স্ত্রী-প্রেমিকাদের সন্দেহ হলেই পুরুষাঙ্গ কর্তন, বেড়ে গেছে আশঙ্কাজনক হারে

| আপডেট :  ১৯ জানুয়ারি ২০২২, ১১:৩৫  | প্রকাশিত :  ১৯ জানুয়ারি ২০২২, ১০:৪৪

‘একাধিক সার্জারি হয়েছে আমার। অনেক সাফার করেছি, করছি। আমার তিনটা বাচ্চা। এই পরিস্থিতিতে সমাজে বাচ্চাদের মানুষ করাই আমার লক্ষ্য ও চ্যালেঞ্জ এখন। আমার স্ত্রী আমাকে অবিশ্বাস করতো, আমি নাকি পরকীয়ায় লিপ্ত। কার সঙ্গে পরকীয়ায় লিপ্ত কোনো তথ্য না নিয়েই আন্দাজে অভিযোগ করতো। আমি নাকি দ্বিতীয় বিয়ে করেছি। আমি দ্বিতীয় বিয়ে করলে আমার কি বউ থাকবে না? খোঁজ নেবে না দ্বিতীয় বউ? সে যা বলেছে তার পুরোটাই ভিত্তিহীন, মিথ্যা ছিল। মূলত এসব কিছুই না, আমার প্রতি তার হিংসাত্মক মনোভাব ছিল, আর হয়তো কারও দ্বারা প্ররোচিত হয়ে এ ঘটনা ঘটিয়েছে, এটাই মূল বিষয়।’

আক্ষেপ করে এ কথা বলছিলেন হালিম সরদার (ছদ্মনাম)। গত বছর তার গোপনাঙ্গ কেটে ফেলেন স্ত্রী। তারপর চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হলেও ভোগান্তির শেষ নেই হালিমের। এই জের তাকে টানতে হবে সারাজীবন।

হালিম বলেন, ‘আমি আমার চাকরির প্রতি এতটাই দায়িত্বশীল ছিলাম, যে কারণে আমার পরিবারে সময় কমই দিতে পেরেছি। পরিবারকে ভালো রাখার জন্যই চাকরি করেছি। যেসব অভিযোগ করেছিল এখনো তদন্ত হচ্ছে। এখন কাউকেই কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, কেউ বলতেও পারে না যে আমি পরকীয়ায় লিপ্ত। যে ধরনের অভিযোগ করা হয়েছে, এর কোনোটাই আসলে সত্য নয়।’

হালিম ও তার স্ত্রীর মতো বৈবাহিক সম্পর্কগুলোতে এমন সন্দেহ ও তার প্রতিক্রিয়ায় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলছে। স্বামী বা স্ত্রীর বিবাহবহির্ভূত প্রেম বা শারীরিক সম্পর্কের জেরে এসব ঘটনা বেশি ঘটলেও ঝগড়াঝাটির মতো ঠুনকো কারণও কম দায়ী নয়। এর পাশাপাশি পারিবারিক বিরোধসহ নানা কারণও আছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও সামাজিক মূল্যবোধ পরকীয়া সমর্থন করে না। ফলে স্বামী কিংবা স্ত্রীর পরকীয়ার ঘটনা পরস্পর জেনে গেলে কিংবা সন্দেহ হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা অন্য কারও কাছে বলতে পারেন না। এতে নিজে থেকেই এক ধরনের উৎকণ্ঠা ও তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়ার মানসিকতা তৈরি হয়। ফলে ঘটে যায় স্পর্শকাতর অঙ্গ কেটে নেওয়ার ঘটনাও। এর পাশাপাশি স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া, তার অবহেলার কারণে ক্ষোভসহ বিভিন্ন কারণেও গোপনাঙ্গ কাটার খবর মেলে।

পরকীয়ায় জড়িত সন্দেহে স্বামীর পুরুষাঙ্গ কর্তন
নারায়ণগগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায় ২০১৯ সালের নভেম্বরে এক ব্যক্তির পুরুষাঙ্গ কেটে দেন তার স্ত্রী। পরে জানা যায়, স্বামী পরকীয়ায় জড়িত বলে সন্দেহ করে কৌশলে এই কাজ করেছেন স্ত্রী।

পরকীয়া প্রেমিকার কামড়ে পুরুষাঙ্গ হারিয়ে মৃত্যু
২০১৮ সালের আগস্টে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার আল্লারদর্গা এলাকার গাড়া দাইড়পাড়া গ্রামে এক ব্যক্তির পুরুষাঙ্গ কামড়ে ছিঁড়ে নেন তার পরকীয়া প্রেমিকা। পরে জানা যায়, বিয়ে করতে ওই ব্যক্তি অস্বীকৃতি জানান বিধায় তাকে শারীরিক সম্পর্কের লোভ দেখিয়ে ডেকে এই কাণ্ড ঘটান সেই নারী।

পারিবারিক কলহে পুলিশ স্বামীর পুরুষাঙ্গ কাটলেন স্ত্রী
গত ৯ ডিসেম্বর রাজশাহী নগরীর মালোপাড়া পুলিশ ফাঁড়ির এক উপ-পরিদর্শকের (এসআই) পুরুষাঙ্গ কেটে দেন তার স্ত্রী। পরে জানা যায়, ওই এসআইয়ের সঙ্গে তার স্ত্রীর দীর্ঘদিন ধরে পারিবারিক কলহ চলছিল। মূলত সেই কলহের জেরে নৃশংস ঘটনাটি ঘটানো হয়।

বাড়িতে আসতে দেরি করায় স্বামীর পুরুষাঙ্গ কর্তন
গত ৪ ডিসেম্বর খুলনা মহানগরীর খানজাহান আলী থানাধীন শিরোমণি মধ্যপাড়া এলাকার এক ব্যক্তির পুরুষাঙ্গ কেটে দেন তার স্ত্রী। জানা যায়, ওই ব্যক্তি একটি বাহিনীর সদস্য। ছুটি নিয়ে বাড়িতে আসতে দেরি করায় ক্ষুব্ধ হন স্ত্রী। এমনকি দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন বলে স্বামীকে প্রায়ই নির্যাতন করতেন স্ত্রী।

বছরে গড়ে ২০টি পুরুষাঙ্গ কর্তনের ঘটনা ঘটছে
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঘটনার হাতেগোনা দু-চারটি প্রকাশ পেলেও এমন গোপনাঙ্গহানি বা কর্তনের ঘটনা ভয়ানকভাবে বেড়ে চলছে। অধিকাংশ ভুক্তভোগীই লজ্জা, আত্মসম্মানসহ সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে কাউকে বলেন না। পুরুষ নির্যাতন নিয়ে কাজ করা ‘বাংলাদেশ পুরুষ অধিকার ফাউন্ডেশন’র তথ্য মতে, দেশে পুরুষের গোপনাঙ্গ কর্তনের মতো ঘটনা বছরে গড়ে ২০টি ঘটছে। এসব ওই ঘটনায়ই সীমাবদ্ধ থাকে না, ভুক্তভোগীকে সারাজীবন এর জের টানতে হয়। সামাজিকভাবে হেয় হয়ে থাকতে হয়।

‘বাংলাদেশ পুরুষ অধিকার ফাউন্ডেশন’র সভাপতি শেখ খায়রুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্বামীর পরকীয়া কিংবা স্ত্রীর পরকীয়ায় বাধা দেওয়া নিয়ে কলহের জেরে পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলার মতো ঘটনা ঘটছে বেশি। অনেক পুরুষ সম্মানহানি ও হাসির পাত্র হবেন ভেবে ঘটনাগুলো প্রকাশ করতে অনীহা প্রকাশ করেন। আমাদের জানা মতে, প্রতি বছর এমন ২০টি ঘটনা ঘটে। এর কয়েকটি গণমাধ্যমে এলেও বাকিগুলো আসে না। যেগুলো প্রকাশ পায় সেগুলোও অনেক সময় ভিকটিম জানেন না যে গণমাধ্যমে এসেছে।’

যা আছে অঙ্গহানি আইনে
লজ্জা, আত্মসম্মান ও সামাজিক মর্যাদাহানির ভয়ে অঙ্গহানির মতো গুরুতর বিষয়টি অনেকে প্রকাশ করতে না চাইলেও এ বিষয়ে স্পষ্ট আইন রয়েছে দেশে। দণ্ডবিধি ১৮৬০-এ গুরুতর আঘাতের ব্যাপারে আটটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। যার ৩২০ ধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, ‘গুরুতর আঘাত: কেবল নিম্নোক্ত শ্রেণিসমূহের আঘাতই ‘গুরুতর’ বলে গণ্য হবে। প্রথমত, পুরুষত্বহীনকরণ। দ্বিতীয়ত, স্থায়ীভাবে দুই চোখের যে কোনোটির দৃষ্টিশক্তি রহিতকরণ। তৃতীয়ত, স্থায়ীভাবে দুই কানের যে কোনোটির শ্রবণশক্তি রহিতকরণ। চতুর্থত, যে কোনো অঙ্গ বা গ্রন্থির অনিষ্টসাধন। পঞ্চমত, যে কোনো অঙ্গ বা গ্রন্থির কর্মশক্তিসমূহের বিনাশ বা স্থায়ী ক্ষতিসাধন। ষষ্ঠত, মস্তক বা মুখমণ্ডলের স্থায়ী বিকৃতিকরণ। সপ্তমত, হাড় বা দন্তভঙ্গ বা গ্রন্থিচ্যুতকরণ। অষ্টমত, যে আঘাত জীবন বিপন্ন করে বা আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ২০ দিন মেয়াদের জন্য তীব্র দৈহিক যন্ত্রণা দান করে বা তাকে তার সাধারণ পেশা অনুসরণ করতে অসমর্থ করে।’

এই আইনের পরিপ্রেক্ষিতে দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ৩২৫ ধারায় শাস্তির বিধানও রাখা হয়েছে। ধারাটিতে বলা আছে, ‘স্বেচ্ছাকৃতভাবে গুরুতর আঘাত দানের শাস্তি: যদি কোনো ব্যক্তি ৩৩৪ ধারায় ব্যবস্থিত ক্ষেত্র ব্যতিরেকে স্বেচ্ছাকৃতভাবে গুরুতর আঘাত দেয়, সে ব্যক্তি যে কোনো বর্ণনার কারাদণ্ডে, যার মেয়াদ সাত বৎসর পর্যন্ত হতে পারে, দণ্ডিত হবে এবং তদুপরি জরিমানা দণ্ডেও দণ্ডনীয় হবে।’

‘বাংলাদেশ পুরুষ অধিকার ফাউন্ডেশন’র সভাপতি শেখ খায়রুল আলম বলেন, ‘যেহেতু অঙ্গহানি হয়। এটি জামিন অযোগ্য অপরাধ। অথচ মামলা করতে চান না ভুক্তভোগীরা। শুধু মামলা কেন, ঘটনা অনেক সময় প্রকাশই করতে চান না তারা। তাদের মামলায় সহযোগিতা করবো বলি, তাও আসেন না।’

প্রতিকারে প্রয়োজন সচেতনতা ও আলাদা আইন

ভুক্তভোগী ও পুরুষ নির্যাতন নিয়ে কাজ করা সংগঠনের নেতারা বলছেন, এসব ঘটনা প্রকাশ না করার ক্ষেত্রে পুরুষ নির্যাতনের জন্য আলাদা আইন না থাকারও বড় ভূমিকা রয়েছে। নারী নির্যাতন নিয়ে আইন থাকলেও পুরুষ নির্যাতন নিয়ে নেই কোনো আইন। পুরুষ নির্যাতন নিয়ে বিভিন্ন সময় কথা উঠলেও তা নিয়ে জোরালো কোনো দাবি বা পদক্ষেপ এখনো দেখা যায় না। পরকীয়া, আর্থিক সংকট বিশেষ করে ঈদের সময় নানা কারণে কলহের জেরে শারীরিক বা মানসিকভাবে পুরুষ নির্যাতনের ঘটনাগুলো ঘটছে।

পুরুষদের সুরক্ষার বিষয়ে ভুক্তভোগী হালিম সরদার বলেন, ‘আমার মতো অনেক পুরুষ বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হন, মামলা খান। অনেকেই ভুক্তভোগী। তাই এর প্রতিকার অবশ্যই হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে পুরুষ নির্যাতনরোধে আইন হওয়া খুবই দরকার। এটা যে শুধু আমার বক্তব্য তা নয়, এটা জনতার বক্তব্য। আইন থাকলে এসব ঘটনা একেবারেই কমে যেতো।’

‘বাংলাদেশ পুরুষ অধিকার ফাউন্ডেশন’র সভাপতি শেখ খায়রুল আলম বলেন, ‘নারী নির্যাতনবিরোধী আইন আছে বলে নারীরা যেমন আইনের আশ্রয় পান, পুরুষেরও সেটা পাওয়ার অধিকার আছে। আইন হলে তা অনেকটা কমে যাবে। ঘটনা ঘটে গেলে পুরুষের তা প্রকাশ করা ও মামলা করা দরকার। দৃষ্টান্তমূলক বিচার হলে পরে এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর সাহস কেউ পাবে না। ফলে গোপনাঙ্গহানির ঘটনা একেবারেই কমে যাবে।’

বিশেষজ্ঞ মতামত

অধিকারকর্মীদের মতে, গোপনাঙ্গহানির মতো অমানবিক ও পুরুষ নির্যাতন প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করছে এমন গবেষণামূলক বা সচেতনতামূলক সংগঠন বা সংস্থা দেশে তেমন গড়ে ওঠেনি। হাতেগোনা যে দু-একটি সংগঠন রয়েছে, তাদেরও জোরালো কোনো কর্মসূচি নেই। তথ্য পরিসংখ্যানগুলো জনসাধারণের সামনে তুলে ধরে মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি এগুলোর প্রতিকারে সোচ্চার হওয়ার কর্মসূচি বাড়ানো উচিত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগের চেয়ে এমন ঘটনা বাড়তে থাকায় তা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের বিষয়ে ভাবনা বাড়াচ্ছে। আধুনিকায়ন ও প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে পর্নোগ্রাফি ও সামাজিক অপরাধ বৃদ্ধির কারণে নেতিবাচক বিষয়গুলো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে ফাটল ধরাচ্ছে। এসবের প্রতিকারে এখনই প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিকভাবে উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. জিয়া রহমান বলেন, ‘বিশ্বায়নের এই যুগে আধুনিকায়ন ও প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে পর্নোগ্রাফি ও সামাজিক অপরাধ বেড়ে গেছে। শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়েছে সবকিছু। মানুষের জীবনপ্রবৃত্তি ও ধ্বংসের প্রবৃত্তির মধ্যে ভারসাম্য আসে সামাজিকীকরণের মাধ্যমে। আধুনিক বা উন্নত সমাজে সেই ব্যবস্থাটা রয়েছে। আইনের মাধ্যমে এসব সমাধান হয়। তারা পরকীয়া বা অনৈতিক সম্পর্কটাকে অপরাধ মনে করে আইনের মাধ্যমেই তা সমাধানের চেষ্টা করে। নয়তো ডিভোর্স দেয়। কিন্তু আমাদের সমাজে তা হয় না। প্রকাশ পেলে নিজেরাই পদক্ষেপ নেয়। ফলে গোপনাঙ্গহানির মতো ঘটনা ঘটায়। এর পেছনে বিচার না হওয়ার কারণও রয়েছে।’

ড. জিয়া রহমান বলেন, ‘আমাদের সমাজ বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক সমর্থন করে না, ফলে সেটা প্রকাশ পায় না। বাইরের সংস্কৃতির মাধ্যমে পরকীয়া আমাদের সমাজে বেড়ে গেছে। এটিকে আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ সমর্থন করে না। ফলে অঙ্গহানিই নয়, প্রাণহানিও ঘটিয়ে ফেলে অনেকে। এগুলো থেকে বের হওয়ার জন্য গবেষণা, সচেতনতা, আলোচনার দরকার। নীতি-নৈতিকতার আলোচনার পাশাপাশি বিষয়গুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করাও প্রয়োজন।’

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত