বেশি টাকায় পানি কিনে খেতে হবে ধনীদের

| আপডেট :  ০৭ নভেম্বর ২০২১, ১০:১৬  | প্রকাশিত :  ০৭ নভেম্বর ২০২১, ১০:১৬

বিত্তশালীদের ব্যবহূত পানির দাম উচ্চহারে নির্ধারণ করতে চায় ঢাকা ওয়াসা। সংস্থাটি মনে করছে, সাধারণ মানুষ আর বিত্তশালীদের ব্যবহূত পানির মূল্য এক হতে পারে না। বর্তমানে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম মূল্যে নগরবাসীকে পানি সরবরাহ করছে ওয়াসা। বিত্তশালীদের ক্ষেত্রে দাম বাড়িয়ে পানির উৎপাদন খরচের লোকসান সমন্বয় করতে চায় সংস্থাটি।

বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে বিশেষজ্ঞ ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে একটি কর্মশালাও হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে ওয়াসা পরামর্শ চেয়েছে, কীভাবে এটা বাস্তবায়ন করা যায়। এ ক্ষেত্রে কোন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংগঠন পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পাবে, তাও চূড়ান্ত করেছে ওয়াসা। খুব শিগগিরই ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ঢাকা ওয়াসার আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষর হবে।

প্রতিষ্ঠানটি গবেষণা করে এ-সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের বিস্তারিত পদ্ধতি ওয়াসাকে জানাবে। সে অনুযায়ী ঢাকা ওয়াসা মাঠ পর্যায়ে কাজ শুরু করবে। তবে প্রথম ধাপে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের দু-তিনটি এলাকায় পাইলট প্রকল্প হিসেবে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে। পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে অন্য এলাকায়। ঢাকা ওয়াসার বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক উত্তম কুমার রায় বলেন, বর্তমানে প্রতি হাজার লিটার পানির উৎপাদন খরচ ২২-২৫ টাকা। ঢাকা ওয়াসা বিক্রি করে ১৫ টাকায়। এ খাতে ওয়াসা প্রতি বছর লোকসান দিয়ে আসছে। বিষয়টি কীভাবে সমন্বয় করা যায়, তা নিয়ে ওয়াসা দীর্ঘদিন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এটা সমন্বয় ও বাস্তবায়ন করা একেবারে সহজ না। এই কাজটা কীভাবে করা যায়, সেজন্য উন্নয়ন সংগঠন ওয়াটার এইডের সঙ্গে ওয়াসার খুব শিগগিরই একটি চুক্তি সম্পাদন হবে। ওয়াটার এইড গবেষণা করে বিস্তারিত প্রতিবেদন দেবে। তারপর বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে বাস্তবায়নে যেতে হবে।

ঢাকা ওয়াসার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, একজন মানুষের দৈনিক স্বাভাবিক পানির প্রয়োজন ১৩০ থেকে ১৫০ লিটার। কিন্তু দরিদ্র মানুষ পানি ব্যবহার করে এর চেয়ে কম আর বিত্তশালীরা জনপ্রতি এর চেয়ে অনেক বেশি পানি ব্যবহার করে। অথচ ওয়াসা পানির জন্য ভর্তুকি দিচ্ছে। কাজেই এ ক্ষেত্রে এটা সমন্বয় করা প্রয়োজন। সম্প্রতি এ বিষয়ে অনুষ্ঠিত ওয়ার্কশপে গুলশান, বনানী, বারিধারা ও উত্তরা এলাকায় পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব আসে।

তবে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বলেন, অপেক্ষাকৃত বিত্তশালীরা বসবাস করলেও গুলশান-বনানীর মতো এলাকায় অনেক নিম্ন আয়ের মানুষও বাস করে। রাজধানীর সবচেয়ে বড় কড়াইল বস্তিও ওই এলাকার মধ্যেই পড়েছে। কাজেই ঢালাওভাবে পানির দাম বাড়ালে তা ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে হোল্ডিংভিত্তিক একটি জরিপ করে নির্দিষ্ট হোল্ডিংগুলোর ওপর বর্ধিত পানির দাম আরোপ করা যেতে পারে।

ওয়াসার কর্মশালায় ফ্ল্যাটভিত্তিক বিদ্যুতের পৃথক সংযোগের মতো পানির পৃথক সংযোগদানের বিষয় নিয়েও আলোচনা হয়। কয়েকজন বলেন, ওয়াসার পানি সংযোগগুলো দেওয়া হয় প্রতি ভবনে একটি। এ জন্য ঢাকা শহরে বিদ্যুতের সংযোগ ২০ লাখ হলেও পানির সংযোগ মাত্র দুই লাখের মতো। প্রতি ফ্ল্যাটে পানির পৃথক সংযোগ দেওয়ার জন্য ইতোমধ্যে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশনের (রিহ্যাব) সঙ্গেও বৈঠক করেছে ওয়াসা।

ওয়াসার পক্ষ থেকে রিহ্যাবকে বলা হয়েছে, তাদের নির্মিত ভবনগুলোতে যেন প্রতিটি ফ্ল্যাটের জন্য পৃথক পানির সংযোগ রাখা হয়। এ ক্ষেত্রে মূল সংযোগ একটি থাকলেও প্রয়োজনে ছাদের ট্যাঙ্কি থেকে প্রতি ফ্ল্যাটে পৃথকভাবে পানি সরবরাহের সুযোগ রাখতে হবে। প্রতি ফ্ল্যাটের জন্য রাখতে হবে পৃথক পানির মিটার স্থাপনের ব্যবস্থা।

প্রসঙ্গত, বর্তমানে প্রতি ভবনে একটি মাত্র পানির লাইন থাকায় প্রত্যেক ফ্ল্যাট মালিককেই সমান পানির বিল দিতে হয়। অথচ সবাই সমপরিমাণ পানি ব্যবহার করেন না। এ নিয়ে ফ্ল্যাট বাসিন্দাদের মধ্যে বচসা-অসন্তোষও হচ্ছে। আবার বিদ্যুতের ইউনিটপ্রতি বিল ব্যবহারের পরিমাণের ওপর ভিন্ন হয়ে থাকে। বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে সেই হারে ইউনিটপ্রতি দামও বাড়ে। কিন্তু পানির ক্ষেত্রে এ নিয়ম নেই।

ওয়াসা সূত্রে জানা গেছে, এই কাজ করার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. ফিরোজ আহমেদ, ওয়াটার এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিন জাহান ও ওয়াটার এইডের প্রোগ্রাম ম্যানেজার প্রকৌশলী বাবুল বালা।

এ প্রসঙ্গে প্রকৌশলী বাবুল বালা জানান, ওয়াসার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক কোনো চুক্তি না হলেও ইতোমধ্যে তারা কাজ শুরু করেছেন। তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পানি সরবরাহ প্রক্রিয়া ও বিল নির্ধারণের বিষয় নিয়ে অনুসন্ধান করছেন। কী কী মডেল আছে, সেগুলো খতিয়ে দেখছেন। দেখা গেছে, কিছু দেশে পানির দাম এলাকাভিত্তিক নির্ধারণ করা আছে। ভারতের কয়েকটি শহরেও এলাকাভিত্তিক দাম নির্ধারণ করা আছে। তবে তারা যেভাবে পদ্ধতিটি বাস্তবায়ন করছে, ঢাকা শহরে সেভাবে বাস্তবায়ন করা কঠিন। কারণ দুই কোটি মানুষের এই শহর পরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠেনি। লো ইনকাম ও হাই ইনকাম কমিউনিটিতে এটা বাস্তবায়ন করতে গেলে কী কী চ্যালেঞ্জ আসতে পারে, সেটা নিয়েও তারা কাজ করছেন। ওয়াসার ওই ওয়ার্কশপে কিছু সুপারিশ এসেছিল। সেগুলো নিয়ে জনগণের মতামত, বিশেষজ্ঞ মতামত নেওয়ার কাজ চলছে। বলা যায়, এখন এই উদ্যোগের গ্রাউন্ডওয়ার্ক তারা করছেন।

ওয়াটার এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিন জাহান বলেন, এই কাজটা জটিল। তার পরও একটা স্টাডি করে দেখা হচ্ছে। আধুনিক অ্যাপার্টমেন্টের একজন কী পরিমাণ পানি ব্যবহার করে আর সাধারণ মানুষ বা একজন বস্তিবাসী কী পরিমাণ পানি ব্যবহার করে, তা জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা একজনের নূ্যনতম পানির ব্যবহার সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি। যাতে একটি সহনীয় কমন পানির বিল রাখা যেতে পারে। বর্ধিত পানির বিল বিদ্যুতের মতো হবে। বেশি ব্যবহার করলে বেশি বিল দিতে হবে। এ জন্য আপাতত গুলশান, বনানী ও বনশ্রী এলাকায় কাজ করব।

বুয়েটের অধ্যাপক ও পানি বিশেষজ্ঞ ড. ফিরোজ আহমেদ বলেন, ওয়াসা চাচ্ছে এলাকাভিত্তিক পানির দাম নির্ধারণ করতে। ধানমন্ডি, গুলশান ও বনানীতে বেশি দাম ধরতে। কিন্তু আমি বলেছি, এটা সম্ভব না। কারণ গুলশান-ধানমন্ডিতেও অনেক গরিব থাকে। বরং একটা বিষয় করা যেতে পারে, বিদ্যুতের যেমন অতিরিক্ত ইউনিট ব্যবহার করলে ইউনিট যত বাড়ে, ইউনিটপ্রতি দামও বাড়ে, সেভাবে এটা করা যেতে পারে। তবে যারা বেশি পানি ব্যবহার করে, তাদের বিল বেশি দিতে হবে। আবার বিদ্যুতের আলাদা মিটার থাকলেও ওয়াসার তা নেই। তাহলে কীভাবে ঠিক হবে কে কত পানি ব্যবহার করছে?

ড. ফিরোজ আহমেদ বলেন, সমস্যা হলো, একই এলাকায় অনেক ধরনের লোক বাস করে। ধানমন্ডিই হোক আর গুলশানই হোক, দুটি এলাকাতেই লো ইনকাম গ্রুপের লোকও বাস করে। এখন ওয়াসা বলতে চাচ্ছে এলাকাভিত্তিক পানির দাম ধরতে। কিন্তু সেটা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না। কারণ, এতে তো লো ইনকাম গ্রুপের মানুষজন বিপদে পড়ে যাবে। এজন্য এমন একটি মডেল প্রণয়ন করা দরকার, যাতে তারা বিপদে না পড়ে। আমি বলেছি, সেই পদ্ধতিটা খুঁজে বের করতে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে কয়েকটি ক্যাটাগরিও করা যেতে পারে।

সূত্র: সমকাল, রিপোর্টার: অমিতোষ পাল

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত