যুবদল নেতা হত্যা: সেদিন যা ঘটেছিল

| আপডেট :  ১৫ জুলাই ২০২২, ০৮:২৪  | প্রকাশিত :  ১৫ জুলাই ২০২২, ০৮:২৪

যশোর শহরের শংকরপুর আকবারের মোড় এলাকায় জেলা যুবদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি বদিউজ্জামান ধোনিকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। অনেকের চোখের সামনেই নৃশংস এ ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই এ হত্যার বর্ণনা দিয়েছেন। তাদের বর্ণনায় জানা গেছে কী ঘটেছিল সেদিন।

এ হত্যার ঘটনায় যশোর পৌর বিএনপির আহবায়ক কমিটির সদস্য শামীম আহমেদ মানুয়ার (৪৮) সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠেছে। শামীম আহমেদ মানুয়ার জামাতা যুবলীগ নেতা সোহাগ হত্যা মামলার আসামি ছিলেন বদিউজ্জামান ধোনি। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জেরে ধোনিকে দলীয় প্রতিপক্ষ হত্যা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে এ হত্যাকাণ্ডের সময় ঘটনাস্থলে একটি চায়ের দোকানে বসে ছিলেন আব্দুল ওয়াদুদ ওরফে পিন্টু বিশ্বাস নামের এক ব্যক্তি। পুরো ঘটনাটি তিনি দেখেছেন।

নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সময়ে নিজের জীবন বাজি রেখে সবার আগে যুবদল নেতা ধনিকে বাঁচাতে যান আব্দুল ওয়াদুদ ওরফে পিন্টু বিশ্বাস। চোখের সামনে তরতাজা একটি প্রাণকে বাঁচাতে না পারায় তিনি স্তব্ধ ও মর্মাহত। তার দাবি, পুরো ঘটনাটি ঘটেছে মাত্র চার থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে। আর এই কিলিং মিশনে ঘটনাস্থলে অংশ নেয় ২০ থেকে ২২ বছর বয়সী তিন যুবক।

তিনি জানান, মঙ্গলবার বেলা ১১টার একটু পর ধোনির বাসার সামনে শহরের শংকরপুর চোপদারপাড়া আকবরের মোড়ে ইউসুফের চা দোকান থেকে চা খেয়ে পাশেই স্থানীয় শান্তি কমিটির অফিসে বসেছিলেন যুবদল নেতা ধোনি। বেলা ১১টা ২০ বা ১১টা ২২ দিকের আনসার ক্যাম্পের দিকে থেকে একটি রিকশায় ২০ থেকে ২২ বছর বয়সী তিনজন যুবক এসে শান্তি কমিটি অফিসের সামনে দাঁড়ায়। ওই তিন জনের মধ্যে এক যুবক শান্তি কমিটির অফিসের মধ্যে থেকে ধোনির জামার কলার ধরে বের করে নিয়ে আসেন। এর পর সড়কের পরেই ধোনির ডান পায়ে রামদা দিয়ে একটি কোপ মারে এক যুবক। পরে ধোনিকে টানতে টানতে ধনির বাসার সামনে বৌরানী ফার্মেসির সামনে নিলে ধোনি পড়ে যায়। এর পর তিন যুবকের মধ্যে দুই যুবক ওই ফার্মেসির সামনে এলোপাথাড়ি কোপাতে থাকেন। একইসঙ্গে ছুরিকাঘাতও করতে থাকেন।

তিনি আরও বলেন, এই হত্যাকাণ্ডে ঘটনাস্থলে তিন যুবক থাকলেও টিশার্ট (গেঞ্জি) পরিহিত এক যুবক অন্য দুই যুবককে নিরাপত্তার পাহারা দিচ্ছিলেন। তাদের হাতে বড় হাশুয়া, একটি বড় রামদা ও দুইজনের হাতে দুটি চাকুও ছিল।

কিছুটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পঞ্চাশোর্ধ এই প্রত্যক্ষদর্শী আরও বলেন, আমার চোখের সামনে লোকটা মারা গেল। খুব ভালো মানুষ ছিল মানুষটা। বাঁচাতে পারলাম না।

কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে তিনি বলেন, চা খেয়ে আমিও দোকানে বসেছিলাম। তার চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আমি দৌড়ে যায় ধোনির কাছে। কাছে যেতেই ওই তিন যুবক পালিয়ে যায়। পালানোর সময়ে ঠিক যেই পথ দিয়ে ওরা আসেন আনসার ক্যাম্পের দিকে স্বাভাবিকভাবে হেঁটে পালিয়ে যান তারা। তবে স্থানীয় বিএনপি নেতা শামীম আহমেদ মানুয়ার সঙ্গে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিরোধ ছিল। এই কারণেই এই হত্যাকাণ্ড হতে পারে বলে তিনি মনে করেন।

ওই তিন যুবক যে পথে পালাচ্ছিলেন ওই পথ নিয়েই ওই সময়ে ধোনিকে বাঁচানের জন্য এগিয়ে আসছিলেন স্থানীয় স’মিল শ্রমিক শাহজাহান শেখ ও রাজমিস্ত্রি শ্রমিক ফয়সাল হোসেন।

দুই প্রত্যক্ষদর্শী জানান, তারা যখন ধোনিকে বাঁচাতে আসছিলেন তখন তিন যুবকের মধ্যে একজন বড় রামদা উঠিয়ে বলেন- এগিয়ে আসলে তোদেরও লাশ ফেলে দিয়ে যাব। এখান থেকে চলে যা! এর পর হাঁটতে হাঁটতে ওই তিন যুবক পালিয়ে গেলে ধোনির কাছে যান তারা। সেখানেই রক্তাক্ত হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন ধোনি। হত্যাকাণ্ডের সময়ে ধোনি পরনে ছিল লুঙ্গি। পুরো লুঙ্গিই রক্তে ভিজে যায়। এর পরে তার স্বজনও স্থানীয়রা হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে।

এদিকে যশোরে প্রকাশ্য দিবালোকে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটনার পরে চোপদারপাড়া আকবরের মোড়ে মানুষের উপস্থিতি আগের মতো নেই বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। আতংকে অনেক দোকানপাট বন্ধ রয়েছে।

বুধবার বিকালে যেয়ে দেখা যায়, হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থলে রক্তের দাগ পড়ে রয়েছে। সেখানে অস্থায়ী বেদিতে কেন্দ্রীয় যুবদলের নেতৃবৃন্দদের ফুলের শ্রদ্ধা জানানো ফুল পড়ে রয়েছে। এদিন বিভিন্ন স্থান থেকে স্বজনেরা আসার পর বুধবার বেলা ১১টার দিকে শংকরপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে বেজপাড়া কবরস্থানে দাফন সম্পন্ন হয়।

একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এলাকায় সজ্জন হিসেবে পরিচিত থাকলেও যুবদল নেতা বদিউজ্জামান ধোনির বিরুদ্ধে হত্যাসহ সন্ত্রাসী বিরোধী ও বিস্ফোরক আইনে ১২টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে যুবলীগ কর্মী ইয়াসিন আরাফাত হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি ছিলেন ধোনি। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি বেজপাড়া ব্রাদার্স ক্লাবের সামনে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ইয়াসিন আরাফাত। এই মামলায় মাসখানেক আগে ধোনি জেল থেকে বের হয়েছেন।

স্থানীয়ভাবে যে মানুয়ার সঙ্গে নিজ দলীয় রাজনৈতিকভাবে ধোনি বিরোধ ছিল, তিনি এই ইয়াসিন আরাফাতের শ্বশুর।

নিহত যুবদল নেতার স্ত্রী একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শারমিন আক্তার বলেন, বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে যখন রান্নাঘরে রান্না করছিলাম। তখন রাস্তায় চিৎকারের আওয়াজ শুনে রাস্তায় বের হই। রাস্তায় বের হয়েই দেখি তার স্বামীকে কয়েকজন যুবক কুপিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। তবে কাউকে চিনতে পারেনি। তবে এই হত্যাকাণ্ড রাজনৈতিক বলে তিনি দাবি করেছেন। একইসঙ্গে তিনি এই হত্যার বিচার দাবি করেছেন।

তবে নিহতের শ্যালক তপু রহমান গণমাধ্যমের কাছে জানিয়েছেন, মঙ্গলবার বাসার সামনে বসেছিলেন বদিউজ্জামান ধোনি। এ সময় স্থানীয় সন্ত্রাসী রায়হান, রহিম, আকাশসহ ৪-৫ জন সন্ত্রাসী তার ওপরে অতর্কিত হামলা চালায়। দুর্বৃত্তরা তাকে উপর্যুপরি কুপিয়ে ফেলে রেখে চলে যায়। পরে স্থানীয়দের সহায়তায় তাকে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ভর্তির কিছুক্ষণ পর তিনি মারা যান।

তার দাবি, এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে শামীম আহমেদ মানুয়া নামে এক ব্যক্তি তার ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসীদের দিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। মানুয়াকে ধরতে পারলেই এই হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন হবে বলে তিনি মনে করেন।

এদিকে যশোর যুবদলের সিনিয়র সহসভাপতি বদিউজ্জামান ধোনি হত্যার ‘মাস্টারমাইন্ড’ নগর বিএনপির আহবায়ক কমিটির সদস্য শামীম আহমেদ মানুয়া। তার নির্দেশে ধোনিকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেছে পুলিশ।

মূলত এলাকায় বিএনপির দলীয় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিরোধে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। পাশাপাশি মানুয়ার জামাতা যুবলীগ কর্মী ইয়াসিন আরাফাত হত্যাকাণ্ডও ধোনিকে খুনের পেছনে ভূমিকা রেখেছে।

যশোরের পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়ারদার বৃহস্পতিবার দুপুরে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এ তথ্য জানান।

হত্যাকাণ্ডে জড়িত মামলার প্রধান আসামিসহ তিন যুবককে আটক করা হয়েছে। এ সময় হত্যায় ব্যবহৃত গাছি দা, চাইনিজ কুড়াল ও বার্মিজ চাকু উদ্ধার করা হয়।

গ্রেফতারকৃতরা হলেন, শহরের রেলরোড এলাকার ফরিদ মুন্সির ছেলে ও মানুয়ার ভাগনে রায়হান (২৫), শংকরপুর এলাকার বাবু মীরের ছেলে ইছা মীর (২০) এবং মামলার পাঁচ নম্বর আসামি আল আমিন (২০)। এদের মধ্যে আল আমিনকে র‌্যাব আটক করেছে।

গ্রেফতার ৩ জনের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে পুলিশ সুপার পুলিশ সুপার প্রলয় কুমার জোয়ারদার বলেন, স্থানীয় বিএনপি নেতা শামীম আহম্মেদ মানুয়া ও বদিউজ্জামান ধোনির মধ্যে এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আগে থেকেই দ্বন্দ্ব ছিল। এরই মধ্যে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি বেজপাড়া ব্রাদার্স ক্লাবের সামনে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন মানুয়ার জামাতা যুবলীগ কর্মী ইয়াসিন আরাফাত। ইয়াসিন আরাফাত হত্যা মামলায় ধোনিকে আসামি করা হয়।

‘সর্বোপরি এলাকায় দলীয় কোন্দল আর রাজনীতির আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে পরিকল্পিতভাবে ধোনিকে হত্যা করা হয়। মানুয়ার নির্দেশে তার ভাগনে রায়হান এই হত্যাকাণ্ডটি নেতৃত্ব দেন।

সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার আরও জানান, ধোনির বিরুদ্ধে হত্যা, সন্ত্রাসবিরোধী ও বিস্ফোরক আইনে ১২টি মামলা রয়েছে। স্থানীয় যুবলীগ কর্মী ইয়াসিন আরাফাত হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি তিনি। এই মামলায় মাসখানেক আগে ধোনি জেল থেকে বের হন। মানুয়া নামে বিএনপির যে নেতার সঙ্গে ধোনির বিরোধ ছিল, তিনি ইয়াসিন আরাফাতের শ্বশুর।

ধোনিকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় বুধবার রাতে নগর বিএনপির নেতাসহ ৮ জনের নাম উল্লেখ করে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন নিহতের ভাই মনিরুজ্জামান মনি। মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় আরও ৫/৬ জনকে আসামি করা হয়েছে।

আসামিরা হলেন, শহরের বেজপাড়া টিবি ক্লিনিক ফুড গোডাউনের সামনে আশ্রম রোডের আব্দুল আলীমের ছেলে আকাশ (২৫), মোহাম্মদ ফরিদের ছেলে রায়হান (২৪), শংকরপুর চোপদারপাড়া আকবরের মোড়ের মৃত আব্দুর রশিদের ছেলে ও যশোর নগর বিএনপির আহবায়ক কমিটির সদস্য শামীম আহমেদ মানুয়া (৪৮), টিবি ক্লিনিক ফুড গোডাউনের পাশের মিরাজুল বিশ্বাসের ছেলে মন্টু ওরফে অপূর্ব ওরফে আলী রাজ (২২), টিবি ক্লিনিক এলাকার রইস উদ্দিনের ছেলে আল আমিন ওরফে চোর আল আমিন (২৫), আফসারের ছেলে মিলন (২৪), শংকরপুর হারান কলোনির উত্তর পাশের বাবু মীরের ছেলে ইছা মীর (২০) এবং চোপদারপাড়া রোডের মৃত হুজুর ইয়াসিনের বাড়ির পাশের লাভলুর ছেলে রিজভী (২৬)।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত