মাস্টার্স পাস যুবকের যে পোস্ট ভাইরাল

| আপডেট :  ২৭ জানুয়ারি ২০২২, ০৭:০৩  | প্রকাশিত :  ২৭ জানুয়ারি ২০২২, ০৭:০৩

‘শুধুমাত্র দু-বেলা ভাতের বিনিময়ে পড়াতে চাই’—এমন লেখা সংবলিত একটি পোস্টার দুই দিন হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ঘুরছিল। বলা যায় পোস্টারটি ফেসবুকে একপ্রকার ভাইরাল হয়ে গেছে।

টিউশনির জন্য এমন একটি পোস্টার লাগিয়েছেন বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের শিক্ষার্থী মো. আলমগীর কবির। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। এখন লড়াই করে যাচ্ছেন চাকরির জন্য। জয়পুরহাটের পাঁচবিবিতে কৃষক পরিবারে তাঁর জন্ম। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি।

আলমগীর কবির তাঁর পোস্টারে লিখেছেন, ‘শুধুমাত্র দু-বেলা ভাতের বিনিময়ে পড়াতে চাই।’ সকাল ও দুপুরের খাবারের বিনিময়ে তিনি পড়াবেন। এ ছাড়া তিনি লিখেছেন, প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত গণিত ব্যতীত সবকিছুই পড়াবেন। সেই পোস্টারে নিজের পেশা হিসেবে লিখেছেন ‘বেকার’। এতে তাঁর নাম ও মোবাইল নম্বর দেওয়া আছে।

আলমগীর কবিরের সঙ্গে কথা হয় আজকের পত্রিকার। নিজের পোস্টারটি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনের তাগিদে এই পোস্টার লাগিয়েছি। আমার বন্ধুদের অনেক দিন হলো টিউশনির কথা বলছি, কিন্তু তারা দিতে পারছে না। এর মধ্যে আমি একটা টিউশনি পাই। সেখানে দেড় হাজার টাকা বেতন দেয়। কিন্তু এই টাকা দিয়ে হয় না। আমার পরিবারের অবস্থাও ভালো না।’

কবির বলেন, ‘আমি চাচ্ছিলাম নিজে কিছু একটা করি। আমার এই টাকা দিয়ে হচ্ছে না। আমাকে মাঝেমধ্যেই ঢাকায় যেতে হয়, পরীক্ষা দিতে। আমার কিছু জমানো টাকা ছিল, যা দিয়ে বেশ কয়েকবার ঢাকায় গিয়ে পরীক্ষা দিয়েছি। এখন ধার-দেনা করে চলছি। অনেক ঋণের মধ্যে আছি আমি। গত মাসে একাধিকবার (বিভিন্ন চাকরি পরীক্ষার) ভাইভা দিতে ঢাকায় যেতে হয়েছে। অনেক টাকা খরচ হয়েছে।’

মাসুদ রানা: আমেরিকার আফগান-প্রস্থান ও প্রাসঙ্গিক বাঙালিত্বের কথা ≣ [১] করোনা সংক্রমণ রোধে চলমান বিধিনিষেধ আরও এক মাস বাড়তে পারে ≣ [১] কালীগঞ্জে ১৪টি ভেড়ার মৃত্যু, খামার দম্পতির পাশে দাঁড়ালো পুলিশ
দুই বেলা ভাতের বিনিময়ে যিনি পড়াতে চান, সেই আলমগীর থাকেন কোথায়? মেসে? না, একটি বাসায়। আগে মেসে থাকতেন। কিন্তু চলতে কষ্ট হচ্ছিল। মেসে থাকা-খাওয়ার জন্য তো অনেক টাকা দরকার। তিনি তখন চাকরির কোচিং করতেন। তাঁর সঙ্গে একটি মেয়ে পড়তেন। তাঁদের বাসা তাঁর মেসের পাশেই ছিল। ওই মেয়ের পরিবার সেখানে বেশি থাকে না। এখানে সব ভাড়া দিয়ে তাঁরা ঢাকায় থাকেন। কবির সেই মেয়েকে তাঁদের বাসায় থাকার ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করেন। মেয়েটি তাঁর বাবার সঙ্গে কথা বলতে বলেন কবিরকে। তাঁর বাবার সঙ্গে কথা বললে তিনি কবিরকে থাকার জায়গা দেন। সেখানেই এখন থাকেন তিনি। তাই মাথার ওপর একটা ছাদ থাকলেও তিন বেলা খাবারের সংস্থান নেই তাঁর। এ জন্যই তাঁর এই বিজ্ঞাপন।

একটা চাকরির জন্য বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করে টাকা জোগাড় করে আলমগীর কবির ছুটে বেড়ান এদিক-ওদিক। সরকারি চাকরির বয়স চলে গেছে করোনার শুরুর বছরই। ২০২০ সালের আগ পর্যন্ত সরকারি চাকরির জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন, যেমনটা করেন বাংলাদেশের আর দশটা শিক্ষিত তরুণ। কিন্তু সেই তরুণদের মধ্যে সফল গুটিকয়েকের একজন হতে পারেননি আলমগীর কবির, যেমন অধিকাংশই পারেন না। সোনার হরিণ সরকারি চাকরি তো আর সবার ভাগ্যে জোটে না। কেন জোটে না। শুধুই কি যোগ্যতার অভাব? আলমগীর কিছুটা বলেন, অনেকটাই বলেন না। শুধু ইঙ্গিতে বোঝান নিয়োগে আর্থিক লেনদেন, পরিচয়, লবিং ইত্যাদি নানা বিষয়ের কথা। কিন্তু বলেন না। শুধু বলেন, সরকারি চাকরি হলো না। বেসরকারি চাকরিই ভরসা এখন। কিন্তু সেখানেও।

আলমগীর ডাক পান বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে। তারা ভাইভা নিতে ডাকে। আর ধারদেনা করে রাজধানীর উদ্দেশে ছোটেন আলমগীর। কিন্তু বরাবরের মতোই তাঁকে ফিরতে হয় শূন্য হাতেই; কোনো নিয়োগপত্র ছাড়াই। এই দুঃসময় পাড়ি দিতে অন্য সব মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের তরুণদের মতো তাঁরও ভরসা টিউশনি। ঘরে ঘরে গিয়ে স্কুল বা কলেজের শিক্ষার্থী পড়িয়ে এ দেশের কত তরুণ যে নিজেকে বিরুদ্ধ স্রোতে টিকিয়ে রাখেন, তা বলবার নয়। আলমগীরও সেভাবেই চেষ্টা করছেন। কিন্তু পেরে উঠছেন না। একটি টিউশনি থেকে পাওয়া টাকায় নিজে চলা কঠিন হয়ে পড়েছে। না খেয়েও থাকতে হচ্ছে কখনো কখনো। আর এমন বাস্তবতা থেকেই এ ধরনের পোস্টারের চিন্তা মাথায় আসে।

আলমগীর কবির বলেন, ‘আমি যেখানে টিউশনি করাই, সেখানে রাতে নাশতা দিত। আমি তাদের বলেছিলাম, রাতে নাশতা না দিয়ে একটু ভাত দিতে; তাহলে আমার রাতে খাবারের চিন্তাটা থাকবে না। তো রাতের খাবারের ব্যবস্থা তো হলোই। এখন চিন্তা ছিল সকাল ও দুপুরের খাবারের। যেহেতু টিউশনি পাচ্ছি না। আর দেড় হাজার টাকায় নিজের হাত খরচ ও সকাল-দুপুরের খাবার জোগাড় সম্ভব না। আমি অনেক দিন না খেয়েও থেকেছি। রাতে গিয়ে ছাত্রের বাসায় খেয়েছি।’

কথাগুলো হয়তো খুব সহজে পড়ে যাওয়া গেল, কিন্তু এই কথা আলমগীরের পক্ষে বলাটা সহজ ছিল না। আর এর যে উৎস সেই অভাব ও ক্ষুধার অভিজ্ঞতা তো একেবারেই সহজ নয়। এই কঠিন বাস্তবতার কথা বলতে গলা ধরে আসছিল আলমগীর কবিরের। তিনি বলেন, ‘উপায় না পেয়ে আমি দুই বেলা খাবারের বিনিময়ে টিউশনি করার সিদ্ধান্ত নিই। এর পর এই পোস্টার লাগাই। আমি পোস্টার বেশি লাগাইনি। যেখানে থাকি, সেই গলিতে ৮-১০টা পোস্টার লাগিয়েছি, যাতে বাসার পাশে এক-দুইটা বাচ্চাকে পড়াতে পারি। আমার দুবেলা খাবারও হবে, আর যে টাকা পাব তাতে কোনোমতে হাতখরচ হবে।’

বেকারত্ব নিয়ে খুব একটা বাজে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন আলমগীর কবির। নিজের হতাশার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি বেশ কয়েক দিন হলো খুব ডিপ্রেসড। অনেক দিন হলো নিজের চলার জন্য টিউশনি খুঁজছি; পাচ্ছি না। বন্ধুরা নানা কথা বলে। কেউ তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, গার্মেন্টসে কাজ করতে বলে। এসব কিছু থেকেই আমি এই পোস্টারটি করি।’

আগেই বলা হয়েছে আলমগীর কবির সরকারি চাকরির জন্য পড়ালেখা করেছেন। ২০২০ সালে তাঁর সরকারি চাকরির বয়স শেষ হয়ে যায়। এরপরই তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। সঙ্গে যোগ হলো করোনা এবং সেই সূত্রে বাবার অসুস্থতা। বললেন, ‘করোনা এসে আমার জীবন আরও কষ্টের করে তুলেছে। বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল করোনার প্রথম দিকে। তাঁর তো সামর্থ্য নেই। যা ছিল, তা দিয়ে নিজের চিকিৎসা করিয়েছেন। এখন কোনোমতে বেঁচে আছেন। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে আমিই ছোট।’

এমন পরিস্থিতিতে বন্ধুবান্ধবের কথায় হোক বা নিজের ইচ্ছাতেই হোক অনেকটা নিরুপায় হয়েই গার্মেন্টস কারখানায় যোগ দেন আলমগীর কবির। অবশ্য সেটা সরকারি চাকরির বয়স শেষ হওয়ার পরের ঘটনা। কিন্তু সে চাকরির অভিজ্ঞতা তাঁর ভালো হয়নি। তিনি বলেন, ‘কিছুদিন একটি গার্মেন্টসে কাজ করেছি। কিন্তু খুব ছোট পোস্টে। আমি স্নাতকোত্তর পাস করা একজন ছেলে। কিন্তু আমার সঙ্গে যে ভাষায় তারা কথা বলত, তা মানতে পারিনি। পরে সেটা ছেড়ে দিছি।’

এখন কী করছেন তাহলে? শুধু টিউশনি? না আলমগীর কবির এখন টিউশনি করছেন ঠিক, সঙ্গে বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির আবেদন করছেন। কবির বলেন, ‘বেসরকারিতে আবেদন করলে তারা ভাইভাতে ডাকে। টাকা খরচ করে ঢাকায় গিয়ে ভাইভা দিই। তারা বলে, অভিজ্ঞতা নেই এটা-সেটা। চাকরি না দিলে অভিজ্ঞতা কোথায় পাব। আমি গ্রামের ছেলে; তারপর আবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়া। সব মিলিয়ে নানা বিড়ম্বনা।’

আলমগীর কবির বলেন, ‘আমার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। আর পারছি না। বেকারত্ব যে কত কষ্টের, তা বলে বোঝাতে পারব না। এই বয়সে বাবার কাছ থেকে টাকা চাইতেও লজ্জা করে। আর পরিবারের যে অবস্থা, আমাকে কিছু দিতেও পারবে না তারা।’ নিজের উদাহরণ টেনেই তিনি বলেন, ‘একজন কবির সারা দেশের বেকারদের প্রতিচ্ছবি। আমাকে তো বাঁচতে হবে।’

পোস্টারের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে অনেকেই তাঁকে ফোন দিয়েছেন, সহায়তা করতে চেয়েছেন। এই ছবির নিচে করা মন্তব্যে একেকজন একেক কথা বলেছেন। কেউ কেউ তাঁকে ফোন দিয়ে সহায়তা করতে চেয়েছেন। কিন্তু আলমগীর কবির কারও করুণা চান না। বললেন, ‘আমাকে অনেকে ফোন দিয়ে বলেন, “বিকাশ নম্বর দেন; টাকা পাঠাই কিছু। ” কিন্তু আমি তো দান পাওয়ার জন্য এই পোস্টার দিইনি। সিমপ্যাথি চাই না। আমাকে কাজ দিন। আমাকে আপাতত একটি টিউশনি দিন। আমাকে ভালোভাবে বাঁচার ব্যবস্থা করে দেন। দান চাই না।’

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত