শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগে যত অনিয়ম

| আপডেট :  ০১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১:৫৯  | প্রকাশিত :  ০১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১:৫৯

দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ আসছে। গত কয়েক বছরে অন্তত এক ডজন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্ত করেছে উচ্চশিক্ষার অ্যাপেক্সেবডি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। ওইসব তদন্ত প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমাও পড়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উত্থাপিত অভিযোগের বেশির ভাগই আত্মীয়করণ আর স্বজনপ্রীতি সংক্রান্ত। আছে সাধারণ নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন। কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নজির আছে।

কেননা একবার কেউ কোনোভাবে নিয়োগ পেলে তা যেমন আর বাতিল করা যায় না, তেমনই সংশ্লিষ্টরা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ওই অবস্থায় পরিস্থিতির কথা ভেবে ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে সংশ্লিষ্টরা পিছিয়ে যান। আবার এ ধরনের নিয়োগের জন্য বিচারের মুখোমুখি হওয়ার দৃষ্টান্তও আছে খুবই কম। নিয়োগ কেলেঙ্কারির ঘটনায় গত এক দশকে কেবল রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক উপাচার্যকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় কারাগারে যেতে হয়েছে। আর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এবং গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে অপসারণ করা হয়েছে। এছাড়া উপাচার্যদের মেয়াদপূর্তি করতে দেওয়ার ঘটনা আছে। শাস্তি বলতে দ্বিতীয়বার আর নিয়োগ দেওয়া হয় না।

জানতে চাইলে ইউজিসির সচিব ড. ফেরদৌস জামান বুধবার বলেন, অতিসম্প্রতি পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। এর আগে বিভিন্ন সময়ে আরও অন্তত ৮-৯টি প্রতিবেদন গেছে। এছাড়া বর্তমানে অপর ৬-৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে তদন্ত চলছে। এসব তদন্তের বেশির ভাগই নিয়োগ, পদোন্নতি ও আর্থিক বিষয়সংক্রান্ত।

দেশে বর্তমানে অর্ধশতাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এগুলোর মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যেসব প্রতিষ্ঠানের তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়েছে সেগুলোর বেশির ভাগের নিয়োগ ও কেনাকাটায় অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। একসময় দলীয় পরিচয়ে নিয়োগের অভিযোগ আসত। কিন্তু হালের সংযোজন হচ্ছে, আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ ও পুত্র-কন্যা-জামাই-ভাই এবং স্ত্রী পুনর্বাসন।

এ প্রসঙ্গে ইউজিসির এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সাম্প্রতিককালে প্রতিষ্ঠিত প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ই জেলা-উপজেলা বা বিভাগীয় পর্যায়ে। নতুন প্রতিষ্ঠান মানেই নিয়োগ। আর নিয়োগের জন্য স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাসহ প্রভাবশালীরা চাপ তৈরি করেন। ফলে অনেক সময়ে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে। আবার অনেক সময় প্রভাবশালীদের কাজ করতে গিয়ে নিজেরও দু-চারটা করে নেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দায়টা উপাচার্যকেই নিতে হয়। খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুকৃবি) ক্ষেত্রেও তেমনটি ঘটেছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা। যে কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় খুকৃবির উপাচার্যকে চিঠিতে তার নিজের ছেলে, মেয়ে, শ্যালক-শ্যালিকার ছেলে, ভাতিজাসহ নিজ পরিবারের ৯ জনের নিয়োগ বাতিলের নির্দেশনা দিয়েছে। পাশাপাশি আরও ৭৩ জনের নিয়োগও বাতিলের কথা পাঠানো চিঠিতে আছে। কিন্তু এই নির্দেশনার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে ক্যাম্পাসে আন্দোলন শুরু হয়েছে।

খুকৃবির আগে স্বজনপ্রীতির আলোচিত ঘটনাটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেছে। অভিযোগ উঠেছে, সাবেক উপাচার্য শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা উদ্দেশ্যমূলকভাবে পরিবর্তন করে যোগ্যতা কমিয়ে নিজের মেয়ে ও জামাইকে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দিয়েছেন। এছাড়া তার প্রশাসন একইভাবে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্য ৩৪ জনকে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দিয়েছে। এসব বিষয় একদফা তদন্ত করে ইউজিসি ব্যবস্থা নিতে সুপারিশও করেছিল। কিন্তু ব্যবস্থা নেয়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মেয়াদের শেষ কর্মদিবসে ১৪১ জনকে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়েছিলেন ওই উপাচার্য।

একই ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাউবি)। সাবেক এক উপাচার্যের ছেলে প্রথমে সহকারী অধ্যাপক পদে আবেদন করেন। যোগ্যতা না থাকায় তা বাতিল হয়। কিন্তু বছর খানেক পর তাকে সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এজন্য কয়েক দফায় নিয়োগবিধি সংশোধন করে যোগ্যতা শিথিল করতে হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটিতে তার ৩৮ বছর বয়সি শ্যালিকাকেও বয়স ও শর্ত শিথিল করে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ আছে।

ঢাকার বছিলায় অবস্থিত ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব নিয়োগই অবৈধ বলে সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন পাঠিয়েছে ইউজিসি। ওই তদন্ত কমিটির নেতৃত্ব দেন ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চন্দ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব নিয়োগ বাতিলের সুপারিশ আমরা করেছি। রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েট) পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ দেওয়ার জন্য লিখিত পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ বা পিছিয়ে থাকার পরও মৌখিক পরীক্ষায় অস্বাভাবিক বেশি নম্বর দিয়ে প্রথম করা, মৌখিক পরীক্ষার নম্বর ঘষামাজা এবং বিজ্ঞাপিত পদের দ্বিগুণের বেশি নিয়োগের অভিযোগ আছে। অনিয়ম করে নিয়োগ দেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে সাবেক উপাচার্যের ভাই, শ্যালকসহ নিকটাত্মীয় আছেন বলে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

নতুন প্রতিষ্ঠান রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষস্থানীয় কয়েক কর্মকর্তা আত্মীয়স্বজনসহ অসংখ্য নিয়োগের কুশীলব। তাদের মধ্যে শাহজাদপুরের এক ব্রজবালা গ্রামেরই ২০-২৫ জন চাকরি পেয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এক অধ্যাপকের বেআইনি নিয়োগের তদন্ত করছে ইউজিসি। সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পুরোপুরি চালুর আগেই অনুমোদিত পদের বাইরে অতিরিক্ত ১০৯ জনকে নিয়োগের অভিযোগ তদন্ত হয়েছে।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সন্তানকে গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা। একই ঘটনা ঘটিয়েছেন ইউজিসির সাবেক এক সদস্য। তার ছেলেও রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা, কিন্তু গোপালগঞ্জে চাকরি পেয়েছেন। আবার বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ভাই অ্যাডহকভিত্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। অপরদিকে কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্যের ভাইকে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

একইভাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানীয় দলীয় নেতাদের আত্মীয়কে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটিতে ল্যাবরেটরি স্থাপনে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। আছে প্রতিষ্ঠানটিতে কয়েকটি পদে কর্মকর্তা নিয়োগে নানান অভিযোগ। বিশেষ করে প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষক নিয়োগের ইস্যু উচ্চ আদালতে মামলায় গড়িয়েছে। ওই মামলার বাদী শিক্ষক সাব্বির হাসান জানান, সব ধরনের নিয়োগের লিখিত পরীক্ষার খাতা নিরীক্ষা করলে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হতে বাধ্য।

সূত্র: যুগান্তর

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত