বেতন স্কেল পুনর্বিন্যাস নিয়ে কিছু প্রস্তাব

| আপডেট :  ১৯ মে ২০২২, ০৫:১৯  | প্রকাশিত :  ১৯ মে ২০২২, ০৫:১৯

দেশের সকল পর্যায়ের, সকল বিভাগের সরকারি চাকরিজীবিদের বেতন ‘জাতীয় বেতন কাঠামো’ অনুযায়ী নির্ধারণ করা হয়। আধা-সরকারি এবং অনেক স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবিদের বেতনও ‘জাতীয় বেতন কাঠামো’ অনুযায়ী নির্ধারন করা হয়।

দেশের লক্ষ লক্ষ চাকরিজীবির বেতন, ইনক্রিমেন্ট, উচ্চতর স্কেল এবং পেনশন ‘জাতীয় বেতন কাঠামো’ অনুযায়ী নির্ধারিত হবার কারণে জাতীয় বেতন কাঠামো এসব চাকরিজীবির নিকট খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সরকার সর্বশেষ ২০১৫ সালে একটি পে-স্কেল প্রদানের মাধ্যমে জাতীয় বেতন কাঠামো পুণর্বিন্যাস করে। জাতীয় বেতন কাঠামোয় ২০টি গ্রেড রয়েছে। বেতন কাঠামোর এই ২০টি গ্রেড নির্ধারণ নিয়ে সিংহভাগ চাকরিজীবিরই গুরুতর আপত্তি রয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, বেতন কাঠামোর ধাপগুলো নির্ধারণে মারাত্মক বৈষম্য করা হয়েছে।

চাকরিজীবিদের একটা বড় অংশের এমন আপত্তি এবং অভিযোগ কতটুকু সত্য, তা যাচাই করার জন্য যেকোনো নিরপেক্ষ মানুষ বেতন কাঠামোর দিকে এক পলক তাকালেই বুঝতে পারবে এবং অকপটে স্বীকার করবে, বেতন কাঠামোয় কিছু শ্রেণির প্রতি মারাত্মকভাবে বৈষম্য করা হয়েছে।

বেতন কাঠামোয় কিভাবে বৈষম্য করা হয়েছে, তা সহজে বুঝার জন্য বেতন কাঠামোকে সামনে আনতে হবে এভাবে-

২০তম গ্রেড (৮২৫০) থেকে ১৯তম গ্রেডের (৮৫০০) ব্যবধান ২৫০ টাকা, ১৯তম থেকে ১৮তম গ্রেডের (৮৮০০) ব্যবধান ৩০০ টাকা, ১৮তম থেকে ১৭তম গ্রেডের (৯০০০) ব্যবধান ২০০ টাকা, ১৭তম থেকে ১৬তম গ্রেডের (৯৩০০) ব্যবধান ৩০০ টাকা, ১৬তম থেকে ১৫তম গ্রেডের (৯৭০০) ব্যবধান ৪০০ টাকা, ১৫তম থেকে ১৪তম গ্রেডের (১০২০০) ব্যবধান ৫০০ টাকা, ১৪তম থেকে ১৩তম গ্রেডের (১১০০০) ব্যবধান ৮০০ টাকা, ১৩তম থেকে ১২তম গ্রেডের (১১৩০০) ব্যবধান ৩০০ টাকা, ১২তম থেকে ১১তম গ্রেডের (১২৫০০) ব্যবধান ১২০০ টাকা, ১১তম থেকে ১০ম গ্রেডের (১৬০০০) ব্যবধান ৩৫০০ টাকা, ১০ম থেকে ৯ম গ্রেডের (২২০০০) ব্যবধান ৬০০০ টাকা, ৯ম থেকে ৮ম গ্রেডের (২৩০০০) ব্যবধান ১০০০ টাকা, ৮ম থেকে ৭ম গ্রেডের (২৯০০০) ব্যবধান ৬০০০ টাকা, ৭ম থেকে ৬ষ্ঠ গ্রেডের (৩৫৫০০) ব্যবধান ৬৫০০ টাকা, ৬ষ্ঠ থেকে ৫ম গ্রেডের (৪৩০০০) ব্যবধান ৭৫০০ টাকা, ৫ম থেকে ৪র্থ গ্রেডের (৫০০০০) ব্যবধান ৭০০০ টাকা, ৪র্থ থেকে ৩য় গ্রেডের (৫৬৫০০) ব্যবধান ৬৫০০ টাকা, ৩য় থেকে ২য় গ্রেডের (৬৬০০০) ব্যবধান ৯৫০০ টাকা এবং ২য় থেকে ১ম গ্রেডের (৭৮০০০) ব্যবধান ১২০০০ টাকা।

এখানে বেতন কাঠামোর ২০টি গ্রেডের প্রতি দু’গ্রেডের মধ্যকার ব্যবধান দেখানো হয়েছে। এই ব্যবধানগুলো কিভাবে বৈষম্যে পরিণত হয়েছে, তা এক ব্যবধানের সাথে অন্য ব্যবধানের তুলনা করলেই বুঝা যায়। বৈষম্যের কয়েকটি দিক দেখা যাক-

এক. ২০তম গ্রেড থেকে ১২তম গ্রেড পর্যন্ত ৮টি গ্রেডের গড় ব্যবধান ৪৩৫ টাকা (প্রায়)। অথচ ১২তম থেকে ১১তম গ্রেডের ব্যবধান ১২০০ টাকা। ৮টি গ্রেডের গড় ব্যবধানের চেয়ে মাত্র ১টি গ্রেডে ব্যবধান যেখানে অনেক কম হবার কথা, সেখানে এতো বেশি কেন?

দুই. ১৯তম গ্রেডে যিনি চাকরি শুরু করেন, চাকরির ১০ম বছরে প্রথম গ্রেড উন্নয়নে তাঁর বেতন বাড়ে ৩০০ টাকা, ১৩তম গ্রেডে যিনি চাকরি করেন, চাকরি শুরুর ১০ বছর পর প্রথম গ্রেড উন্নয়নে তাঁর বেতনও বাড়ে সেই ৩০০ টাকা। এটা কি সুবিচার? ১৯তম গ্রেডে চাকরিজীবির যোগ্যতা এবং সেবা আর ১৩তম গ্রেডে চাকরিজীবির যোগ্যতা ও সেবা কি তাহলে সমান?!

তিন. ২০তম গ্রেড থেকে ১৯তম গ্রেডে উন্নীত হলে বেতন বাড়ে ২৫০ টাকা, ১৯তম থেকে ১৮তম গ্রেডে উন্নীত হলে বেতন বাড়ে ৩০০ টাকা। বেতন বৃদ্ধির গতিটা এখানে ধীর হলেও স্বাভাবিক। কিন্তু ১৮তম থেকে ১৭তম গ্রেডে বেতনের ব্যবধান ২০০ টাকা কেন? উন্নীত গ্রেডে গেলে ২০তম এবং ১৯তম গ্রেডের চাকরিজীবির চেয়ে ১৮তম গ্রেডে চাকরিজীবির বেতন কম বাড়বে কেন? একইভাবে ১৪তম গ্রেডে চাকরিজীবির চেয়ে ১৩তম গ্রেডে চাকরিজীবির বেতন উন্নীত গ্রেডে গেলে কম বাড়বে কেন? নিচের গ্রেডে চাকরিজীবির বেতন বাড়ে ৮০০ টাকা আর এক গ্রেড উপরে চাকরি করেও বেতন বাড়ে মাত্র ৩০০ টাকা! এরকম বৈষম্য আরো কয়েকটা গ্রেডেই করা হয়েছে।

চার. ২০তম গ্রেড থেকে ১২তম গ্রেড পর্যন্ত বেতনের মোট ব্যবধান ৩০৫০ টাকা, কিন্তু মাত্র ১১তম থেকে ১০ম গ্রেডের ব্যবধান-ই ৩৫০০ টাকা। ৮ শ্রেণিকে ঠকিয়ে এক শ্রেণিকে লাভবান করার উদ্দেশ্য কী? যে ৮ শ্রেণিকে ঠকানো হয়েছে, সেই ৮ শ্রেণির চাকরিজীবি কি প্রজাতন্ত্রের সেবক নয়? তারা কি প্রজাতন্ত্রের শত্রু? তাদের দ্বারা কি প্রজাতন্ত্রের কোনো কল্যাণ হয় না? পক্ষান্তরে যে বিশেষ শ্রেণিকে লাভবান করা হয়েছে, তাদের দ্বারা কি প্রজাতন্ত্রের অতিরিক্ত সেবা হয়? তারা কি প্রজাতন্ত্রের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ?

পাঁচ. ১০ম গ্রেড থেকে ৯ম গ্রেডে বেতনের ব্যবধান ৬০০০ টাকা, কিন্তু ৯ম থেকে ৮ম গ্রেডের ব্যবধান মাত্র ১০০০ টাকা কেন? কাছাকাছি দুইটি ব্যবধানে এমন আকাশ-পাতাল তফাৎ কেন? বেতন কাঠামো যে নিরপেক্ষভাবে প্রণয়ন করা হয়নি, এটা তার উৎকৃষ্ট একটি প্রমাণ। একটা শ্রেণিকে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে, আরেকটা শ্রেণিকে হাতে ধরে ঠকানো হয়েছে। বেতন কাঠামোর ২০টি গ্রেডের সর্বশেষ গ্রেডে যে বেতন ধার্য করা হবে, উপরের প্রতিটা গ্রেডে বেতন তুলনামূলক বাড়বে, এটাই বেতন বৃদ্ধির স্বাভাবিক ধারা হবার কথা। কিন্তু বেতন কাঠামোয় গ্রেডে গ্রেডে স্বাভাবিক বৃদ্ধির ধারাকে এভাবে বার বার ভেঙে ফেলা হয়েছে। বেতন বৃদ্ধির ধারা কেন একবার উপরের দিকে গেছে, আবার নিচের দিকে নেমে গেছে? ধারাটি কখনো কচ্ছপের গতিতে হাঁটে কেন, আবার কখনো কখনো খরগোশের গতিতে দৌড়ে কেন? যাদেরকে কাঠামোটি প্রণয়ন করতে দেয়া হয়, এটা তাদের জঘণ্য কপটতার প্রকাশ নয় কি?

বেতন কাঠামোয় সাপলুডু খেলা হয়েছে। কারো কারো ভাগে পড়ে ছোট ছোট মই, কারো ভাগে নির্ধারিত থাকে বড় বড় মই। যাদের ভাগে ছোট ছোট মই পড়ে, তারা আবার অনেক সময় ছোট মই পেয়ে একটু উপরে উঠে যাওয়ামাত্র সাপের মুখে পড়ে আবার নিচে নেমে যেতে হয়। কিন্তু যাদের ভাগে বড় বড় মই পড়ে, তাদের পথ চলায় ছোট কোন সাপও নেই (সামান্য ব্যতিক্রম বাদে)। জাতীয় বেতন কাঠামোর মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে এভাবে সাপলুডু খেলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

ছয়. ২০তম থেকে ১২তম গ্রেড পর্যন্ত গ্রেডগুলোতে বেতনের ব্যবধান সর্বনি¤œ ২০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৮০০ টাকা, গড় ব্যবধান ৩৮০ টাকা (প্রায়)। কিন্তু এর উপরের গ্রেডগুলোতে বেতনের ব্যবধান সর্বনি¤œ ১০০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১২০০০ টাকা, গড় ব্যবধান ৬০৬০ টাকা (প্রায়)! উপরের ১১টি গ্রেডের ব্যবধানগুলোর মধ্যে দুইটি ব্যবধান ১০০০ ও ১২০০ বাদ দিলে অবশিষ্ট সবগুলো ব্যবধান ৩৫০০ টাকার উপরে। শেষের ৮টি গ্রেডের কোনো ব্যবধানই চার অংকের ঘর স্পর্শ করতে পারেনি, অথচ শুরুর গ্রেডগুলোর ব্যবধান শুধু চার অঙ্কের ঘর-ই স্পর্শ করেনি, বরং ১১টি ব্যবধানের ৮টিই ৩৫০০ বা তার চেয়ে বেশি! এরকম ব্যবধানের নাম বৈষম্য ছাড়া আর কী হতে পারে!

বেতন কাঠামোয় শুধু সাপলুড়– খেলা-ই হয়নি, বেতন কাঠামোকে বানরের রুটি ভাগের মতোও ভাগ করা হয়েছে। বিশ গ্রেড নির্ধারণের জন্য যাদেরকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তারা নিজেদের ভাগগুলোকে ইচ্ছেমত বড় করে নির্ধারণ করেছে, আর বাকিদের ভাগগুলোকে যতটুক পেরেছে, ছোট করে ভাগ করেছে। এটা খুবই দুঃখজনক। সরকারি চাকরিজীবি অল্প ক’জন মানুষকে বেতন কাঠামো প্রণয়নের দায়িত্ব দেয়া হয়। তারা এমনভাবে কাঠামো প্রণয়ন করে, মনে হয় তারা ছাড়া অন্য যারা বেতন কাঠামোর আওতাভুক্ত, তারা সরকারি চাকরি করে না, বরং সম্পূর্ণ বেসরকারি চাকরি করে! এটা একটা চরম স্বার্থপরতা এবং প্রবঞ্চনা।

বেতন কাঠামোয় বহুমাত্রিক বৈষম্যের পাশাপাশি কিছু অসঙ্গতিও আছে। যথা:

এক. বর্তমান বেতন কাঠামোয় গ্রেড উন্নীত হলে বাড়িভাড়া ভাতার হার কমে যায়। যেমন: ১৫তম গ্রেডে যারা চাকরি শুরু করে, তাদের বাড়িভাড়া ভাতা থাকে মূল বেতনের ৫০ শতাংশ। কিন্তু প্রথম গ্রেড উন্নীত হলে তাদের বাড়িভাড়া ৫ শতাংশ কমে যায়। ১৫তম গ্রেডে চাকরিজীবি একজন লোক চাকরির ১০ম বছরে প্রথম উন্নীত গ্রেডে যাওয়ার পর তার মূলবেতন বাড়ে ৫০০ টাকা। কিন্তু মূলবেতন বৃদ্ধির পাশাপাশি তার বাড়িভাড়া ভাতা ৫ শতাংশ কমে যাওয়ায় তার মোট বেতন ৫০০ টাকাও বৃদ্ধি পায় না! ১০ বছর পর একজন চাকরিজীবির মূলবেতন ৫০০ টাকা বৃদ্ধির পথেও কাঁটা বিছিয়ে দেয়া হয় মূলবেতন বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়িভাড়া ৫ শতাংশ কমিয়ে দিয়ে। প্রহসন আর কাকে বলে?

সরকারি চাকরিজীবিদের বাড়িভাড়া ভাতা দেয়া হয় মুলত: আবাসস্থল সংক্রান্ত খরচের জন্য। বাসাভাড়া হোক, বাড়ি নির্মাণ হোক বা মেরামত, এই খাতে মানুষের খরচ দিন দিন বৃদ্ধিই পায়। কিন্তু চাকরির বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়িভাড়া ভাতার হার কমিয়ে দেওয়াটা কি বাস্তবতার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ, নাকি সাংঘর্ষিক? বিষয়টা সাপলুডু খেলায় ছোট একটি মই পাবার পরপরই বড় কোনো সাপের মুখে পড়ে যাবার মতোই।

দুই. বর্তমান বেতন কাঠামোয় ২০টি গ্রেডের পাশাপাশি ২৯৪টি ধাপ রয়েছে। বার্ষিক ইনক্রিমেন্টের ক্ষেত্রে ধাপগুলোকে যেমন বিবেচনায় নেয়া হয়, গ্রেড উন্নীত হবার ক্ষেত্রেও ধাপগুলোকে একইভাবে বিবেচনায় নেয়া হয়। ফলে কী হয়? ১০ বছর চাকরির পর একজন চাকরিজীবির মূলবেতন ৮০০ টাকা বৃদ্ধির কথা থাকলেও মূলবেতন ৮০০ টাকা না বেড়ে বাড়ে মাত্র ৪০০ টাকা! এই ‘লেজে কুকুর নাড়ায়’ নিয়মের ফলে ১০ বছর চাকরির পর একটা গ্রেড বৃদ্ধি পাওয়াটাই শুধু অর্থহীন হয়ে যায়, তা নয়, বরং ২০টি গ্রেডও অর্থহীন হয়ে যায়। ধাপের কারনে মূলবেতন পরবর্তী গ্রেডে যেতে না পারার কারণে ধাপগুলোই প্রকারান্তরে গ্রেডে পরিণত হয়। তার মানে বেতন কাঠামোয় গ্রেড মাত্র ২০টি নয়, বরং ২৯৪টি!

তিন. বেতন কাঠামোয় টিফিন ভাতা নির্ধারণ করা হয়েছে ২০০ টাকা। মাসে যদি ২৫টি কর্মদিবস হয়, তাহলে দৈনিক টিফিন ভাতা হয় ৮ টাকা। ৮ টাকা দিয়ে একজন লোক কিভাবে টিফিন করবে? এমন সামান্য ভাতা ধার্য করার কী অর্থ?

চার. শিক্ষাভাতা নির্ধারণ করা হয়েছে সন্তানপ্রতি ৫০০ টাকা হারে। সন্তানটি প্রাথমিকে পড়ুক, উচ্চ বিদ্যালয়ে পডুক বা কলেজে পড়ুক, সবক্ষেত্রে ৫০০ টাকা কি পর্যাপ্তÍ? কোন বিবেচনায় ভাতাটি এমনভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে?

সাধারণত প্রতি ৫ বছর পর দ্রব্যমূল্য এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনা করে পে-স্কেল প্রদান করা হয়। ২০১৫ সালে পে-স্কেল প্রদানের পর এখনও সরকার নতুন পে-স্কেল প্রদান করেনি। গত দুই বছরে দ্রব্যমূল্য অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। গত কয়েক মাসে বেড়েছে আরো মারাত্মকভাবে। এখনও বাড়ছে হু হু করে। শেষ কোথায়, কেউ জানে না। নতুন পে-স্কেল ঘোষণা এখন সময়ের দাবি। তবে ২০১৫ সালের পে-স্কেলেও যেসব গ্রেডের চাকরিজীবি আগের মতোই ‘বাড়িত সুবিধা’ পেয়েছে, তাদের জন্য নতুন পে-স্কেল হয়তো এখনো সময়ের দাবি নয়। কারণ দ্রব্যমূল্য অনেক বৃদ্ধি পেলেও আগের পে-স্কেলের বাড়তি সুবিধার জোরে তাদের ক্রয়ক্ষমতা এখনও অনেক উপরে। এজন্য নতুন পে-স্কেল নিয়ে তাদের কোনো ব্যাকুলতা এখনো দৃষ্টিগোচর নয়। সব মিলিয়ে নতুন পে-স্কেল এখন না দিয়েও শুধু বেতন কাঠামোকে যৌক্তিকভাবে পুণর্বিন্যাস করলে নতুন পে-স্কেলের বিকল্প হয়ে যাবে ঐসব চাকরিজীবির জন্য, আগের বেতন কাঠামোয় যারা মারাত্মক প্রবঞ্চনার শিকার হয়েছে। বেতন কাঠামোকে একটি যৌক্তিক এবং ভারসাম্যপূর্ণ পর্যায়ে নিয়ে আসার জন্য কিছু প্রস্তাব পেশ করা হল।

এক. গ্রেডের সংখ্যা অপরিবর্তিত রেখে সর্বশেষ গ্রেডের বেতন ১০,০০০ (দশ হাজার) টাকা নির্ধারণ করে ১০ শতাংশ হারে বাড়িয়ে বাড়িয়ে উপরের গ্রেডগুলো নির্ধারণ করা হলে বর্তমান বেতন কাঠামোয় বিদ্যমান গুরুতর বৈষম্যগুলো দূর হয়ে বেতন কাঠামোটি সর্বশ্রেণির জন্য কল্যাণকর এবং গ্রহণযোগ্য একটি কাঠামোয় পরিণত হবে। সেক্ষেত্রে গ্রেডগুলো হবে এমন-

২০তম = ১০,০০০; ১৯তম = ১১,০০০; ১৮তম = ১২,১০০; ১৭তম = ১৩,৩১০; ১৬তম = ১৪,৬৪১; ১৫তম = ১৬,১০৬; ১৪তম = ১৭,৭১৭; ১৩তম = ১৯,৪৮৯; ১২তম = ২১,৪৩৮; ১১তম = ২৩,৫৮২; ১০ম = ২৫,৯৪১; ৯ম = ২৮,৫৩৬; ৮ম = ৩১,৩৯০; ৭ম = ৩৪,৫২৯; ৬ষ্ঠ = ৩৭,৯৮২; ৫ম=৪১,৭৮১; ৪র্থ = ৪৫,৯৬০; ৩য় = ৫০,৫৫৬; ২য় = ৫৫,৬১২ এবং ১ম = ৬০,১৭৪। [*দশমিক ভগ্নাংশগুলোকে পূর্ণসংখ্যায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।]

গ্রেডগুলোর ব্যবধান এভাবে আনুপাতিকহারে সমান করে গ্রেডগুলোকে যৌক্তিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হলে পূর্বের বেতন কাঠামোয় ‘বাড়তি সুবিধা’ ভোগকারী কিছু চাকরিজীবির মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিতে পারে। অবশ্য প্রস্তাবিত কাঠামোটির যৌক্তিকতা তাদের উপলব্ধিতে এলে তারা অবশ্যই এই ‘ন্যায্য ক্ষতি’ মেনে নেবে।

দুই. বেতন কাঠামোকে এভাবে নির্ধারণ করলে কোনো ‘ধাপ’ রাখারও প্রয়োজন হবে না। তাছাড়া ধাপগুলো যেহেতু নতুন গ্রেডে উন্নীত হবার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাই ধাপগুলো পুরোপরি বাতিল করাই সঙ্গত। ইনক্রিমেন্টের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে পূর্বনির্ধারিত কোনো ধাপের প্রয়োজন নেই। ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি করে দশমিক ভগ্নাংশকে পরবর্তী পূর্ণ সংখ্যায় নিয়ে গেলেই হবে।

তিন. চাকরির শুরুতে যে বাড়িভাড়া ভাতা নির্ধারণ করা হবে, চাকরির বয়স যত বাড়বে, বাড়িভাড়া ভাতাও তত বৃদ্ধি করা উচিত। তাই প্রতিটি গ্রেড উন্নীত হবার সময় বাড়িভাড়া ভাতার হার না কমিয়ে বরং ৫ শতাংশে হারে বৃদ্ধি করা উচিত।

চার. টিফিন ভাতা মাসিক ২০০ টাকার পরিবর্তে দৈনিক ৫০ টাকা হারে মাসিক ১৫০০ টাকা নির্ধারণ করা উচিত।

পাঁচ. শিক্ষাভাতার ক্ষেত্রে সন্তান প্রাথমিকে পড়লে ৫০০ টাকা, মাধ্যমিকে পড়লে ১০০০ টাকা এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ২০০০ টাকা হারে নির্ধারণ করা উচিত।

ছয়. চিকিৎসা ভাতা চাকরির শুরুতে ১৫০০ টাকা এবং প্রতি গ্রেড উন্নীত হবার সময় ৫০০ টাকা করে বৃদ্ধি করা উচিত।

সাত. সরকারি চাকরিতে ৮ম শ্রেণি পাশ কোনো চাকরি না রেখে চাকরির ন্যূনতম যোগ্যতা এস.এস.সি. করা উচিত।

আট. ২০১৫ সালের আগে চাকরির ৮ম বছরে ‘প্রথম টাইম স্কেলে’র বিধান ছিল। কিন্তু এখন প্রথম গ্রেড উন্নীত হবার জন্য ১০ বছর অপেক্ষা করতে হয়। এটা অতিরিক্ত। চাকরির ৮ম বছরে প্রথম টাইম স্কেল, ১৪তম বছরে দ্বিতীয় টাইম স্কেল এবং ১৮তম বছরে তৃতীয় টাইম স্কেল প্রদান করা অধিক যৌক্তিক।

নয়. সরকারি চাকরিতে মোট ৪টি শ্রেণি রেখে প্রথম শ্রেণির চাকরির নিয়োগের জন্য ৮ম গ্রেড, দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরির জন্য ১২তম গ্রেড, তৃতীয় শ্রেণির চাকরির জন্য ১৬তম গ্রেড এবং চতুর্থ শ্রেণির চাকরির জন্য ২০তম গ্রেড নির্ধারণ করা যেতে পারে। চতুর্থ শ্রেণির চাকরির জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা এস.এস.সি; তৃতীয় শ্রেণির চাকরির জন্য ন্যূনতম এইচ.এস.সি; দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরির জন্য ন্যূনতম ¯œাতক এবং প্রথম শ্রেণির চাকরির জন্য ন্যূনতম ¯œাতক সম্মান নির্ধারণ করা হলে চার শ্রেণির চাকরিজীবিকে চারটি প্রান্তিক গ্রেডে নিয়োগ দেয়া যাবে সহজে। অন্য গ্রেডগুলোতে নিয়োগ দেয়ার প্রয়োজন নেই।

বেতন কাঠামোয় গ্রেড কমানোর সাথে বৈষম্য দূর করার কোনো সম্পর্ক নেই। গ্রেড ১৪টি বা ১০টি করা হলেও বৈষম্য থেকে যেতে পারে।গ্রেডগুলোর মধ্যকার বৈষম্য দূর করা বেশি প্রয়োজন। ২০টি গ্রেড রেখেই গ্রেডে গ্রেডে ব্যবধান আনুপাতিক হারে সমান করে দিলে আমার মনে হয় বেতন কাঠামো বিতর্কের উর্ধ্বে উঠে যাবে।

প্রস্তাবগুলো বিবেচনায় নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি সবিনয় অনুরোধ।

নূর আহমদ
সরকারি চাকরিজীবি

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত