শুধু বদলি নয়, টাকা দিলে গুরুদণ্ডের মতো শাস্তিও মওকুফ হয়ে যায়

| আপডেট :  ০৪ জানুয়ারি ২০২২, ১০:১২  | প্রকাশিত :  ০৪ জানুয়ারি ২০২২, ১০:১২

রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) পূর্বাঞ্চলে বদলি নিয়ে চলছে রমরমা বাণিজ্য। নিময়-নীতির তোয়াক্কা না করে বছরের পর বছর একই পদে থাকছেন সংশ্লিষ্টরা। এজন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে দিতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। টাকার মাধ্যমে একই ব্যক্তিরাই ঘুরেফিরে থাকছেন ‘পছন্দের’ পদে। আর এসব অভিযোগ উঠেছে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চিফ কমান্ড্যান্ট জহিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে।

অভিযোগ রয়েছে, শুধু বদলি নয়, টাকা দিলে গুরুদণ্ডের মতো শাস্তিও মওকুফ হয় এই কর্মকর্তার মাধ্যমে। এমন বিভিন্ন অভিযোগে সম্প্রতি বদলি করা হয়েছিল চিফ কমান্ড্যান্ট জহিরুলকে। কিন্তু অদৃশ্য কারণে সেটিও স্থগিত হয়ে যায়। সংশ্লিষ্ট বলছেন, এ নিয়ে আরএনবি সদস্যদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনেও তাদের মাঝে অনীহা দেখা দিয়েছে।

সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের ২৫ মে থেকে আরএনবি’র চট্টগ্রাম জেনারেল শাখায় দায়িত্ব পালন করছেন হাবিলদার মো. সোয়াইব (এইচ-৫০৬-ই), ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি থেকে গোয়েন্দা শাখায় দায়িত্ব পালন করছেন হাবিলদার পংকজ রায় (এইচ/৬০৬-ই) ও ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে অস্ত্র শাখায় রয়েছেন হাবিলদার মো. ইউসুফ মৃধা (এইচ/৪৬৫-ই)।

সোমবার এক দপ্তরাদেশে তাদেরকে বদলি করা হয়। সংশ্লিষ্টদের বিরদ্ধে নানা অভিযোগ থাকার পরও ঘুরেফিরে তাদেরকেই রাখা হয়েছে এসব পদে। এরমধ্যে অস্ত্র শাখার ইউসুফ মৃধাকে গোয়েন্দা শাখার হাবিলদার হিসাবে, জেনারেল শাখার মো. সোয়াইবকে অস্ত্র শাখায় ও গোয়েন্দা শাখার পংকজ রায়কে চট্টগ্রাম জেনারেল শাখায় বদলি করা হয়। সোমবার অ্যাসিস্ট্যান্ট কমান্ড্যান্ট (সদর) মো. মুজিবুল হক স্বাক্ষরিত এক দপ্তরাদেশে এ তথ্য জানা যায়।

জানা গেছে, রেলওয়ের সাধারণ ও অস্ত্র শাখায় দায়িত্ব পালন করতে গেলে প্রতি মাসে মাসোয়ারা দিতে হয় পূর্বাঞ্চলের চিফ কমান্ড্যান্টকে। এজন্য বিভিন্ন খাতে টাকা আদায় করেন সংশ্লিষ্ট দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা। এসব খাতের মধ্যে রয়েছে-চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় হকার, পার্কিং, অধীনস্থ আরএনবি সদস্যদের ডিউটি বণ্টন, জুয়ার আসর, টিকিট কালোবাজারি ও রেলের উচ্ছেদ হওয়া জায়গায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বসিয়ে টাকা আদায়। এসব খাত থেকে দৈনিক ও মাসিক হিসাবে টাকা উত্তোলন করেন সংশ্লিষ্টরা।

সাধারণ শাখার আওতায় রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় পার্কিংয়ের স্থান থেকে প্রতি মাসে আদায় করা হয় ১০ হাজার টাকা। স্টেশনের আশপাশে অন্তত অর্ধশত হকার বসিয়ে টাকা উত্তোলন করা হয়। এসব হকার থেকে গড়ে ৪ হাজার টাকা করে মাসে কমপক্ষে ২ লাখ টাকা আদায় করা হয়। তিন ধাপে ডিউটি বণ্টনের মাধ্যমে টাকা আদায় করেন সাধারণ শাখার হাবিলদার। এগুলো হলো, স্কট, প্লাটফর্ম ও রেক ডিউটি।

এসব ডিউটি করতে হলে প্রত্যেক সদস্যকে মাসে ৬ হাজার টাকা করে দিতে হয় সংশ্লিষ্ট হাবিলদারকে। এই ইনচার্জের আওতায় ১২০ জন আরএনবি সদস্য রয়েছে। এছাড়া নিরাপত্তা বাহিনীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় স্টেশন এলাকায় এবং দেওয়ানহাট ফ্লাইওভারের নিচে একাধিক জুয়ার আসর চলে। জুয়ার আসরগুলো থেকে দৈনিক ও সাপ্তাহিক ভিত্তিতে টাকা আদায় করা হয়।

আরএনবির হাবিলদার সোহাগের মাধ্যমে পরিচালিত হয় টিকিট কালোবাজারি। এজন্য তাকে প্রতিদিন প্লাটফর্মে দায়িত্ব দেওয়া হয়। অপরদিকে অস্ত্র শাখায় দায়িত্বে থাকা হাবিলদার রেলের উচ্ছেদ হওয়া জায়গায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বসিয়ে টাকা আদায় করে থাকেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর এসব টাকার ভাগ দিতে হয় চিফ কমান্ড্যান্ট জহিরুল ইসলামকে।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল আরএনবি দপ্তর সূত্র জানায়, গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর চাঁদপুর জেলায় হ্যান্ডকাফসহ মোহন গাজী নামে এক আসামি পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় ইনচার্জ হাবিলদার খোরশেদ আলমকে ক্লোজ করা হয়। তিনি ক্লোজ হওয়ার পর ওই স্থানে রবিউল হোসেনকে পদায়ন করা হয়।

কিন্তু মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে রবিউলের পদায়ন আদেশ বাতিল করে ক্লোজ হওয়া খোরশেদকে বহাল রাখা হয়। টাকার বিনিময়ে গুরুদণ্ডের মতো অপরাধ মাফ করে দেওয়া হয়। জানা গেছে, হাবিলদার খোরশেদ গত ১০ বছর ধরেই একইস্থানে দায়িত্ব পালন করছেন।

এদিকে নানা অভিযোগের পর গত বছরের ৩১ মে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে চিফ কমান্ড্যান্ট জহিরুল ইসলামকে চট্টগ্রাম থেকে রাজশাহীতে বদলি করা হয়। পশ্চিমাঞ্চলের চিফ কমান্ড্যান্ট মো. আশাবুল ইসলামকে পূর্বাঞ্চলের চিফ কমান্ড্যান্ট হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

কিন্তু অদৃশ্য কারণে সেই আদেশ স্থগিত করা হয়। এরপর থেকে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন জহিরুল ইসলাম। এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চিফ কমান্ড্যান্ট জহিরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘আর্থিক কোনো লেনদেনে বদলি হয়নি। প্রশাসনিক স্বার্থে তাদেরকে রদবদল করা হয়েছে।’

আরএনবির দুই সদস্য বরখাস্ত : রেলওয়ের ইঞ্জিন থেকে ৬টি ব্যাসভার ও ২টি কন্ট্রোলার চুরি হয়েছে। রোববার গভীর রাতে পাহাড়তলী মার্শাল ইয়ার্ডে এ ঘটনা ঘটে। সোমবার বিষয়টি জানাজানি হলে সন্ধ্যায় কর্তব্যে অবহেলার দায়ে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) দুই সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

জানা গেছে, রেলওয়ে রানিং ইঞ্জিন থেকে ৬টি ব্যাসভার ও ২টি কন্ট্রোলার চুরির ঘটনায় বেশ কয়েকজন জড়িত বলে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে নিশ্চিত হয়েছে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী।

এ ঘটনায় রেলওয়ে সম্পত্তি (অবৈধ দখল উদ্ধার) আইনের ৪ নম্বর ধারায় মামলা করা হয়। চুরির ঘটনায় নিরাপত্তা বাহিনীর কর্তব্যরত দুই সদস্যকে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
সূত্র: যুগান্তর

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত