যেসব কারণে ক্ষমা চান বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানরা

| আপডেট :  ১০ আগস্ট ২০২১, ০৫:৪১  | প্রকাশিত :  ১০ আগস্ট ২০২১, ০৫:৪১

রাষ্ট্র পরিচালনা নেহায়েত সহজ কাজ নয়। যুগে যুগে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে অনেকসময়ই ভুল করে বসেছেন বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানরা। ভুলের দায় নিয়ে অনেকে পদত্যাগ করেছেন। অনেকে জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়ে আরো জনপ্রিয় হয়েছেন। আবার অনেকে ক্ষমা চাওয়া তো দূর, নিজের ভুল স্বীকার করতেই রাজি হন নি। তবে আধুনিক সভ্যতার যুগে অনেক দেশের মন্ত্রী থেকে শুরু করে খোদ সরকারপ্রধানকেও নিজেদের ‘ভুল’ এর জন্য জনগণের কাছে হরহামেশাই ক্ষমা প্রার্থনা করতে দেখা গেছে। সাম্প্রতিককালের এমন কয়েকটি ঘটনায় চোখ বুলানো যাক-

গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী: ইউরোপের দেশ গ্রিসের দ্বিতীয় বৃহত্তম দ্বীপ এভিয়ায় দাবানল জ্বলছে দাউদাউ করে। এখনো তা নেভানো সম্ভব হয়নি। এই দাবানল মোকাবিলায় ব্যর্থতার জন্য ক্ষমা চেয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রী কিরিয়াকোস মিটসোটাকিস বলেছেন, “মানুষ হিসেবে যা করা সম্ভব, তার অনেক কিছুই হয়তো আমরা করেছি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে আমরা যথেষ্ট পদক্ষেপ নিতে পারিনি।”

মঙ্গলবার দাবানল ইস্যুতে টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যারা দোষী তাদের ছাড়া হবে না। শাস্তি দেয়া হবে। যাদের ঘরবাড়ি বা সম্পদ পুড়েছে, তাদের কষ্ট আমি বুঝি। এক অভূতপূর্ব প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা।”

জাপানের প্রধানমন্ত্রী: অতি সম্প্রতি জাপানের হিরোশিমা শহরে পারমাণবিক বোমা হামলার ৭৬ বছর পূর্তি উপলক্ষে শহরটিতে আয়োজিত বার্ষিক স্মরণ অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছিলেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদে সুগা। কিন্তু বক্তব্য পাঠের সময় তিনি ‘ভুলবশত’ পুরো একটি পাতা এড়িয়ে যান। পরে তিনি এমন ভুলের জন্য ক্ষমা চান।

বিস্তারিত খবরে জানা যায়, বাদ পড়া বক্তব্যে বিশ্বের একমাত্র দেশ হিসেবে জাপানের পারমাণবিক বোমা হামলার শিকার হওয়ার কথা উল্লেখ ছিল। তাছাড়া পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত বিশ্ব গড়ে তুলতে জাপানের লক্ষ্যের কথাও ছিল।

এর আগেও জানুয়ারির শুরুতে করোনা সংক্রমণের মধ্যে কয়েকজন আইনপ্রণেতার নাইটক্লাবে যাওয়ার ঘটনায় লজ্জিত হয়ে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চেয়ে জাপানের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, “প্রত্যেক আইনপ্রণেতার এমন আচরণ করা উচিত যাতে তারা জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেন। এ ঘটনায় আমি অত্যন্ত দুঃখিত। যেখানে আমরা জনগণকে বলছি রাত ৮টার পর বাইরে খেতে যাবেন না এবং জরুরি নয় বা না গেলেও চলে এমন কারণে বাড়ির বাইরে বের হওয়া এড়িয়ে চলুন।

নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী: প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলো থেকে একসময় বিপুলসংখ্যক অভিবাসী শ্রমিক এসেছিলেন নিউজিল্যান্ড এসেছিলেন দেশটির সরকারের আহ্বানে। অথচ অর্থনৈতিক সংকট ও বেকারত্বের অজুহাতে সত্তরের দশকে উল্টো তাদেরই দেশছাড়া করতে উঠেপড়ে লাগে সরকার। মোটামুটিভাবে ১৯৭৪ সাল থেকে এই দমন-পীড়ন শুরু হয়। সে সময় খুব ভোরে অভিবাসীদের বাড়িতে অথবা কর্মক্ষেত্রে হানা দিত পুলিশ। কারো ভিসা মেয়াদোত্তীর্ণ হলেই তাকে বের করে দেওয়ার জন্য নির্যাতন-নিপীড়ন চালানো হতো। ইতিহাসে এ ঘটনা ‘ডন রেইডস’ বা ‘ভোরের অভিযান’ বলে কুখ্যাত হয়ে আছে।

১৯৭৬ সালের দিকে এসব অভিবাসীর সংখ্যা ছিল অর্ধ লক্ষেরও বেশি। সময়ের সঙ্গে নিউজিল্যান্ড কর্তৃপক্ষের মূল্যবোধেও পরিবর্তন এসেছে। সেই সূত্র ধরেই দেশটির ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন পয়লা আগস্ট অকল্যান্ড শহরে এক অনুষ্ঠানে নির্যাতিত অভিবাসীদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চেয়েছেন।

ইরানের প্রেসিডেন্ট: জুলাইয়ের শুরুতে ইরানে তীব্র তাপদাহের মধ্যে বড় ধরনের বিদ্যুৎ বিভ্রাটের জেরে ব্যাপক সমালোচনা ও রাস্তায় শুরু হওয়া প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মুখে জনগণের কাছে ক্ষমা চান ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে প্রেসিডেন্ট বলেন, “আমি দেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চাইছি, যারা গত কয়েকদিনে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন ও ভোগান্তিতে পড়েছেন। আমি তাদেরকে (বিদ্যুতের ব্যবহার কমানোর মাধ্যমে) সহযোগিতা করার অনুরোধ জানাচ্ছি। জনগণ বিদ্যুৎ বিভ্রাট নিয়ে অভিযোগ করেছেন এবং তাদের অভিযোগ সঠিক।”

নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী: একটু আগেভাগেই করোনার বিধিনিষেধ শিথিল করায় জুলাই মাসে জনগণের কাছে ক্ষমা চান নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটে৷ সংক্রমণ কমায় এএ দুই সপ্তাহ আগে দেশটিতে কড়াকড়ি শিথিল করা হলেও এরপর আবারও সংক্রমণ বাড়ার প্রেক্ষাপটে তিনি ওই ক্ষমা চান।

প্রধানমন্ত্রী মার্ক রুটে বলেন, ‘‘আমরা যা সম্ভব হবে ভেবেছিলাম, দেখা যাচ্ছে বাস্তবে সেটা সম্ভব হচ্ছে না৷ আমরা ভুল ভেবেছিলাম, যে কারণে আমরা দু:খিত এবং এজন্য আমরা ক্ষমা চাইছি৷’’

আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট: জুনে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফার্নান্দেজের একটি মন্তব্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় উঠে। একই সঙ্গে আঞ্চলিক পর্যায়ে জাতিগত বিতর্কও তুঙ্গে উঠে যখন তিনি স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজের সঙ্গে সাক্ষাতে একটি ভুল মন্তব্য করে বসেন। তিনি বলেছিলেন, “ব্রাজিলিয়ানরা এসেছেন জঙ্গল থেকে”। এ নিয়ে উত্তেজনা দেখা দেয়ার এক পর্যায়ে ক্ষমা চান আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট।

অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী: অস্ট্রেলিয়া ২০২০ সালে করোনা মহামারী সামাল দিতে অনেকাংশেই সফল হয়ে বিশ্বে প্রশংসা কুড়িয়েছিল। কিন্তু এবছর সেখানে করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক ডেল্টা ধরনের সংক্রমণ উদ্বেগ বাড়ায়। ডেল্টার বিস্তার ঠেকাতে হিমশিম খায় সরকার। এ পরিস্থিতির মধ্যে দেশটিতে ১৫ শতাংশেরও কম মানুষ জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত টিকা নিয়েছে। ওদিকে, একের পর এক রাজ্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছে লকডাউনে।স্থবির হয়ে পড়ছে অর্থনৈতিক কার্যক্রম। ফলে বাড়ছে ক্ষোভ।

যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে সবকিছু খুলতে শুরু করার মধ্যে অস্ট্রেলিয়াতেও টিকাকরণের হার বাড়ানো এবং সবকিছু খোলা রাখার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর চাপের মুখে জুলাইয়ের শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন সাংবাদিকদের বলেন, “আমি দুঃখিত যে, আমরা এ বছরের শুরুতে যে অবস্থানে পৌঁছতে পারব বলে আশা করেছিলাম সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারিনি।”

এর আগে ফেব্রুয়ারিতে পার্লামেন্ট ভবনে ধর্ষণের শিকার হওয়ার অভিযোগ তোলা সাবেক এক রাজনৈতিক উপদেষ্টার কাছে ক্ষমা চান অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী। ব্রিটানি হিজিনস নামের ওই নারীর অভিযোগ ছিল- কাজ হারানোর ভয় দেখিয়ে ২০১৯ সালে এক মন্ত্রীর কক্ষে ধর্ষণ করা হয় তাকে আর ওই ঘটনার বিচার দাবি করে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য খুব কমই পেয়েছিলেন।

কানাডার প্রধানমন্ত্রী: ২০১৯ সালে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো’র অতীতে নানা রকম সাজে নিজের তোলা কিছু ছবি মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেসব ছবিতে দেখা যায়, কোনোটিতে তিনি বাদামি রঙয়ের চামড়ার মানুষের সাজে, আবার কোনোটিতে কৃষ্ণাঙ্গের সাজে রয়েছেন। তার তৃতীয় ছবিটি সামনে আসলে তার জেরে দ্বিতীয় বার ক্ষমা চান কানাডার এই উদারপন্থী নেতা।

টুইটারে এক ভিডিও বার্তা পোস্ট করে ট্রুডো বলেন, যেসব মানুষ প্রতিদিন অসহিষ্ণুতা এবং বৈষম্যের শিকার হন, আমার এই কাজ তাদের দুঃখ দিয়েছে। এই কাজের জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী, এর দায়িত্ব সম্পূর্ণ আমার। তিনি আরো লেখেন, পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, মুখে কালো রঙ মেখে এভাবে সাজা একেবারেই উচিত নয়। কারণ, এই কালো মুখের সঙ্গে একটা ইতিহাস জড়িয়ে আছে। আমার এটা আগেই বোঝা উচিত ছিল।

দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী: ২০১৪ সালের ১৬ এপ্রিল দক্ষিণ কোরিয়ার দক্ষিণপশ্চিম উপকূলে প্রায় পাঁচশ যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় সাত হাজার টন ধারণ ক্ষমতার ফেরি সেউল। ফেরির যাত্রীদের অধিকাংশই ছিলেন স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থী।

ওই ঘটনায় তিন শতাধিক মানুষ নিহত বা নিখোঁজ হন। দুর্ঘটনা রোধ করতে না পারা এবং দুর্ঘটনার পর দ্রুত উদ্ধার সম্পন্ন করতে না পারায় সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষমাও চান দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী চাং হু-অন। ফেরি ডুবে প্রাণহানির ঘটনায় ব্যর্থতার দায় নিয়ে পদত্যাগেরও ঘোষণা দেন তিনি।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত