‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস অবশ্য পাঠ্য করা আবশ্যক’

| আপডেট :  ২৫ জুলাই ২০২৪, ১১:২৭  | প্রকাশিত :  ২৫ জুলাই ২০২৪, ১১:২৭


‘স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস অবশ্য পাঠ্য করা আবশ্যক’

সাক্ষাতকার

সামিনা বিপাশা


জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এর উপাচার্য অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান সাম্প্রতিক সময়ে কোটাবিরোধী আন্দোলন, আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা ও নাশকতার ফলে দেশে উদ্ভূত পরিস্থিতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ ও চলমান সংকট নিরসনের নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন বিবার্তার সাথে। সেই আলাপচারিতার চুম্বক অংশ পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো-

বিবার্তা: আন্দোলন ও সহিংসতাকে কেন্দ্র করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার পরিবেশ ক্ষুণ্ন হয়েছে, শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে কী করণীয়?

ড. মশিউর রহমান: শিক্ষার্থীদের যে কোটা সংস্কার আন্দোলন, এটি এই মুহূর্তেই বা তারপর দিন প্রয়োজন- এরকম কোনো ইস্যু ছিল না। তাদের ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য একটি চাকরির নিশ্চয়তা বা সরকারি চাকরিতে অধিকার প্রতিষ্ঠা- সেটার জন্য আন্দোলন। সে হিসেবে বিষয়টি এমন ছিল না যে তার সুরাহা ওই মুহূর্তেই বা ওই সময়ের মধ্যে বা ২৪ বা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই হতে হবে।

আন্দোলনে বিষয়টি তারা উত্থাপন করেছে। যারা আন্দোলনে ছিল বা যারা দাবি উত্থাপন করেছে- তাদের কারোই এমন না যে কয়েকদিনের মধ্যে বিসিএস পরীক্ষা হওয়ার কথা বা লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে- সেরকম হলে তার তো ক্যাম্পাসেই থাকার কথা না। সেক্ষেত্রে নিয়মিত ক্লাসে যাচ্ছে এরকম শিক্ষার্থীরা তাদের ভবিষ্যতের জন্য কথা বলছিল- বিসিএসসহ অন্যান্য পরীক্ষায় সরকারি চাকরিতে কোটার বিষয়ে। সেটি এমন না যে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংসদ ডেকে সমাধান করতে হবে। কিন্তু যখন তাদের মধ্য থেকে এই কথাটা বলা হলো, তখন তাদের অস্থিরতা বা তাড়াহুড়ো ছিল।

আমি তাড়াহুড়োই বলবো, সেখানে তাদের আরো সহনশীল হওয়া উচিত ছিল। এই কারণে যে রাষ্ট্রপক্ষ কিন্তু তিন দিনের মধ্যে আপিল করেছে। অর্থাৎ যখনই হাইকোর্ট বলেছে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের মধ্যে কেউ বা প্রজন্মের কেউ হাইকোর্টে রিট করার কারণেই আদালত সরকারের সিদ্ধান্তকে বাতিল করলে কোটা প্রবর্তনের বিষয়টা যখন সামনে আসে- সেটি যখনই সরকারের নজরে এসেছে- সরকার কিন্তু ২০১৮ সালের সিদ্ধান্ত অর্থাৎ কোনো কোটা প্রয়োজন নাই ওই সিদ্ধান্তেই থাকতে চেয়েছে।

এরপর যখন স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন গড়ে উঠেছে। তখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনার উদ্যোগ আরো জোরালোভাবে নেওয়া উচিত ছিল। শিক্ষক হিসেবে আমাদের দায়বদ্ধতা এই যে, ফলপ্রসূ আলোচনার যথাযথ উদ্যোগ আরো পূর্বে গৃহীত হলে বিষয়টি জাতীয় পর্যায়ে গিয়ে আজকের যে বাস্তবতায় পৌঁছেছে সেখানে পৌঁছাত না। আন্দোলন যৌক্তিক বা অযৌক্তিক যাই হোক- যেহেতু তারা নিয়মিত শিক্ষার্থী, এই আন্দোলনের বিষয়ে আলোচনার সুযোগ ছিল। সেখানে একটা দূরত্ব কোনো কারণে তৈরি হয়েছে।

বিবার্তা: কোটাবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারাদেশে সহিংসতা ও তাণ্ডবলীলা চলল, এটা কি প্রথমেই শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা যেত না?

ড. মশিউর রহমান: কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধান স্টেকহোল্ডার হলো শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা নানা সময়ে নানা পথের, মতের হয়ে থাকে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় তারা রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত। শুধুই ছাত্র সংগঠনগুলো ছাত্রদের ন্যায্য দাবি নিয়ে কথা বলে তেমনটি না, রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা আছে, সেটি কখনো ক্ষমতাসীন বা ক্ষমতার বাইরের দল, এমনকি ধর্মীয় ভাবার্দশের অঙ্গসংগঠন থাকছে- এটি বাংলাদেশের বাস্তবতা। সেই সংগঠনগুলোরই একটা পর্যায়ে বিবদমান অবস্থা হয়েছে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দূরত্ব হয়েছে, ছাত্র সংগঠনগুলোর সাথে হয়েছে।

আমরা আমাদের জায়গা থেকে যথেষ্ট দায়িত্বপূর্ণ না হওয়ায় ক্যাম্পাস থেকেই সমস্যা বিস্তৃত হয়েছে। সারাদেশের অবস্থা ঠিক হয়ে আসলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই স্ব স্ব দায়িত্ব নিতে হবে। শিক্ষার্থীদের সাথে শিক্ষকদের সম্পর্ক, ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক এবং ছাত্রদের প্রতিনিধির বা ছাত্রদের সঙ্গে প্রশাসনের সম্পর্ক। তিনটি জায়গায় কাজ করার আছে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রশাসন বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন বা শিক্ষকদের সম্পর্ক, সাধারণ রাজনৈতিক সম্পর্কগুলোর মধ্যে সম্পর্ক, এমনকি কমিউনিটি পর্যায়ে অভিভাবকদের সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। এভাবে প্রত্যেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্ব উদ্যোগে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের মধ্যে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া উচিত। অভিভাবকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাদেরও মতামত নেওয়া উচিত। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর ক্ষেত্রে আমি যেমন চাইবো, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য আমি একই পরামর্শ বা আহ্বান জানাবো। শিক্ষার্থীদের দাবি দাওয়া বিষয়ে স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগ হওয়ার জন্য আমার আহ্বান থাকবে।

বিবার্তা: কোটাসংস্কার আন্দোলনে শিক্ষক ছাত্রদের প্রহারের শিকার হয়েছেন, এতে করে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে?

ড. মশিউর রহমান: এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে আস্থার সংকট। পরস্পর পরস্পরকে আস্থার মধ্যে আনতে পারছি না। এই আস্থার জায়গা আনতে আমরা অভিভাবক হিসেবে একদম নির্লিপ্ত থাকতে পারি না। আমি মনে করি, শিক্ষকদের এখনো সমাজে সেই মর্যাদা আছে। স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানে বহু শিক্ষক বা গুণীজন রয়েছে। তাদের সকলকে নিয়ে যদি উদ্যোগ নেওয়া হয়, আমি নিশ্চিত যে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে দূরত্ব আছে সেগুলো কমিয়ে আনা সম্ভব। অতীত অভিজ্ঞতা বলে, ছাত্ররা নিজস্ব বা অন্যান্য বিষয়ে আবেগতাড়িত হয়, আবার আলোচনার টেবিলে যুক্তিতর্কের মধ্য দিয়ে তাদের যৌক্তিক জায়গায় আনা সম্ভব বলে আমার বিশ্বাস।

বিবার্তা: কোটাসংস্কারকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে স্লোগান উঠেছিল, ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’। মেধাবীদের মুখে এমন স্লোগান আপনি কীভাবে দেখছেন?

ড. মশিউর রহমান: এটার জন্য প্রথম দায়টি আমাদেরও নেওয়া উচিত। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস অবশ্য পাঠ্য করা হোক- এ জাতীয় একটি বিষয় বহু আগে থেকেই নানা জায়গা থেকে বলা হয়েছে এবং দাবিটি ছিল। এটি শিক্ষাবিদরাই বলেছেন। আজও পর্যন্ত সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে সবগুলো বিষয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস অবশ্য পাঠ্য হিসেবে পড়ানো হয় বলে আমার মনে হয় না।

তরুণ শিক্ষার্থীদের দোষারোপ করার আগে আমাদের জানতে হবে, আমরা প্রাথমিক স্তরে, মাধ্যমিক স্তরে, মাদ্রাসায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সারাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় সম্পর্কে যথার্থ শিক্ষা দেই কি না। যদিও আমরা আমাদের ২২৬০টি কলেজে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় পড়াই। তাই সরকার, শিক্ষাবিদ, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অতি দ্রুত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় সম্পর্কে অবশ্য পাঠ্য হিসেবে জ্ঞান দানের পরে তবেই আমরা প্রশ্ন করতে পারি, আমরা তাদেরকে যথার্থভাবে তৈরি করতে পেরেছি কি না।

আজকে শিক্ষার্থীরা তাদের বুকে-মুখে যে স্লোগান গ্রহণ করেছে, এই গ্রহণের পেছনে আমাদের ব্যর্থতা আছে। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস সর্বস্তরে পড়ানোর যে উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন ছিল সেটি হয়ে ওঠেনি, সেটি অত্যন্ত দুঃখের এবং পরিতাপের।

বিবার্তা: বাংলাদেশে কোনো সমস্যা উদ্ভূত হলেই ছাত্র রাজনীতি বন্ধের রব ওঠে, কিন্তু এটি বাদ দেওয়াও সম্ভব নয়, আপনি কীভাবে বিষয়টি দেখেন?

ড. মশিউর রহমান: ছাত্র রাজনীতি বিষয়টি বড় বিষয় নয়। ছাত্র রাজনীতিতে কাঠামোগত পরিবর্তন অত্যাবশ্যক।

ছাত্র রাজনীতি ছাত্রদের বিষয়ে, ছাত্রদের সুবিধাদি, তাদের আধুনিক মনোভঙ্গি, দৃষ্টিভঙ্গি, তাদের বিশ্বজনীন করা, তাদের দক্ষ ও যোগ্য করে তোলা, স্মার্ট সিটিজেন হিসেবে গড়ে তোলা, এই সব বিষয় গ্রহণপূর্বক যদি ছাত্র রাজনীতি গড়ে উঠত বা গড়ে ওঠে, সেই পরিমার্জনের সুযোগ এখনো আছে। তাহলেই ছাত্র রাজনীতির ইতিবাচকতা তৈরি হবে।

এখন ছাত্র রাজনীতি মানে কিছু শীর্ষ নেতার ভালো থাকা এবং বাকি অসংখ্য কর্মীর তাঁবেদারি মনোবৃত্তি তৈরি হচ্ছে- এটি ছাত্র রাজনীতির ঐতিহ্যের সঙ্গে বেমানান। ছাত্র রাজনীতির কাঠামোগত পরিবর্তন হওয়া আবশ্যক এবং সেটি আদর্শভিত্তিক না হলে যা হয়- আমরা সেটিই দেখছি। অনেক ক্ষেত্রেই সেটি আদর্শ চর্চার বিপরীতে অন্যান্য কাজে সম্পৃক্ততা বেশি। ছাত্র রাজনীতিকেও এই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

বিবার্তা: শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে সংশ্লিষ্ট সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন আপনি, সেক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কবে নাগাদ কার্যক্রম শুরু করতে পারবে?

ড. মশিউর রহমান: ইন্টারনেট নিরবিচ্ছিন্নভাবে যখন চালু হবে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুব দ্রুত অনলাইন ক্লাসে ফিরে যেতে পারবে- যেকোনো মুহূর্তে। ব্লেন্ডেড এডুকেশন অ্যাপ্রোচ গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশে আমরা নানা সময় মহামারি, অসুখ বিসুখ, সংকট নানা কিছুর মধ্যে নিপতিত হই, তাই শুধু সংকটেই নয়, সংকটের বাইরেও ব্লেন্ডেড অ্যাপ্রোচ এডুকেশনের বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে।

ব্লেন্ডেড এডুকেশন মাস্টার প্ল্যান চূড়ান্ত করে ইতোমধ্যে সরকারকে দেওয়া হয়েছে। সেটি খুব দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও মন্ত্রণালয়ের নেওয়া উচিত। এই সব সংকটে ব্লেন্ডেড অ্যাপ্রোচে গেলে ফেস টু ফেস এডুকেশনের ব্যত্যয় ঘটে- সেক্ষেত্রে অনলাইন ক্লাস নিতে কোনো বাধা দেখি না। শুধুমাত্র ক্লাস রুমে এনেই পড়াতে হবে এমন আবশ্যকতা নেই। শিক্ষার অনেক রকম পথক্রম আছে। সুতরাং জরুরি অবস্থার ক্ষেত্রে দ্রুত অনলাইন ক্লাস চালু করা যেতে পারে। একটা পরিবেশ তৈরি করেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেস টু ফেস ক্লাস শুরু হওয়া উচিত।

বিবার্তা/এসবি/রোমেল/এমজে

© BBARTA24.NET
Developed by : ORANGEBD
  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত