সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিধি-৩২ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে

| আপডেট :  ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৯:২৪  | প্রকাশিত :  ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৯:২৪

আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পদের হিসাব না দিলে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে বিধি-৩২ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অথচ এই বিধিমালার কারণেই তাদের সম্পদের হিসাব দেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছেন সরকারের শীর্ষ পর্যায়সহ সব কর্মকর্তা-কর্মচারী। কেউ সম্পদের হিসাব দেন না। ৪২ বছর আগে বিধিমালা হলেও এখন পর্যন্ত কোনো সরকারই তাদের কাছ থেকে সম্পদের হিসাব নিতে পারেনি। এতে বিধি লঙ্ঘন হচ্ছে। এর দায়ে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বিধিতে বলা হয়েছে। কিন্তু হিসাব না দেওয়ার জন্য কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের তেমন নজিরও নেই। এ অবস্থায় সবকিছু আরও স্পষ্ট করতে বিধিমালাটি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯’ অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব বলতে শুধু একজনের নয়। এতে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর পরিবার ও তার ওপর নির্ভরশীল সবার হিসাব দেওয়া বাধ্যতামূলক। মূল সমস্যাটি এখানেই। এটাকেই দীর্ঘদিন ধরে সুযোগ হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনে বিদ্যমান বিধি সংশোধন বা নতুন আইন করা যেতে পারে বলে মনে করছেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা।

সম্প্রতি এ বিধিমালার ১১, ১২ ও ১৩নং ধারা উল্লেখ করে সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার তাগিদ দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। বিধিমালাটি শুধু অসামরিক কর্মচারীদের জন্য প্রযোজ্য।

এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পদের হিসাব জমা দিতে বলা হয়েছে। তা-ই করতে হবে। যারা হিসাব দেবেন না, তাদের বিরুদ্ধে বিধি-৩২ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, অধিকাংশ সরকারি কর্মচারী মনে করছেন, আয়কর ফাইলে প্রদর্শিত হিসাব জমা দিলেই রেহাই মিলবে। তারা জানেন না সম্পদের হিসাব বলতে তাদের পরিবারের সদস্যসহ নির্ভরশীলরাও এর অন্তর্ভুক্ত। বিধিমালার বিধি-২ (সংজ্ঞা) অনুযায়ী, “সরকারি কর্মচারী: অর্থ ঐ ব্যক্তি বা যাহার ক্ষেত্রে এই বিধিমালা প্রযোজ্য এবং ‘সরকারি কর্মচারীর পরিবারের সদস্য’ এর অন্তর্ভুক্ত হবেন।” সংজ্ঞায় সরকারি কর্মচারীর পরিবারের সদস্য বলতে ‘সরকারি কর্মচারীর সঙ্গে বসবাস করেন অথবা না করেন, তাঁহার স্ত্রী/স্বামী, সন্তান বা সৎসন্তানগণ এবং সরকারি কর্মচারীর সাথে বসবাসরত এবং তাঁর উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল তাঁর নিজের অথবা স্ত্রীর/স্বামীর অন্যান্য আত্মীয়স্বজন’কে বোঝাবে।

সরকারে থাকা অসামরিক কর্মচারীর সংখ্যা কমবেশি ১৭ লাখ। এর মধ্যে রেলওয়ে, মেট্রোপলিটন পুলিশের অধস্তন, পুলিশ-বিজিবির নিম্ন পদমর্যাদার এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের কিছু কর্মচারীর জন্য এ বিধিমালায় হিসাব দেওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। মোটা দাগে এরা বাদে অন্তত ১০ লাখ কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সদস্য ও নির্ভরশীলদের সম্পদের হিসাব সরকারকে নিতে হবে। একজন কর্মচারীর পরিবার ও নির্ভরশীল সদস্য গড়ে ৬ জন করে ধরলে মোট সদস্য দাঁড়ায় ৬০ লাখ। এর মধ্যে প্রতি পরিবারে ৩ জনের নামেও যদি সম্পদ থাকে তবে অন্তত ৩০ লাখ মানুষের সম্পদের হিসাব নিতে হবে সরকারকে। সে সক্ষমতা সরকারের আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ। এই বিধির আলোকে সর্বশেষ সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই উদ্যোগও ভেস্তে গেছে। এবারও একই অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে বলে অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করছেন। তাদের মতে, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মচারীরাই সম্পদের হিসাব দিয়ে অভ্যন্ত নন। সেখানে তারাই নিজেদেরসহ অন্যদের সম্পদের হিসাব কতটা নেবেন, তা প্রশ্ন সাপেক্ষ।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘হিসাব চাওয়া হয়েছে, দেখা যাক কী হয়। যদি কেউ হিসাব না দেন তাহলে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ উল্লেখ্য, বিধিমালার বিধি-৩২ অনুযায়ী, সম্পদের হিসাব জমা না দিলে অসদাচরণ হিসাবে গণ্য হবে। এতে বিধি লঙ্ঘনের দায়ে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়ার মতে, সম্পদের হিসাব জমা না দেওয়া যেমন অসদাচরণ, তেমনই জমা নিতে উদ্যোগ গ্রহণ না করাও এক ধরনের অসদাচরণ। হিসাব জমা না দিলে অসদাচরণের কথা বিধি-৩২-এ বলা আছে। কিন্তু জমার উদ্যোগ না নিলে কী হবে, তা বিধিমালায় উল্লেখ নেই। উল্লেখ্য, চার দশক আগে এই বিধিমালায় প্রতিবছর সম্পদের হিসাব জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু কেউ সেটা অনুসরণ করত না। এরপর ২০০২ সালে এটি সংশোধন করে প্রতি ৫ বছর পর সম্পদের হিসাব দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। তারপরও সেটা কার্যকর করা যায়নি। বিধিমালা সংশোধনের সঙ্গে সে সময়ে যুক্ত ছিলেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া। তিনি বলেন, চাকরিতে থাকার সময় আমি প্রতিবছর সম্পদের হিসাব দিতাম। কিন্তু অন্য কাউকে জমা দিতে দেখতাম না। তখন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে কথা বলে সম্পদের হিসাব দেওয়ার সময় প্রতিবছর বাদ দিয়ে ৫ বছর অন্তর করার উদ্যোগ নিই। কিন্তু গত দুই দশকে সেটাও কার্যকর হয়নি। তিনি বলেন, সরকার একটা উদ্যোগ নিয়েছে ঠিক; কিন্তু কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সংশয় থাকছেই। তবে শক্ত আইন প্রণয়ন করলে এই উদ্যোগটা ফলপ্রসূ হবে বলে মনে হয়।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন মনে করেন, সম্পদের হিসাব নিতে বিদ্যমান বিধিটিই যথেষ্ট। তারপরও কিছু বিষয় স্পষ্ট করতে এটি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করি, এবার আরও ভালো কিছু হবে।
সূত্র: যুগান্তর

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত