কোটা আন্দোলন: বিধ্বস্ত মিরপুর-১০, ক্ষতবিক্ষত মেট্রোরেল

| আপডেট :  ২৫ জুলাই ২০২৪, ০৯:১২  | প্রকাশিত :  ২৫ জুলাই ২০২৪, ০৯:১২


কোটা আন্দোলন: বিধ্বস্ত মিরপুর-১০, ক্ষতবিক্ষত মেট্রোরেল

জাতীয়

সোহেল আহমেদ


কোটাবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের জেরে গত ১৯ জুলাই মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর পুলিশ বক্স আগুনে জ্বালিয়ে দেয় কোটাবিরোধীরা। সেই আগুনের লেলিহান মেট্রোরেল পর্যন্ত উঠে যায়। এছাড়া মেট্রোরেলের মিরপুর ১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে কোটাবিরোধীরা। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় স্টেশন দু’টির। পরে নিরাপত্তার স্বার্থে ওইদিন বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর গত ৭ দিন ধরে মেট্রোরেল চলাচল বন্ধ রয়েছে। কবে নাগাদ আবার মেট্রোরেল চালু হবে সেই বিষয়ে এখনো স্পষ্ট কিছু বলতে পারছে না ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।

মেট্রোরেল সূত্রে জানা গেছে, মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া মেট্রোরেল স্টেশন পুনরায় চালু করতে ৬ মাস থেকে এক বছর লেগে যাবে। এই স্টেশন দুটিতে ক্ষতিগ্রস্ত সব যন্ত্রপাতি জার্মানি থেকে এনে নতুন করে বসাতে হবে। পাশাপাশি কারিগরি প্রক্রিয়াও সম্পন্ন করতে হবে। এরপরই পুরোদমে চালু হবে মেট্রোরেল।

২৫ জুলাই, বৃহস্পতিবার বেলা ১টার দিকে মিরপুর-১০ নম্বরে সরেজমিনে দেখা যায়, মিরপুর-১০ গোলচত্বর লাগোয়া রাস্তার দু’পাশের একটি ফটক বাদে বাকি তিনটিতে তালা দেওয়া। স্টেশনের ‘সি’ ফটকে দায়িত্ব পালন করছিলেন ডিএমটিসিএল এর দুই সদস্য। স্টেশনে উঠতে চাইলে তারা জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্টেশন পরিদর্শন শেষ করে যাওয়ার পর থেকে স্টেশনের দ্বিতীয় তলায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নিয়েছেন। ওপরে যেতে হলে তাদের অনুমতি লাগবে। এছাড়া ওপরে ওঠা যাবে না।  

স্টেশনের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএমটিসিএল এর একজন কর্মকর্তার সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, মিডিয়ার সাথে কথা বলায় নিষেধ আছে। তিনি জানান, হামলাকারীরা দু’টি ফটক ভেঙে স্টেশনের দ্বিতীয় তলা পর্যন্ত প্রবেশ করতে পেরেছে। এসময় হামলাকারীরা দ্বিতীয় তলায় থাকা বিল্ডিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, প্ল্যাটফর্মের দরজা খোলা ও বন্ধ করার মেশিন, সিসিটিভি ওয়ার্ক স্টেশন, রেভিনিউ কন্ট্রোল ও ডাটা স্টক করার মেশিন ‘স্কোয়াট’ ভেঙে চুরমার করে দেয়। সরাসরি টাকা দিয়ে টিকিট সংগ্রহের জন্য জাপান থেকে আনা ছয়টি ভেন্ডিং মেশিনও ভেঙে ফেলেছে আন্দোলনকারীরা। এছাড়া মনিটরসহ বিভিন্ন নির্দেশক যন্ত্র ভেঙে ফেলা হয়েছে।

তিনি বলেন, আন্দোলন হচ্ছে রাস্তায়। মেট্রোরেল একটি আধুনিক স্থাপনা। স্টেশনের ভেতর এসে এভাবে ভাঙচুর করা উচিত হয়নি। ভাঙচুরে দিনশেষে কার লাভ হলো? সাধারণ মানুষই তো ভুক্তভোগী।

তালা দেয়া স্টেশনের ‘এ’ গেটের কাছে গিয়ে দেখা যায়, মেট্রোরেল স্টেশনে ওঠার সিঁড়িতে ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ভেঙে পড়ে আছে কাঁচের টুকরো। স্তূপ করে রাখা ছাই। আর একপাশে রাখা রয়েছে মেট্রোরেলের তথ্য নির্দেশিকা। ওই গেটের পাশেই এসএস ভবন। এই ভবনের একটি দোকানের কর্মী সোহাগ। তিনি বিবার্তাকে বলেন, আগুন দেওনের আগে মেট্রোরেলে উঠতে মানুষ লাইন ধইরা উঠানামা করতো। আগুন দেওনের পর থিকা এই গেইটে তালা দিয়া রাখছে। দোকানের কামে আমিও কয়েকবার মেট্রোরেলে মতিঝিলে গেছি। ওঠতে পারলেই মতিঝিল! এহন তো সব বন্দ, আল্লাই জানে কবে খুলব।

মিরপুর-১০ এর পানির ট্যাংক রোডের বাসিন্দা আব্দুল আজিজ মান্না। তিনি বিবার্তাকে বলেন, মেট্রোরেলে আগুন দেওয়ার কি দরকার ছিল বলেন তো। কবে ঠিক হবে তাও কেউ বলতে পারছে না। ফার্মগেট, শাহবাগে যেকোনো দরকারে যখন তখন চলে গিয়েছি। টাইম ফিক্সড ছিল। বাসে যেতে তো এক ঘণ্টা লাগে। আসলে আমরা ভালো জিনিসের কদর জানি না।

মেট্রোরেল সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া মেট্রোরেল স্টেশনের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। বিশেষ করে মিরপুর-১০ স্টেশনের ই-সিস্টেমের পুরোটাই ধ্বংস হয়ে গেছে। এ সিস্টেম পুনরায় সচল করতে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা লাগতে পারে। কাজীপাড়া স্টেশনের ই-সিস্টেম অর্ধেকের বেশি নষ্ট হয়ে গেছে। এই স্টেশনের ই-সিস্টেম ঠিক হতেও ১০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে। ই-সিস্টেম ছাড়াও দুই স্টেশনে থাকা পাঞ্চ মেশিন, ভেন্ডিং মেশিন, বিভিন্ন ডিভাইস, কম্পিউটারসহ আরও যে সব জিনিসপত্রের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তাও ঠিক করতে প্রায় ২০০ কোটি টাকা লেগে যেতে পারে।

এদিকে মেট্রোরেলের ক্ষতি নিরূপণে আট সদস্যের কমিটি গঠন করেছে ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ। এই কমিটি ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিবে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে ডিএমটিসিএল এর অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক (ইলেকট্রিক্যাল, সিগন্যাল, টেলিকমিউনিকেশন অ্যান্ড ট্র্যাক) যুগ্মসচিব মো. জাকারিয়াকে। এছাড়া হামলার ঘটনায় মিরপুর মডেল থানা ও কাফরুল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। তদন্ত শেষে হামলার ঘটনায় মামলা করা হবে।

জানতে চাইলে ডিএমটিসিএল যুগ্মসচিব মো. জাকারিয়া বিবার্তাকে বলেন, মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া মেট্রোরেল স্টেশনের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়ে একটি কমিটি করে দেয়া হয়েছে। আমরা আমাদের কাজ শুরু করেছি। ১০ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করব।

২৫ জুলাই, বৃহস্পতিবার ডিএমটিসিএল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক গণমাধ্যমকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেট্রোরেল স্টেশনটি দেখে গেছেন। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে স্টেশন দু’টির। প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন, সেইটাই আমাদের বক্তব্য। মেট্রোরেল কবে চালু হবে সেটা সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে জানানো হবে।

এদিকে বৃহস্পতিবার সকালে মিরপুর-১০ নম্বর মেট্রোরেল স্টেশন পরিদর্শন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া মেট্রো স্টেশন ঘুরে দেখেন তিনি। একপর্যায়ে স্টেশনের ধ্বংসলীলা দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী। এ সময় তাকে বারবার অশ্রু সংবরণের চেষ্টা করতে দেখা যায়।

সরকারের উন্নয়ন ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে দেশবাসীকে আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যেসব স্থাপনা মানুষের জীবনকে সহজ করে- সেগুলো ধ্বংস করা আসলে কোন ধরনের মানসিকতা? ঢাকা শহর যানজটে নাকাল থাকলেও মেট্রো স্বস্তি দিয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তির মেট্রো স্টেশন যেভাবে ধ্বংস করা হয়েছে, মানতে পারছি না।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাধারণ মানুষ যেন নির্বিঘ্নে কর্মক্ষেত্রে পৌঁছাতে পারে সেটা সুনিশ্চিত করা হবে। দেশটা যাতে আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে পারে সেই চেষ্টাই করবো। এ দেশের মানুষ রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে। সেই দেশটা ব্যর্থ হতে পারে না।

বিধ্বস্ত মিরপুর ১০ গোলচত্বর

রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম মিরপুর-১০ গোলচত্বর। গত ১৬ জুলাই কোটাবিরোধীদের চলমান আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নেয়। ওইদিনই সারা দেশে দিনভর চলে ব্যাপক বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ। কোটাবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা শুরু হয়। রাজধানীর যেসব এলাকায় আন্দোলনকারীদের সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে তার অন্যতম মিরপুর।

সংঘর্ষের সময় কোটাবিরোধীদের দেয়া আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর ট্র্যাফিক পুলিশ বক্স। গোলচত্বরের চারদিকে ওঠানামা করার যে ফুট ওভারব্রিজ ছিল, আগুনে পুড়ে সেটিও বিধ্বস্ত। ঘটনার সাতদিন পার হলেও মিরপুরের ধ্বংসযজ্ঞের নমুনা এখনো স্পষ্ট।

সরেজমিন দেখা যায়, ওভারব্রিজের চারপাশের প্রবেশ পথ টিন দিয়ে বন্ধ করে রেখেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। আর সেই টিনের ওপরে লেখা ‌‌‘এই ওভারব্রিজটি ঝুঁকিপূর্ণ। ব্যবহার করা নিষেধ। আদেশক্রমে:- ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন।’

গোলচত্বর লাগোয়া মেট্রোরেলের প্রবেশপথে সুনসান নীরবতা।

আগুনে পুড়ে বিধ্বস্ত ওভারব্রিজের নিচে দায়িত্ব পালন করছেন ট্র্যাফিক পুলিশের সদস্যরা। আর তাদের পাশ দিয়েই ফুট ওভারব্রিজ বন্ধ থাকায় ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। পথচারীদের একজন রমজান আলী। তিনি বিবার্তাকে বলেন, এতো বড় মোড়। বড় বড় গাড়ি চলাচল করে। ফুট ওভারব্রিজ নষ্ট তাই ঝুঁকি নিয়েই পারাপার হচ্ছি। কখন কি হয় বলা যায়! এসময় তিনি ফুট ওভারব্রিজটি দ্রুত ঠিক করার দাবিও জানান।

বিবার্তা/সোহেল/রোমেল

© BBARTA24.NET
Developed by : ORANGEBD
  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত