ব্যাপক ছাড় দিয়ে ৬ কোটি আয় করতে ১০০ কোটি লোকসান ইভ্যালীর!

| আপডেট :  ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০১:০৬  | প্রকাশিত :  ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০১:০৬

কথায় আছে- খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি। বিতর্কিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির ক্ষেত্রে ঠিক তাই ঘটেছে। সামান্য আয় করতে গিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা লোকসান করেছে এই কোম্পানি। ২০১৯-২০ হিসাব বছরে (২০২০-এর জুনে সমাপ্ত) ইভ্যালি আয় করেছে মাত্র ৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। পণ্যের দামে ব্যাপক ছাড় দিয়ে ক্রেতাদের কাছে পরিচিতি পাওয়া প্রতিষ্ঠানটি এর জন্য লোকসান করেছে ১০০ কোটি টাকা।

ইভ্যালি তাদের কোম্পানির ২০১৯-২০ অর্থবছরের যে বার্ষিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর পরিদপ্তরে (আরজেএসসি) জমা দিয়েছে, সেখানে অস্বাভাবিক এই লোকসানের তথ্য উঠে এসেছে। এতে ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত কোম্পানির সম্পদ, লাভ, লোকসান, দায়দেনা তুলে ধরা হয়েছে। ৩০ জুন পর্যন্ত কোম্পানির পুঞ্জীভূত লোকসান ১০২ কোটি টাকা। এসআর ইসলাম অ্যান্ড কোং এই নিরীক্ষা করেছে বলে জানিয়েছে ইভ্যালি। ২০২০-২১ অর্থবছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদন এখনও ইভ্যালি জমা দেয়নি। ২০১৮ সালের ১৪ মার্চ আরজেএসসিতে কোম্পানি হিসেবে নিবন্ধন নেয় ইভ্যালি।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে তাদের আয় হয়েছে ৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এই টাকা আয় করতে তাদের খরচ হয়েছে ৯৪ কোটি ৭৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। আর ওই বছর কোম্পানির পরিচালন ব্যয় (বেতন-ভাতা, অফিস ভাড়া, গাড়ি, জ্বালানি ও অন্যান্য) ১২ কোটি ২১ লাখ টাকা। ফলে কোম্পানির পরিচালন লোকসান দাঁড়ায় ১০০ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। কোম্পানিকে ৩ লাখ ৮২ হাজার টাকা কর দিতে হয়েছে। ফলে অর্থবছর শেষে কোম্পানির নিট লোকসান দাঁড়ায় ১০০ কোটি ৬০ লাখ টাকা।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের ৩০ জুন শেষে কোম্পানির স্থায়ী সম্পদ ছিল ৬ কোটি ১৭ লাখ টাকার। আর ইনট্যানজিবল অ্যাসেট ছিল ১২ কোটি ১২ লাখ টাকা। ইনট্যানজিবল অ্যাসেট হচ্ছে কোম্পানির এমন সম্পদ, যেগুলো স্পর্শ করা যায় না। যেমন ব্র্যান্ডভ্যালু, পেটেন্ট, ট্রেডমার্ক ইত্যাদি। ইভ্যালির মোট চলতি দায় ছিল ১৪১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ক্রেতাদের কাছে দেনা ছিল ১২৮ কোটি টাকা।

এদিকে ইভ্যালি যে কোম্পানির নামে নিরীক্ষা প্রতিবেদন দাখিল করেছে, সেই এসআর ইসলাম অ্যান্ড কোং দাবি করেছে, তারা কখনও ইভ্যালির নিরীক্ষা করেনি। এ প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং পার্টনার সাইফুল আলম বলেন, ‘আমরা কখনও ইভ্যালির নিরীক্ষা করিনি। ফলে আমাদের নামে কোনো নিরীক্ষা প্রতিবেদন ইভ্যালি জমা দিয়ে থাকলে তা মিথ্যা-বানোয়াট।’

ব্যাপক লোকসান ও সমালোচনার মধ্যে পড়ার পরও বিস্ময়করভাবে গত ১৫ আগস্ট বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে ইভ্যালি দাবি করেছে, তাদের ইনট্যানজিবল অ্যাসেট গত ১৫ জুলাইয়ে বেড়ে হয়েছে ৪৩৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। অন্যদিকে এ সময়ে দেনাও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৪৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে গ্রাহকদের দাঁড়িয়েছে ৩১১ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মাদ রাসেলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। তিনি তার মোবাইল ফোন ধরেননি। পরিচয় দিয়ে খুদে বার্তা পাঠালেও তার জবাব দেননি।

দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি বহির্নিরীক্ষক প্রতিষ্ঠানের একজন ম্যানেজিং পার্টনার ইভ্যালির এই হিসাব বিবরণী তথ্য বিশ্নেষণ করতে গিয়ে বলেন, এটি খুবই অস্বাভাবিক হিসাব বিবরণী। প্রতিষ্ঠানটি এমনভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যবসা করেছে যে, গ্রাহকের দেনা পরিশোধের সক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও বড় অঙ্কের দায় সৃষ্টি করেছে। তাদের সম্পদ, দায়, আয় ও ব্যয়ের পরিসংখ্যান দেখে অনুধাবন করা যায়, তারা প্রতারণার উদ্দেশ্যে ব্যবসা পরিচালনা করেছে। সাধারণত দেখা যায়, কোনো নতুন ধরনের ব্যবসায় প্রথম পর্যায়ে অনেকে পণ্যের দাম কমিয়ে এবং বিপণন খরচ বেশি করে বাজার ধরতে চায়। এতে কিছু লোকসান হতে পারে। পরে ব্র্যান্ডভ্যালু বাড়িয়ে লাভে আসে এসব কোম্পানি। কিন্তু ইভ্যালির ক্ষেত্রে মনে হচ্ছে, তারা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বিজনেস মডেলে গেছে।

কয়েক মাস আগে অভিযোগ ওঠে, ইভ্যালি ক্রেতাদের সময়মতো পণ্য সরবরাহ করতে পারছে না। কয়েক হাজার গ্রাহক ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করেন। অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিযোগ করেন। এরপর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে একটি তদন্ত করার অনুরোধ করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে দেখা যায়, চলতি বছরের ১৪ মার্চ পর্যন্ত ক্রেতা ও সরবরাহকারীদের কাছে ইভ্যালির দায়ের পরিমাণ ৪০৩ কোটি টাকা। আর কোম্পানির চলতি সম্পদের মূল্য ৬৫ কোটি টাকা। ওই প্রতিবেদনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, গ্রাহকদের থেকে ২১৪ কোটি টাকা আগাম নিয়ে পণ্য সরবরাহ করেনি ইভ্যালি। এ ছাড়া ওই সময় পর্যন্ত সরবরাহকারীদের পাওনা ১৯৯ কোটি টাকাও পরিশোধ করেনি কোম্পানিটি। এরপর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইভ্যালির কাছে দায়দেনার তথ্য জানতে চায়। ইভ্যালি তিন দফায় দায়দেনার তথ্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দিয়েছে।

মার্চেন্টদের পাওনা ২০৬ কোটি টাকা: গত ২ সেপ্টেম্বর সর্বশেষ এক চিঠিতে মার্চেন্টদের (যেসব ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য নিয়ে ক্রেতাদের সরবরাহ করেছেন) পাওনার তথ্য জানিয়েছে ইভ্যালি। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, মার্চেন্টদের কাছে তাদের ২০৬ কোটি টাকা দেনা রয়েছে। তবে কতজন মার্চেন্ট এই টাকা পাবেন, তা জানায়নি। পাশাপাশি ইভ্যালি তার গ্রাহকদের কাছে ৩১১ কোটি টাকা দেনা রয়েছে বলে জানিয়েছে। আগামী পাঁচ মাসের মধ্যে ব্যবসায়িক স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা ও কাঙ্ক্ষিত বিনিয়োগ লাভের মাধ্যমে পরিশোধ করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল।

এ বিষয়ে গতকাল বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ সাংবাদিকদের বলেন, ইভ্যালির জবাব পাওয়া গেছে। বিষয়টি দেখার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কোম্পানিটির দায়, বিজনেস পলিসি বিশ্লেষণ করতে কমিটি অবিলম্বে সভায় বসবে এবং এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হাফিজুর রহমান এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ইভ্যালির বিভিন্ন তথ্য চাওয়া হয়েছিল। সব তথ্য পাওয়া গেছে। এখন এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে গঠিত কমিটি সভা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে। এ সপ্তাহে কমিটির বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল দেখা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার সঙ্গে সাক্ষাৎ বা আলোচনার আপাতত কিছু নেই। মন্ত্রণালয় একজন আইনজীবী নিয়োগ করেছে, তিনি (রাসেল) আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করতে পারবেন। তিনি আরও বলেন, সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে মনে হচ্ছে দুই লাখের বেশি ক্রেতা, কয়েক হাজার সরবরাহকারীর স্বার্থ রক্ষায় আইনের আশ্রয় নিতে হবে।

জবাবে ইভ্যালি জানিয়েছে, তারা মার্চেন্টদের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক পদ্ধতিতে ব্যবসা করছে। ইভ্যালিতে বিক্রি হওয়া পণ্য থেকে মার্চেন্টরা ১৫ থেকে ২০ শতাংশ মুনাফা করেন। মার্চেন্টদের বকেয়া পরিশোধের সময়সীমার বিষয়ে কিছু উল্লেখ করেনি ইভ্যালি।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধে গত ৮ জুলাই ইভ্যালির বিরুদ্ধে গ্রাহকদের কাছ থেকে আগাম নেওয়া প্রায় ৩৩৮ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তদন্ত শুরু করে দুদক। এর আগে গত ৪ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, দুদক, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের কাছে আলাদা চিঠি পাঠায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। চিঠিতে গ্রাহকদের কাছ থেকে আগাম টাকা নেওয়ার পর পণ্য সরবরাহ না দেওয়া ও বিভিন্ন ব্যবসায়ীর পণ্য নেওয়ার পর টাকা না দেওয়ার অভিযোগে ইভ্যালির বিরুদ্ধে তদন্তের ভিত্তিতে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মনে করে, ইভ্যালি টাকা সরিয়ে নিতে পারে।সূত্র: সমকাল

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত