাভাবিক সূত্র, চাহিদা কমলে ভোগও কমে যাবে। ভোগ কমলে বিনিয়োগও হোঁচট খাবে। আবার বিদ্যুৎ, গ্যাস, জ্বালানির দাম বাড়লে বিনিয়োগও বাধাগ্রস্ত হয়। কারণ এতে উৎপাদন মূল্য বেড়ে যায়। মুনাফা কমে যায়। ফলে বড় প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জন দৃশ্যত কঠিন হবে। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমদানিনির্ভর ও কম গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ব্যয় বন্ধ রাখা অথবা কমিয়ে আনার উদ্যোগ প্রশংসা পেয়েছে বিশ্লেষকদের কাছ থেকে। এতে নিম্ন অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পের বাস্তবায়ন গতি কমলেও উচ্চ ও মধ্যম অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত প্রকল্পের গতি বাড়বে।

পাচার হওয়া টাকার বৈধতা

কালো টাকার আলোচনা যখন ক্লিশে, তখন বাজেটে নতুন আলোচনার বিষয় বিনা প্রশ্নে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে এনে বৈধ করার উদ্যোগ। বিদেশে অর্জিত অর্থ ও সম্পদ অর্থনীতির মূল স্রোতে আনতে অর্থমন্ত্রী আয়কর অধ্যাদেশে নতুন বিধান যুক্ত করার প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবিত বিধান অনুযায়ী, বিদেশে অবস্থিত যেকোনো সম্পদের ওপর কর পরিশোধ করা হলে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ যেকোনো কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করবে না। বিদেশে অর্জিত স্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে আনা না হলে এর ওপর ১৫ শতাংশ, বিদেশে থাকা অস্থাবর সম্পত্তি বাংলাদেশে আনা না হলে ১০ শতাংশ ও বাংলাদেশে পাঠানো (রেমিটকৃত) নগদ অর্থের ওপর ৭ শতাংশ হারে করারোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ সুবিধা ২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। ‘কভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তনের’ এই বাজেট আসলে সংকট উত্তরণের বাজেটও বটে। আবার মূল্যস্ফীতি বা বৈশ্বিক মন্দার মুখে এটা টিকে থাকার বাজেটও। ফলে বাজেটের বাকি সব খাত ও বরাদ্দকে গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতার সংখ্যাগত উপস্থাপন বলা যায়।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, বাজেটে উল্লেখ করা প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম গতিশীল থাকবে। রপ্তানি খাতের প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার আয় বৃদ্ধি পাবে। করজাল ও আনুষ্ঠানিক অর্থনীতির সম্প্রসারণ হবে। নতুন উদ্যোক্তা তৈরি ও কর্মসংস্থান হবে। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত হবে এবং রাজস্ব ভিত্তি শক্তিশালী হবে। তাতে রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ আরো এক ধাপ এগিয়ে যাবে।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত