মিলেমিশে কমার্স ব্যাংকের ৪৫ কোটি টাকা লুট

| আপডেট :  ৩০ জুলাই ২০২২, ০৭:৩৫  | প্রকাশিত :  ৩০ জুলাই ২০২২, ০৭:৩৫

ব্যাংক হিসাবে কোনো টাকা নেই। কিন্তু ক্লিয়ারিং ভাউচারে ম্যানেজার স্বাক্ষর করে দেওয়ার পর আট চেকে ২০ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়। আর সেই টাকা তুলে আত্মসাৎ করেন চার ব্যবসায়ী। এখানেই শেষ নয়, লাগামহীনভাবে ক্ষমতাবহির্ভূত জামানতবিহীন সীমা অতিরিক্ত টাকা ঋণ নিয়ে তাঁরা লোপাট করেছেন। এ ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের (বিসিবি) চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ শাখায়। ওই শাখার এক ম্যানেজারের প্রত্যক্ষ মদদে ১৪ বছরে ৪৫ কোটি টাকা লুটপাট করেছেন কথিত ব্যবসায়ী নূর-উন-নবী ও তাঁর তিন সহযোগী। অনুমতি ছাড়াই ঋণের নামে ব্যাংক ম্যানেজার ও চার ব্যক্তি মিলেমিশে লুটপাট করছেন ৪৫ কোটি টাকা, যা এখন সুদ-আসলে ১০৫ কোটি টাকায় পৌঁছেছে।

গত সোমবার লুটপাটের প্রধান আসামি কমার্স ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার তৎকালীন ম্যানেজার মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিনের জামিন নামঞ্জুর করেন আদালত। চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ ড. বেগম জেবুননেছার আদালত এ আদেশ দেন।

দুর্নীতি মামলার দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিচালক মোহাম্মদ সিরাজুল হক বলেন, ব্যাংক ম্যানেজারের সরাসরি সহায়তায় চার আসামি ব্যাংকের ৪৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। চার্জশিটে জালিয়াতির পুরো চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

লুটপাটে জড়িত যাঁরা: কমার্স ব্যাংকের সুদ-আসলে ১০৫ কোটি টাকা আত্মসাতের দুর্নীতিতে দুদকের তদন্তে অভিযুক্ত হন চার কথিত ব্যবসায়ী ও এক ব্যাংক ম্যানেজার। তাঁরা হলেন আগ্রাবাদ শাখার সাবেক ম্যানেজার মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিন। তিনি এখন ঢাকার শেওড়াপাড়ার রেড ক্যাসেল ভবনের এইচ-৫ ফ্ল্যাটে বসবাস করেন। মেসার্স আক্তার এন্টারপ্রাইজের মালিক নূর-উন-নবী চট্টগ্রামের হালিশহর হাউজিং এস্টেট কে-ব্লক ১ নম্বর রোডের ১১ নম্বর নূর উর রহমান হাউসের বাসিন্দা। শরীফ আহমেদ কুমিল্লা জেলার বুড়িচং থানার মারশা গ্রামের রফিজ আহমেদের ছেলে। আনোয়ার মিয়া পটিয়ার ধলঘাটের রতনপুর গ্রামের মৃত সিদ্দিক আহমেদের ছেলে এবং আবদুল মজিদ কুমিল্লার শাহবাজপুর ব্যাপারীপাড়ার টাকাই গ্রামের মৃত সুজাত আলীর ছেলে।

একাই আত্মসাৎ করেন ২৩ কোটি: মেসার্স আক্তার এন্টারপ্রাইজের মালিক নূর-উন-নবী। ২০০২ থেকে ২০১৫ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত কমার্স ব্যাংক চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ শাখা থেকে তিনি একাই আত্মসাৎ করেছেন ২২ কোটি ৯১ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। শুধু তিনিই নন; তাঁর চক্রে আছে তিন সহযোগী। জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতে তাঁদের সরাসরি সহযোগিতা করেন ব্যাংকের তৎকালীন ম্যানেজার মুহম্মদ নিজাম উদ্দিন। চক্রের মূল হোতা নূর-উন-নবীসহ চার কথিত ব্যবসায়ীর আত্মসাৎ করা অর্থ সুদ-আসলে এখন পৌঁছেছে ১০৪ কোটি ৫৭ লাখ ৪৭ হাজার টাকায়।

এর মধ্যে আক্তার এন্টারপ্রাইজের নামে নূর-উন-নবী ডিমান্ড লোন ঋণ দেখিয়ে ১৭ কোটি ৪৫ লাখ ২০ হাজার টাকা, কাজী শরীফ আহমেদ এসওডি লোন দেখিয়ে ৭৫ হাজার টাকা ও ফোর্সড লোন দেখিয়ে ১০ কোটি ১৫ লাখ ৯৯ হাজার টাকা, আবদুল মজিদ এসওডি লোন ৬৯ লাখ ২২ হাজার টাকা, শাহজালাল ট্রেডার্সের নামে আনোয়ার মিয়া ফোর্সড লোন দেখিয়ে ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা, আনোয়ার মিয়ার নিজ নামে এসওডি লোন দেখিয়ে ১২ কোটি ৭৪ লাখ টাকাসহ মোট ৪৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন।

আট চেকে লোপাট ২০ কোটি: কমার্স ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখায় নগরের দেওয়ানহাট শাখা সোনালী ব্যাংক মিঠাগলি শাখার ২০ কোটি ২৭ লাখ টাকার আটটি চেক জমা দেন গ্রাহক কাজী শরীফ আহমেদ ও শাহজাহাল ট্রেডার্সের মালিক আনোয়ার মিয়া। সোনালী ব্যাংকের চেকগুলো কমার্স ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ম্যানেজার মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিন গ্রহণ করেন। চেকগুলো গ্রহণ করার পর নিয়মনীতি ভঙ্গ করে জাল-জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে ক্লিয়ারিং হাউসে প্রেরণ করার আগেই গ্রাহকদের হিসাবে ২০ কোটি ২৭ লাখ টাকা জমা করে দেন ম্যানেজার।

পরে তিনটি চেক ক্লিয়ারিংয়ের জন্য সোনালী ব্যাংক মিঠাগলি শাখায় পাঠানো হলেও সোনালী ব্যাংক থেকে অপর্যাপ্ত তহবিলের জন্য চেকগুলো ডিজঅনার হয়ে ফেরত পাঠানো হয়। সোনালী ব্যাংক চেকগুলো পাস না করলেও কমার্স ব্যাংক ম্যানেজার চেক ক্লিয়ারিং ভাউচারে স্বাক্ষর করে গ্রাহকদের ২০ কোটি ২৭ লাখ টাকা উত্তোলন করার সুযোগ করে দেন। তাঁরা ২০ কোটি ২৭ লাখ টাকা তুলে আত্মসাৎ করেন। এর মধ্যে ২০০৬ সালের ২৩ নভেম্বর কাজী শরীফ চেকে ২ কোটি ৯৭ লাখ টাকা, ২৬ নভেম্বর চেকে ২ কোটি ৯৮ লাখ, ২৭ নভেম্বর চেকে ২ কোটি ৯৭ লাখ, ২৮ নভেম্বর চেকে ২ কোটি ৯৬ লাখ, ২৯ নভেম্বর চেকে ২ কোটি ৯৫ লাখ, ২৯ নভেম্বর চেকে ২ কোটি ১৫ লাখ ও ১০ ডিসেম্বর শাহজালাল ট্রেডার্সের নামে ২ কোটি ৮২ লাখ, শাহজালাল ট্রেডার্সের নামে ৪৬ লাখ টাকাসহ মোট ২০ কোটি ২৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয় বলে দুদকের তদন্তে উঠে আসে।

আনোয়ারের পেটে সাড়ে ১৫ কোটি: এক দিনেই পাঁচটি চেকে তিন কোটি টাকা তুলে নেন আনোয়ার মিয়া। এভাবে ১০টি চেকের মাধ্যমে আনোয়ারের পেটে যায় সাড়ে ১৫ কোটি টাকা। ২০০৬ সালের ১০ ডিসেম্বর আল আমিন এন্টারপ্রাইজের নামে তিনটি চেকে ১ কোটি ২৪ লাখ, ৭৬ লাখ ও ৩৬ লাখ টাকা, ১৯ ডিসেম্বর আক্তার এন্টারপ্রাইজের নামে ৯৯ লাখ ৮৬ হাজার, ২০ ডিসেম্বর নগদে ২০ লাখ, ২১ ডিসেম্বর এক দিনেই পাঁচটি চেকে শাহজালাল ট্রেডার্স দুই কোটি ৯৮ লাখ, ২ কোটি ৯৭ লাখ, ৯১ লাখ, ২ কোটি ৯১ লাখ, ২ কোটি ২৫ লাখসহ মোট ১৫ কোটি ৫৮ লাখ ২১ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন।

অ্যাকাউন্ট খোলার পরদিনই ঋণ অনুমোদন: ২০০৬ সালের ২৭ মার্চ আব্দুল মজিদ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলেন। অ্যাকাউন্ট খোলার পরদিনই তিনি জামানতবিহীন এক কোটি টাকার ঋণ পেয়ে যান। তিন মাসের মাথায় চার কোটি টাকা ঋণও পান। সব ঋণই তিনি পেয়েছেন জামানতবিহীন নিয়মনীতি-বহির্ভূতভাবে। যদিও পরে চক্রের হোতা নূর-উন-নবীর মালিকানাধীন মেসার্স আক্তার এন্টারপ্রাইজের নামে ইস্যু করা চারটি ৫০ লাখ টাকা করে দুই কোটি টাকার এফডিআর মজিদের ঋণের বিপরীতে জামানত হিসেবে দেখানো হয়। এই ফাঁকে চক্রটি ব্যাংক ম্যানেজার মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিনের মদদে ২ কোটি ১৬ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন।
সমকাল

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত