মিনিকেট নাজিরশাইল আর থাকছে না, ধানের নামেই থাকবে চালের নাম

| আপডেট :  ১৭ জানুয়ারি ২০২২, ০৮:০৬  | প্রকাশিত :  ১৭ জানুয়ারি ২০২২, ০৮:০৬

দেশের বাজারগুলোতে সয়লাব হয়ে আছে মিনিকেট, নাজিরশাইল চাল। অথচ এসব নামে কোনো ধানই নেই বাস্তবে। এ নামের ধান যেমন দেশের কোথাও আবাদ হয় না, তেমনি এগুলো কেউ আমদানিও করে না। তারপরও বাজারে মিনিকেট ও নাজিরশাইল নামে চালের ছড়াছড়ি।

কৃষিবিজ্ঞানীরা বলছেন, মূলত দেশে উৎপাদিত ব্রি-২৮ ধানকেই মিলগুলো নিজেদের ইচ্ছামতো কেটে, মিক্স ও ওভারপলিশ করে নানা নামে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী ব্র্যান্ডিং করা হচ্ছে। ফলে মানুষ অবাস্তব ধানের চিকন চালের নামে প্রতারিত হচ্ছে। এই প্রতারণা বন্ধে আদালতেরও নির্দেশনা রয়েছে। এমতাবস্থায় প্রতিটি ধানের নামে চালের ব্র্যান্ডিং করতে নীতিমালা করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সম্মিলিতভাবে এ নীতিমালা নিয়ে কাজ করছে কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়।

এর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর। তিনি বলেন, ‘মিনিকেট ও নাজিরশাইলের নামে বাজারে যেসব চাল পাওয়া যাচ্ছে তা আদতে ‘ব্রি-২৮’ ও ‘ব্রি-২৯’ ধানের চাল। এসব প্রতারণা ঠেকাতে কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয় যৌথভাবে কাজ করছে। ভৌতিক ধানের নামে চালের ব্র্যান্ডিং বন্ধ করতে নীতিমালা করতে যাচ্ছে সরকার। সেখানে চাল পলিশ করার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকবে। শিগগিরই এ নীতিমালার খসড়া প্রকাশ করা হবে।’

এই প্রতারণা বন্ধে আইন করার তাগিদ দিয়েছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। তিনি বলেন, ‘মেশিনে চাল পলিশিং করে আকর্ষণীয় করে মিল মালিকরা প্রতারণা করছেন। চাল পলিশিং করে মিলগুলো চালকে চিকন করে। এতে অনেক পুষ্টিগুণ চাল থেকে চলে যায়। একটি অগ্রসরমান অর্থনীতিতে এমন প্রতারণা মানা যায় না। চালের জাতের ওপর গুরুত্ব না দিয়ে মিলগুলো নিজেদের মতো ব্র্যান্ড দাঁড় করিয়ে ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। এটা আইন করে বন্ধ করা উচিত।’

গত ৮ জানুয়ারি একটি গণমাধ্যম আয়োজিত ‘বায়োফর্টিফায়েড জিঙ্কসমৃদ্ধ ব্রি ধানের বাজার সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেন। এর আগে গত ২০ ডিসেম্বর সচিবালয়ে আন্তর্জাতিক নিউট্রিশন অলিম্পিয়াড উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে দেশে মিনিকেট নামে কোনো ধান নেই। সরু মিনিকেটের ক্ষেত্রে জিরাশাইল, শম্পাকাটারি এ দুই রকমের ধানটাই বেশি। এমনকি নাজিরশাইল নামে কোনো ধান নেই। আপনারা লিখুন- এই সাদা চকচকে চালে কোনো পুষ্টি নেই। লাল চাল খান।’ একই অনুষ্ঠানে খাদ্য সচিব ড. নাজমানারা খানুম বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে একটা রিসার্চ ওয়ার্ক করেছি। এটা সত্যি বাজারে মিনিকেট নামে চাল বিক্রি হচ্ছে, কিন্তু মিনিকেট নামে ধানও নেই। আমরা এ বিষয়ে কাজ করছি।’

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ ও প্রচলিত ধারণা আছে, মোটা চাল কেটে চিকন করে বেশি দামে বিক্রি করে ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণা করছেন এক শ্রেণির অসাধু মিল মালিক। এই অসাধু চক্র ক্রেতার পকেট থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল অঙ্কের অর্থ। এই প্রতারণা রোধে বাজারে থাকা চালের উৎস ধানের জাত নির্ণয়ের উদ্যোগ নেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। প্রচুর ধান উৎপাদন হয়-এমন ২১ জেলায় সমীক্ষা চালান খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ১৩ কর্মকর্তা। গত বছরের জুনে তারা এই সমীক্ষা প্রতিবেদন জমা দেন। এতে বলা হয়- আধুনিক প্রযুক্তি গুণে ‘ব্রি-২৮’ ও ‘ব্রি-২৯’ ধানের চালই বাজারে ধুমছে বিক্রি হচ্ছে এসব নামে। স্থান-কাল-পাত্রভেদে একই চাল ভিন্ন ভিন্ন নামে ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী বস্তাবন্দি হচ্ছে আড়তগুলোতে। যে চাল কুষ্টিয়ায় ‘নাজিরশাইল’ হিসেবে বস্তায় ঢুকছে, ওই চালই হয়তো বগুড়ায় ‘মিনিকেট’ ও শেরপুরে ‘কাজল’ নামে বস্তাবন্দি হচ্ছে ভিন্ন কোম্পানির ব্র্যান্ডে। তবে মোটা চাল কেটে চিকন করা হচ্ছে-এমন অভিযোগের কোনো সত্যতা মেলেনি।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, দেশে বোরো ও আমন মৌসুমে ব্যাপকভাবে চাষ হয় ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ ধান। কিন্তু বাজারে এই নামে কোনো চাল নেই। বাজারে মিনিকেট ও নাজিরশাইল নামে চাল পাওয়া যায়। কিন্তু এই নামে ধানের কোনো জাত নেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্রি-২৮ ও কিছু ক্ষেত্রে ব্রি-২৯ ধান কেটে ‘মিনিকেট’ নামে বাজারজাত করা হয়। একইভাবে ব্রি-২৯ ধান অধিক ছাঁটাই ও পলিশ করে চালের নাম দেওয়া হয় ‘নাজিরশাইল’। মিনিকেট, নাজিরশাইল, কাজল প্রভৃতি নামে যেসব চাল বাজারে বিক্রি হচ্ছে, তা একই জাতের ধান থেকে তৈরি। এসব নামে ধানের কোনো জাত নেই বাস্তবে। ‘নাইজার শাইল’ নামে এক ধরনের ধান স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হলেও তা পরিমাণে খুবই কম, যা বাজারে মেলে-না সচরাচর।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফলিত গবেষণা বিভাগের প্রধান ড. মো. হুমায়ুন কবীর বলেন, বাংলাদেশে মিনিকেট জাতের কোনো ধানও নেই, চালও নেই। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট আজ পর্যন্ত এই জাতের কোনো ধান উদ্ভাবনও করেনি। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও মিনিকেট জাতের কোনো ধান নেই। তবে ভারত সরকারের কৃষি বিভাগ তাদের ধান উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সে দেশের ধান চাষিদের মাঝে সার, কীটনাশকসহ বিভিন্ন উপকরণের প্রণোদনা প্যাকেজ দেয়, তারা সেটাকে ‘মিনিকিট’ বলে থাকে। সেই মিনিকিট শব্দটাকে পুঁজি করেই হয়তো বাংলাদেশে মিনিকেট শব্দটা প্রচলিত করেছেন অসাধু চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীরা।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত