কক্সবাজারে মাদকের সাথে যোগ হয়েছে অনলাইন জুয়া: ঘরে ঘরে নীরব কান্না

| আপডেট :  ১৩ জুলাই ২০২৪, ১০:৩১  | প্রকাশিত :  ১৩ জুলাই ২০২৪, ১০:৩১


কক্সবাজারে মাদকের সাথে যোগ হয়েছে অনলাইন জুয়া: ঘরে ঘরে নীরব কান্না

আব্দুল্লাহ আল ফরহাদ, কক্সবাজার


কক্সবাজারে অনলাইন জুয়ায় ঘরে ঘরে নীরব কান্না চলছে! এ অঞ্চলে দীর্ঘকালের ‘মাদক’ এর সাথে যোগ হয়েছে অনলাইন জুয়া। কিশোর থেকে বয়স্করাও ডুবেছে অনলাইন জুয়ার নেশায়। মোবাইল অনলাইন ক্যাসিনো জুয়া নামে বহুল পরিচিত অ্যাপসের মাধ্যমে নীরবে শেষ হচ্ছে সাঁজানো-গোছানো অনেক পরিবার, নিঃস্ব হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী পর্যন্ত।

অনলাইন ক্যাসিনোর প্রসার নিয়ে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো: মাহফুজুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমরা সজাগ রয়েছি। গত ৬ জুলাই অনুষ্ঠিত জেলা পুলিশের মাসিক সভায় অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করা হয়েছে। অনলাইন অপরাধসমূহ কঠোর হস্তে দমনের জন্য কক্সবাজারের ৯ থানার ওসিদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।’

তিনি জানান, তবে এখনো পর্যন্ত কোন ভুক্তভোগী বা অন্য কেউ লিখিত অভিযোগ নিয়ে পুলিশের কাছে আসেনি।

এদিকে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তানভীর হোসেন বিবার্তাকে জানান, সীমান্তবর্তী উপজেলা হওয়ায় অনলাইন জুয়ার বিষয়টি নিয়ে গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। গত সপ্তাহের উপজেলা পরিষদের সভায়ও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। যেখানেই জুয়ার খবর পাওয়া যাবে সেখানেই মোবাইল কোর্টের অভিযান চালানো হবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় অনলাইন বেটিং সাইটগুলো হচ্ছে- ওয়ানএক্সবেট, মেলভবট, লাইনবেট, বাবু ৮৮। এগুলোর একটি যথাযথ বিতরণ নেটওয়ার্ক রয়েছে। যেমন মাস্টার এজেন্ট, নিয়মিত এজেন্ট এবং সাব এজেন্ট। খেলোয়াড়রা এ সাইটগুলোতে হারলে এজেন্টরা কমিশন পায়। এজেন্টরা হারানো পরিমাণ থেকে ৬০% পর্যন্ত কমিশন পেয়ে থাকে। এছাড়াও খেলোয়াড়রা যখন টাকা জমা বা উত্তোলন করেন, এজেন্টরা যথাক্রমে ৫% এবং ২% কমিশন পায়। খেলোয়াড়রাও সরাসরি অ্যাপ ডাউনলোড করে অ্যাকাউন্ট তৈরি করতে পারেন। যারা খেলায় অংশগ্রহণ করেন তারা প্রধানত বিকাশ, নগদ এবং রকেটের মাধ্যমে টাকা জমা করেন।

সাম্প্রতিককালে কক্সবাজারে অত্যন্ত কম সময়ের ব্যবধানে উদ্বেগজনকভাবে ছড়িয়েছে মোবাইল মাধ্যমের অনলাইন জুয়া। ইতিমধ্যে মোবাইল ইন্টারনেট অ্যাপসের জুয়ার নেশায় পড়ে ফতুর হয়েছে অনেক লোকজন। কক্সবাজার শহরের অলিগলিতে এমন সব ঘটনার নজির রয়েছেও প্রচুর। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তরা যেমনি মুখ খুলতে বিব্রতবোধ করছেন তেমনি প্রতিবেশী বা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও নাম প্রকাশ করতে চান না।

সংবাদপত্রের জন্য সংবাদ সংগ্রহের কথা শুনে- বছর খানেক আগে এমন নেশায় পড়ে নিঃস্ব হওয়া কক্সবাজার শহরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তরুণ ব্যবসায়ী মুহূর্তেই উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন। তিনি বলেন, ‘দয়া করে লিখেন- সমাজ বাঁচান। আমি যখন খেলতাম তখন ডলার দিয়ে খেলতে হতো। ডলার সহজলভ্য না হওয়ায় আমার মত দুর্ভাগার সংখ্যা তখন কম ছিল। কিন্তু এখন বিকাশ ও নগদ থেকে টাকা দিয়ে খেলা যায়। অতিসহজ হওয়ার কারণেই ডুবছে সমাজ।’ তরুণ এ ব্যবসায়ী বলেন, ভুল পথে পা দিয়ে তিনি শিক্ষা নিয়েছেন। হারিয়েছেন তার প্রিয় গাড়িটি পর্যন্ত।

শহরের রুমালিরছড়ার এক তরুণ এক হাজার টাকায় ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা জিতলে আনন্দ ছড়িয়েছে সাগর পাড়ের একটি রেস্টুরেন্টে। তরুণকে খাবারের বিল দিতে হয়েছে ৪০ হাজার টাকা। জেতার এ জাতীয় খবর কৌশলে ব্যাপকভাবে ছড়ানো হয়। অথচ মুহূর্তেই একটি পরিবার সব হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ার নির্মম কাহিনিটি বরাবরই থাকছে অজানা।

কক্সবাজার পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আমিনুল ইসলাম মুকুল বিবার্তাকে জানান- ‘মোবাইল জুয়ায় আমার এলাকার মহল্লা মহল্লায় অনেক মানুষ নীরবে নিঃস্ব হয়ে গেছে। কৃষি রোড এলাকার বেশ কয়েকজন দোকানি ফতুর হয়ে গা ঢাকা দিয়েছে।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কক্সবাজার জেলার যেখানে টাকার প্রবাহ বেশি সেখানেই অনলাইন ক্যাসিনো জুয়ার রমরমা কারবার। এক্ষেত্রে মহেশখালীর মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্র বন্দর ও তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের হাব হওয়ায় সেখানে অনলাইনের জুয়ার হাট বেশ চাঙ্গা। ওখানকার শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি আসক্ত হয়ে পড়েছে। অনলাইন জুয়ার নেপথ্যে লোকজনকে উৎসাহিত করার কাজেও বেশ কিছু লোকের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। এসব লোকজন ইতিমধ্যে প্রচুর টাকা ও জায়গা-জমির মালিক বনে গেছেন। মাতারবাড়ীর মধ্যম রাজঘাট এলাকার তিনজন এ কাজে জড়িত বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন।

মাতারবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মাস্টার মোহাম্মদ উল্লাহ জানান, ‘চোখের সামনে প্রকল্পের কাজ নিয়ে কোটিপতি হওয়া ব্যবসায়ী জুয়ায় এখন নিঃস্ব হয়ে গেছেন। মাইজপাড়া ও সিকদারপাড়া গ্রামের দুই কোটিপতিকে একপ্রকার ফকির বানিয়ে দিয়েছে অনলাইন ক্যাসিনো।’

মাতারবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান আবু হায়দার বিবার্তাকে বলেন, ‘আমার এলাকায় এটি ‘মহাগজব’ হয়ে দেখা দিয়েছে। মগডেইল গ্রামের সোহেল নামের এক তরুণ কোটিপতি ব্যবসায়ী অনলাইন জুয়ার নেশায় পড়ে ভিটেবাড়ি সর্বস্ব হারিয়ে এখন বিদেশ পাড়ি দিয়েছেন।’

কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ সীমান্তবর্তী উপজেলা জনপদও অনলাইন ক্যাসিনোর জুয়ায় ভাসছে। টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী বিবার্তাকে জানান, ‘আমার পরিষদের চৌকিদার (গ্রাম পুলিশ) নুরুল আমিনও অনলাইন জুয়ার নেশায় আসক্ত হয়ে এখন নিঃস্ব। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, তার কাছে বিচারপ্রার্থী জনগণের জমা রাখা কয়েক লাখ টাকাও সে জুয়ায় হারিয়েছে।’

উখিয়া উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান রাসেল চৌধুরী বিবার্তাকে বলেন, ‘উখিয়ার গ্রাম-গঞ্জে অনলাইন জুয়ায় টাকা-পয়সা হারিয়ে ঘরে ঘরে নীরব কান্না চলছে। ইয়াবা যখন প্রথম দিকে এলাকা গ্রাস করছিল- তখন কেউ এটার নাম নিত না। ঠিক অনুরূপ অনলাইন জুয়ার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। কেউ মুখ খুলে প্রকাশ করতে চাচ্ছে না।’

বিবার্তা/রোমেল/এমজে

© BBARTA24.NET
Developed by : ORANGEBD
  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত