স্বপ্নদর্শী মেধাবী তরুণ মারজিয়া আফরিন

| আপডেট :  ২৩ জুন ২০২৪, ১০:২৪  | প্রকাশিত :  ২৩ জুন ২০২৪, ১০:২৪


স্বপ্নদর্শী মেধাবী তরুণ মারজিয়া আফরিন

আপন আলোয় উদ্ভাসিত

সামিনা বিপাশা


“সাফল্য চূড়ান্ত নয়, ব্যর্থতা মারাত্মক নয়; এটি চালিয়ে যাওয়ার সাহসই গুরুত্বপূর্ণ”। কথাটি উইনস্টন চার্চিলের। এই কথার ধ্বনিই প্রতিধ্বনিত হতে দেখা যায় যার জীবন জুড়ে সেই মেধাবী, সাহসী ও আত্মপ্রত্যয়ী নারী মারজিয়া আফরিন। মারজিয়া আফরিন বর্তমানে পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো হিসেবে কর্মরত আছেন  যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে (ওয়ার্ল্ড র্যাংকিং এ চতুর্থ অবস্থানে)। তার গবেষণার বিষয় ইমিউনোলজি এবং রিজেনারেটিভ মেডিসিন।

মারজিয়া আফরিন পি.এইচ.ডি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের আরেক অঙ্গরাজ্য ওহাইয়ো এর ক্লিভল্যান্ড স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে সেলুলার ও মলিকুউলার মেডিসিনে। অনার্স ও মাস্টার্স করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান (বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি) বিভাগ থেকে। স্কুল-কলেজ ছিল নারায়ণগঞ্জে যথাক্রমে বন্দরের সরকারি হাজী ইব্রাহিম আলমচান মডেল স্কুল এন্ড কলেজ এবং নারায়ণগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় ভালো এবং জেদি ছিলেন। জেদি বলা এই অর্থে যে কেউ যদি বলে তুমি এটা পারবে না বা তোমার দ্বারা এটা হবে না তাহলেই জেদ চেপে যেত মারাত্মক। তখন সেই পারবে না বলা জিনিসটা না পারা পর্যন্ত অব্যাহতি দিতেন না। তিনি জীবনে স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে আত্মপ্রত্যয়ী, প্রতিটি নতুনকে আবিষ্কারে সবসময়ই সাহসী ও পরিশ্রমী এবং কাজে নিষ্ঠাবান। আর তাই জীবনের প্রতিটি ধাপে সাফল্য তার চূড়ান্ত সঙ্গী।

মারজিয়া আফরিন সহাস্যে সমস্ত প্রতিকূলতাকে বরণ করতে জানেন, সফলতার পথে চলতে চলতে বলেন ‘এ পথ মসৃণ’ই ছিল। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ের কথাই যদি ধরা হয়, ভোরে সূর্যের আগেই ঘুম ভাঙত তার, ঊষালগ্নে বেরিয়ে পড়তেন বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার জন্য, শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে থাকায় নদী পার হয়ে তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতেন বাসে করে, ল্যাব করে বাড়ি ফিরতে রাত। একটা কঠিন বিষয়ে পড়াশোনা করতে গিয়েও তিনি এটিকে বাধা মনে করেননি। জার্নি কিংবা দূরত্ব এসবকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সেরাদের কাতারে দাঁড়িয়েছেন। কারণ, তার কাছে স্বপ্নপূরণই শেষ কথা। স্বপ্নপূরণে যতটুকু আত্মনিয়োগ করা জরুরি সেটি তার কাছে সহজ ও সুন্দর।

বেড়ে ওঠা জীবনের প্রতিকূলতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে মারজিয়া বলেন, আমার বেড়ে ওঠা জীবনে প্রতিকূলতা খুব কম, তবে নেই বা ছিল না এমন নয়। একটা বিষয় খুব মনে পড়ে, আমি ডান ও বাম দু হাতেই কাজ করতে পারি। এটাকে বলা হয় সব্যসাচী। অর্থাৎ, যারা সব্যসাচী তাদের মস্তিষ্কের দুটো অংশই কাজ করে। আমি ডান হাতে যেমন লিখতে পারি, বাম হাতেও পারি। ডান হাতে খেতে পারি, বাম হাতেও। অর্থাৎ ডান বা বাম আমার কাছে বিষয় না, আমি সব কাজ ডান বা বাম যেকোনো একটাতেই করতে পারি। কিন্তু ছোটোবেলায় যেটা হতো আমি বাম হাত দিয়ে কোনো কাজ করলে অন্যরা আমার মাকে বলত, মেয়ে বাম হাতে লিখলেই ওর হাতে বাড়ি দিবেন, তাহলে ভয়ে আর করবে না। তবে, আমার মা আমাকে এই বিষয়ে কিছু বলতেন না। বরং তিনি এটা এনজয় করতেন, মজা পেতেন। বাবা-মা দুজনেই এই বিষয়টাকে খুব পজেটিভলি দেখতেন এবং এনজয় করতেন। যদি এভাবে তারা না দেখতেন তাহলে আমার এই বিষয়টি অঙ্কুরেই বিনষ্ট হতো।

মারজিয়া আরো বলেন, আমার মা খুব প্রগ্রেসিভ ছিলেন। বাবা-মা দুজনেই খুব দারুণভাবে আমাদের বড় করে তুলেছেন। তাদের অবদানেই মূলত আমাদের বেড়ে ওঠাটা পরিপূর্ণ হয়েছে। এই যে বলছি বেড়ে ওঠায় প্রতিকূলতা ছিল না, সত্যিকারার্থে বাবা-মা আমাদের বেড়ে ওঠার পথকে মসৃণ করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন এবং করেন।

মারজিয়া আফরিনের বাবা ছিলেন সরকারী ব্যাংক কর্মকর্তা এবং মা ছিলেন গৃহিনী। তারা দুই বোন ও এক ভাই এর মধ্যে মারজিয়া ছোট।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াকালীন সময়ে মারজিয়া নারায়ণগঞ্জের বন্দরেই থাকতেন, মাঝে মাঝে থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে। হলে থাকাকালীন সময় ছাড়া বাকি সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের আনন্দ বাসে করে সকাল সাড়ে ছয়টায় শুরু হতো যাত্রা। ল্যাব শেষে বাড়ি ফিরতেন সেই সন্ধ্যায়। দূরের যাতায়াত পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটিয়েছে কি না জানতে চাইলে মারজিয়া বলেন, জার্নি পড়ালেখায় ক্ষতি করত না, তবে সমস্যা ছিল কী যখন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের কাজ চলছিল, ফলে রাস্তায় চার/পাঁচ ঘণ্টাও লেগে যেত। তবে আমি এটাকে সমস্যা মনে করিনি। আর এখন তো ফ্লাইওভার হয়ে গেছে, যাত্রাও সহজ।

মারজিয়া বলেন, পিএইচডি চলাকালীন সময়টা বেশ কঠিন ছিল। আমি যে প্রফেসরের আন্ডারে ছিলাম তিনি খুব নিঁখুত কাজ চাইতেন এবং বেশ কড়া ছিলেন। সেটা করাটা আমার জন্য রীতিমতো চ্যালেঞ্জ ছিল। কিন্তু আমি চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসি। আমার ল্যাবটি থেকে যারা পিএইচডি করে তাদের সাধারণত সাত বছরের বেশি সময় লেগে যায় (সাত বছর ঐ ল্যাবের পূর্ববর্তী সকল গ্রাজুয়েটদের লেগেছে) কিন্তু আমি পাঁচ বছরেই কমপ্লিট করতে পেরেছি।

মারজিয়া আফরিন সেই ল্যাবের মধ্যে রেকর্ডকৃত কম সময়ে গ্রাজুয়েট করলেও সে বেশ প্রোডাক্টিভ ছিল এবং তার সফলতা ছিল ঈর্ষনীয়। এই পাঁচ বছরের পি.এইচ.ডি. জার্নিতে একাধিকবার অর্জন করেছেন বিভিন্ন অ্যাওয়ার্ড ও ফেলোশীপ। অংশগ্রহণ করেছেন বিভিন্ন ন্যাশনাল ও ইন্টারন্যাশনাল বিজ্ঞান ও গবেষণা ভিত্তিক কনফারেন্সে। মারজিয়া খুবই প্রেস্টিজিয়াস ফেলোশীপ অর্জন করেন পি.এইচ.ডি. চলাকালীন সময়ে যেটা প্রতি দুই বছরে শুধুমাত্র একজন ছাত্র/ছাত্রী পায় কেবল ইউনিভার্সিটির সেই বিভাগ থেকে। মারজিয়া খুব বিনয়ের সাথে বলেন, আমার ভাগ্য আমাকে সহায়তা করেছে।

তবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে মারজিয়া কঠিন পরিশ্রম ও সাধনায় নিজের উচ্চশিক্ষার এই সময়টিকে সময়ের বাধে আটকে সাফল্যকেও মুঠোবন্দি করেছেন। ভাগ্যের সাথে সাথে মারজিয়া নিজের জীবনসঙ্গীকেও ধন্যবাদ দেন এই বলে যে, পিএইচডির পাঁচটা বছর আমি একদম স্টুডেন্টদের মতো ব্যাচেলর লাইফই কাটিয়েছি, সংসারের কোনো চাপ আমার নিতে হয়নি। আর এই বিষয়ে আমার জীবনসঙ্গী ও আমি একে অপরকে সর্বোচ্চ সাপোর্ট দিয়েছি।

মারজিয়া পুনরায় মায়ের কথা উল্লেখ করে বলেন, মা সবসময় খুব পজেটিভ আর সাপোর্টিভ ছিলেন। যখন পিএইচডি করছি, মা পড়ার বিষয়ে বেশ তাড়া দিতেন। দেখা গেছে সেসময় অনেকেই বলছে বাচ্চা নেওয়ার কথা, কিন্তু মা বলতেন পিএইচডি’টা শেষ করো। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষে স্কলারশিপ পাওয়ার আগ পর্যন্ত কিছুটা সময় লেগে যায় প্রতিটা শিক্ষার্থীরই। সেসময়টাতে অন্যদের রীতিমতো মাথা ব্যথা হয়ে যায় যে কবে কিছু করতে পারবে, আমার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। সেসময় আশেপাশের অনেকেই বলছিল, কিছু হচ্ছে না কেন, কবে হবে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে কী লাভ হলো ইত্যাদি এই ধরনের কথাবার্তা। কিন্তু আমি বারবারই বলছি আমার মা, আমার পরিবার আমাকে সম্পূর্ণ সাপোর্ট দিয়েছে।

উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার ইচ্ছা কবে হলো সেই প্রসঙ্গে মারজিয়া বলেন, আসলে মিথ্যা বলে বা ভণিতা করে লাভ নেই। সত্যটাই বলছি। আমাদের দেশে বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি নিয়ে কাজ করার সুযোগ নেই। বিষয়টি অনেক সময় ধরে পড়ানো হলেও কাজের ক্ষেত্র তৈরি হয়নি, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের হতাশায় ভুগতে হয়, কারণ চাকরি নেই। ফলে বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি পড়ে বিসিএস বা অন্য চাকরিতে ঢুকতে হয়। অল্প কিছু চাকরির সুযোগ আছে তাও সেগুলো ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি। এসব কোম্পানিগুলো আবার মেয়েদের নিতে খুব একটা আগ্রহী না, কারণ রাতে কাজ থাকে আর আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে মেয়েদের রাতে কাজ করার ক্ষেত্রে অপরাগতা থাকে। তাহলে যারা বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি পড়ে এই বিষয়টিকেই কাজের ক্ষেত্র হিসেবে চায় তাদের জন্য দেশের বাইরে আসা ছাড়া বিকল্প উপায় কী? তবে, আমার কথা আমি বলতে চাই, আমার ছোট থেকেই ইচ্ছা ছিল আমি উচ্চ শিক্ষা অর্জন করবো আর স্বপ্নপূরণের অংশ হিসেবেই দেশের বাইরে আসা।

মারজিয়া স্বপ্ন দেখেন দেশের নারীদের জন্য কিছু করার, হতে পারে কর্মসংস্থান হতে পারে প্রতিকূলতা পেরিয়ে যেতে নারীর জন্য কোনো সাপোর্ট কিংবা এমন কিছু যাতে করে সমাজের আরো দশটি মেয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে, সাফল্য অর্জন করে গর্বিত করতে পারে সমাজ ও রাষ্ট্রকে।

বিবার্তা/এসবি/রোমেল/লিমন

© BBARTA24.NET
Developed by : ORANGEBD
  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত