বাসে শিক্ষার্থীরা অর্ধেক ভাড়া কেন দেবে, বিতর্ক যেসব নিয়ে

| আপডেট :  ২৪ নভেম্বর ২০২১, ০৮:১২  | প্রকাশিত :  ২৪ নভেম্বর ২০২১, ০৮:১২

‘ছাত্ররা অন্য কোথাও কি হাফ পাস পায়? পরীক্ষার বেতন কি হাফ দেয়, না কলেজের ক্যানটিনে হাফ টাকায় খায়? সরকারের কোনো সেবাপ্রতিষ্ঠানও তাদের সেবার বিনিময়ে হাফ টাকা নেয় না। তাহলে আমাদের ওপরে হাফ ভাড়া নেয়ার দায় কেন চাপানো হচ্ছে?’

বাসে হাফ ভাড়া নিতে হবে, এমন কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই। তার পরেও বিষয়টি নিয়ে বারবার বিরোধ তৈরি হয়। ডিজেলের দাম বাড়ানোর পর বাস ভাড়া ২৭ শতাংশ বাড়িয়ে বিআরটিএর আদেশ আসার পর ছাত্রদের সঙ্গে বাস ভাড়া নিয়ে বাগ্‌বিতণ্ডা নিয়মিত ঘটনা হয়ে উঠেছে। এর কারণও এই হাফ ভাড়া বিতর্ক।

বাসগুলো সরকারনির্ধারিত হারের বদলে ওয়েবিল নামে এক পদ্ধতিতে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে আসছে গত কয়েক বছর ধরে। এবার বাস ভাড়া বাড়ানোর পর কিলোমিটার দূরত্বে হিসাবে না দিয়ে ওয়েবিলের ভাড়া আরও বাড়িয়ে দেয়া হয়।

এই বাড়তি ভাড়া আদায় ঠেকাতে যখন ওয়েবিল বন্ধের চাপ দেয়া হচ্ছে, সে সময় গত এক সপ্তাহ ধরেই অর্ধেক ভাড়ার দাবিতে ছাত্রদের আন্দোলন শুরু হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া নেয়ার বিষয়টি ছিল মৌখিক। কেউ নিতেন, কেউ নিতেন না।

তবে গত কয়েক বছরে ওয়েবিলের বাসে ‘হাফ পাস’ অনেকটাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এবার কম ভাড়া একেবারেই নিতে চাইছেন না পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। তারা বলছেন, হাফ ভাড়া নিয়ে সড়কে বাস চালানো সম্ভব না। জ্বালানির দাম বাড়ার পাশাপাশি সব খরচ বেড়েছে।

তবে ছাত্রদের হাফ ভাড়ার আন্দোলনও বড় হচ্ছে। একজোট ছাত্রদের কারণে যান চলাচল প্রায়ই বন্ধ থাকছে বিভিন্ন রুটে। আবার ছাত্ররা চাপ দিলে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরাও বাস বন্ধ রেখে ভোগান্তির কারণ হচ্ছে। এই মধ্যে ছাত্রদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা জানিয়েছেন বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন, এমনকি তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানও। তিনি ছাত্রদের দাবিকে যৌক্তিক আখ্যা দিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলার আশ্বাস দিয়েছেন।

এরই মধ্যে একটি রুটে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য হাফ ভাড়া মেনে নিয়েছেন বাসমালিকরা। সদরঘাটগামী বাসে অর্ধেক ভাড়ায় যাতায়াতের পাশাপাশি ছাত্রদের জন্য সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ টাকা রাখা হবে বলে সমঝোতা হয়েছে। বাসে অর্ধেক ভাড়ার দাবিতে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করেন মকবুল হোসেন কলেজসহ বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।

বিক্ষোভে শিক্ষার্থীরা ‘হাফ পাস চাই’, ‘হাফ পাস ভিক্ষা নয়, আমাদের অধিকার’, ‘দাবি একটাই, হাফ পাস চাই’ লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে অংশ নেয়। হাফ পাস দাবির বিষয়ে মকবুল হোসেন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তানভীর রহমান বলেন, ‘আমরা স্কুলে থাকাকালীন হাফ ভাড়া দিয়েছি। ২-৩ বছর ধরে কোনো বাসে আর হাফ ভাড়া নেয় না। আর তেলের দাম বাড়ানোর পর একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছে। ছাত্রদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া নিতে হবে।’

সিটি কলেজের শিক্ষার্থী ফয়সাল বলেন, ‘গত কয়েক দিন ধরে বাসে অর্ধেক ভাড়ার দাবিতে আমরা আন্দোলন করছি। আমরা চাই অর্ধেক ভাড়ার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আসুক। যাতে কোনো বাসের চালক বা সহকারী অর্ধেক ভাড়া নিতে অস্বীকৃতি না জানাতে পারে।’ তবে কেন শুধু বাসেই হাফ ভাড়া দেবেন? অন্য কোনো সেবা নিতে তো হাফ দেন না। হাফ পাস কি আইনে আছে? এমন প্রশ্ন করা হলে শিক্ষার্থীরা বিষয়টি নিয়ে কোনো কথা বলেননি।

যা বলছেন বাসমালিকরা
হাফ ভাড়া নিয়ে ছাত্রদের বিক্ষোভ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হচ্ছে মিরপুর রুটে। এই রুটে অনেক বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে আজিমপুর পর্যন্তই আছে তিনটি বড় বলেজ, সিটি কলেজ, ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ। একটি বাসের এক শ্রমিক বলেন, বিশেষ করে সকালে এই রুটে যত যাত্রী ওঠে তার একটি বড় অংশই ছাত্র। যদি সবার কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নিতে হয়, তাহলে বাস চালানোর টাকাই উঠবে না।

বিকাশ পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহরাব হোসেন বলেন, ‘হাফ ভাড়া নিতে হইলে আমাদের এক পয়সাও লাভ হবে না। উল্টো ভর্তুকি দিয়ে গাড়ি চালাইতে হবে। হাফ ভাড়া বিআরটিসি নিলে নিতে পারে, আমরা নেব কেন? আমরা তো কোনো কিছুতেই হাফ ট্যাক্স দিই না।‘

অর্ধেক ভাড়া নিতে হলে আর্থিক সহযোগিতা দরকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সরকার আমাদের ভর্তুকি দিক, ভাড়া আরও বাড়াক, আমরা হাফ ভাড়া নেব। নইলে আমাদের পোষাবে না। ডিজেলের দাম আর বর্তমান ভাড়াতেই আমরা লাভ নিয়ে ঘরে যেতে পারি না।’ সোহরাব হোসেন মিরপুর রোডের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমার এই রাস্তায় চারটা কলেজ। হাফ ভাড়া দিয়ে আমি কেমনে চালামু। শুক্রবারও কয় হাফ ভাড়া।’

বাসে অর্ধেক ভাড়া কীভাবে এলো, বিতর্ক কী নিয়ে
মিরপুর সুপার লিংক পরিবহনের দুটি বাসের মালিক হাসান শেখ। তিনি বলেন, পরিবহন সম্পূর্ণ প্রাইভেট সেক্টর। এখানে সরকার কিছু দেয় না। গণপরিবহন সাধারণ জনগণ চালায়। সরকার পরিচালিত বাস-ট্রেনেই হাফ ভাড়া নেই। যেটা সাধারণ মানুষ চালাচ্ছে সেখানে হাফ ভাড়া দাবি অযৌক্তিক।’

ছাত্ররা কেবল বাস ভাড়ার ক্ষেত্রে কেন ছাড় চায়- এই প্রশ্নও রাখেন এই বাসমালিক। বলেন, ‘ছাত্ররা অন্য কোথাও কি হাফ পাস পায়? পরীক্ষার বেতন কি হাফ দেয়, না কলেজের ক্যানটিনে হাফ টাকায় খায়? সরকারের কোনো সেবাপ্রতিষ্ঠানও তাদের সেবার বিনিময়ে হাফ টাকা নেয় না। তাহলে আমাদের ওপরে হাফ ভাড়া নেয়ার দায় কেন চাপানো হচ্ছে?’ তিনি বলেন, ‘যখন গ্যাসে চলত, তখন হাফ পাস ছিল। কিন্তু গ্যাসের দামও বাড়ার পর হাফ পাস দেয়া হয় না। বিহঙ্গ গাড়িতে হাফ পাস ছিল। তারাও বাধ্য হয়ে চালু করেছিল।’

এই বিতর্কে মাঝেমধ্যেই বাস বন্ধ রেখে চাপ দিচ্ছেন কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এসব কারণে শ্রমিকরা বাস চালাতে চাচ্ছে না।’ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে হাসান শেখের দুটি গাড়িই ভাঙচুরের শিকার হয়েছে বলে দাবি তার।

বলেন, ‘আমার দুইটা গাড়ি ভাইঙ্গা শেষ করে দিছে। দুই গাড়িতে একটা গ্লাসও নাই। ৬৪-৬৫ হাজার টাকা খরচ কইরা গ্লাসগুলো লাগাইছিলাম। এই ছাত্ররা সবগুলো ভাইঙ্গা দিছে। এই খরচ কইরা আমার ঘরে এখন বাজার নাই। কোম্পানিরে বলছিলাম, ওরাও কোনো সহযোগিতা করবে না।’

শিক্ষার্থীদের দাবি এবং মালিক-শ্রমিকদের অবস্থান প্রসঙ্গে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের এই দাবির আইনগত কোনো প্রবেশন নাই। তাদের এই দাবির বিষয়টা আমরা দেখছি, আমাদের পক্ষ থেকে সরকারকে অবগত করেছি। এগুলো নিয়ে বৈঠক করেছি।’

তিনি বলেন, ‘অর্ধেক ভাড়ার দাবিটা নতুন নয়। যুগে যুগেই ছাত্রদের এই দাবি ছিল। সমাধানে চেষ্টা করছি।’

বাসমালিকদের সংগঠন সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব এনায়েত উল্লাহ দেখান আইনের বিষয়। তিনি বলেন, ‘সড়ক পরিবহন আইনে হাফ ভাড়া নেয়ার বিষয়ে কোনো প্রবেশন নাই। বিআরটিসি দিলে দিতে পারে, যেহেতু তারা ভর্তুকি দেয়। আমাদের দেয়ার কোনো বাধ্যবাধকা এবং সুযোগ নেই, সম্ভবও না।‘

শিক্ষার্থীরা প্রতিদিনও এই দাবিতে আন্দোলন করছে, সমাধান কী হবে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সমাধানটা সরকারকে করতে হবে। আমাদের প্রচুর ক্ষতি হচ্ছে। সরকার আমাদের বলছে, তারা সামাধানে চেষ্টা করছে।’

আগে পেতেন- এটাই ছাত্রদের প্রধান বক্তব্য
সোমবার মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সড়ক অবরোধ করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা ‘হাফ পাস চাই’, ‘হাফ পাস ভিক্ষা নয়, আমাদের অধিকার’, ‘দাবি একটাই, হাফ পাস চাই’সহ নানা প্ল্যাকার্ড নিয়ে অংশ নেয়।

তবে অর্ধেক ভাড়ার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো বক্তব্য নেই তাদের। কেবল অতীতে এই সুবিধা পেতেন- এই বিষয়টি তুলে ধরেছেন তারা।

হাফ পাস দাবির বিষয়ে মকবুল হোসেন কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তানভীর রহমান বলেন, ‘আমরা স্কুলে থাকাকালীন হাফ ভাড়া দিয়েছি। ২-৩ বছর ধরে কোনো বাস নেয়, কোনো বাসে নেয় না। আর তেলের দাম বাড়ানোর পর একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছে। ভাড়া নিতে হবে।’

সিটি কলেজের শিক্ষার্থী ফয়সাল আমিন বলেন, ‘গত কয়েক দিন ধরে বাসে অর্ধেক ভাড়ার দাবিতে আমরা আন্দোলন করছি। আমরা চাই অর্ধেক ভাড়ার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আসুক, যাতে কোনো বাসের চালক বা সহকারী অর্ধেক ভাড়া নিতে অস্বীকৃতি না জানাতে পারে।’

সূত্র: নিউজ বাংলা

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত