‘পুলিশ স্যার’কে মেরে ফেলে রাখা হয়েছে

| আপডেট :  ০২ আগস্ট ২০২৪, ০৫:৫৭  | প্রকাশিত :  ০২ আগস্ট ২০২৪, ০৫:৫৭


‘পুলিশ স্যার’কে মেরে ফেলে রাখা হয়েছে

জাতীয়

বিবার্তা প্রতিবেদক


শুক্রবার (১৯ জুলাই), কোটাবিরোধী আন্দোলন ঘিরে উত্তাল রাজধানী। তার মধ্যে রামপুরা-বনশ্রী এলাকা ছিল বেশ উত্তপ্ত।

ছুটির দিন হওয়ায় সেদিন বাসাতেই ছিলেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পরিদর্শক মাসুদ পারভেজ ভূঁইয়া (৫১)। পরিস্থিতি বিবেচনায় তাকে বাসা থেকে বের হতে নিষেধ করেছিলেন পরিবারের সদস্যরা। মাসুদ পারভেজ নিজেও ফোন করে আত্মীয়স্বজন ও সহকর্মীদের সাবধানে থাকতে বলেন।

কিন্তু অন্যকে সাবধান করা মাসুদ পারভেজ নিজে সাবধানে থাকতে পারলেন না। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সহিংসতার শিকার হয়ে মারা গেলেন তিনি।

সেদিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে ছয়তলার বাসা থেকে নিচে নামেন মাসুদ পারভেজ। মাসুদ পারভেজকে এলাকার সবাই চিনতেন। রাস্তায় বের হলে আন্দোলনকারীরা তাকে চিনতে পারেন। পরে তার উপর হামলা চালায় আন্দোলনকারীরা। আঘাত করা হয় সারা শরীরে। ছিনিয়ে নেয়া হয় সাথে থাকা দুইটি ফোন ও মানিব্যাগ।

কিছুক্ষণ পর মাসুদ পারভেজের স্ত্রীর কাছে ফোন আসে। বাসার সামনে ভিড় করে আছেন একদল মানুষ। তারা বলছিলেন, বনশ্রী প্রধান সড়কের পাশে ফরাজী হাসপাতালের সামনে ‘পুলিশ স্যার’কে মেরে ফেলে রাখা হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এলাকার লোকজন আলোচনা করছিলেন বনশ্রী প্রধান সড়কের পাশে ফরাজী হাসপাতালের সামনে পুলিশকে মেরে ফেলে রাখা হয়েছে। তারা আরও জানান পুলিশ পরিচয় পাওয়ার পর হামলা করা হয়।

নিহত মাসুদ পারভেজের স্ত্রী মেরিনা আক্তার (বীণা) বললেন, যে মানুষটি নিজে ফোন করে সবাইকে সতর্ক থাকতে বললেন, তিনিই সতর্ক থাকতে পারলেন না। করুণ পরিণতির শিকার হয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন।

মেরিনা আক্তার বলেন, গত ১৯ জুলাই রাত পৌনে ৮টার দিকে একটি ফোন আসে তার নম্বরে। অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, এই মুঠোফোন নম্বরের লোককে বনশ্রী প্রধান সড়কের সামনে মেরে ফেলে রাখা হয়েছে। পরিচয় জানতে চাইলে ফোনের লাইন কেটে দেয়া হয়। এমন অবস্থায় মেরিনা ভেবে পাচ্ছিলেন না কী করবেন। তার স্বামীর আরেকটি মুঠোফোন দিয়ে নারায়ণগঞ্জ পিবিআইয়ে তার স্বামীর এক সহকর্মীর কাছে ফোন করে ঘটনা জানিয়ে খোঁজ নিতে বলেন। এরই মধ্যে ভবনের সামনে লোকজন ভিড় করেন।

তারা বলেন, ‘পুলিশ স্যার’কে মেরে ফেলা হয়েছে। মাসুদ পারভেজকে এলাকার সবাই চিনতেন। তখন বাচ্চাদের নিয়ে বের হতে সাহস পাননি মেরিনা। পরে চার প্রতিবেশী বনশ্রী প্রধান সড়কে গিয়ে দেখতে পান, এক নারী রক্তাক্ত অবস্থায় মাসুদ পারভেজকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাচ্ছেন। ঘণ্টাখানেক পরে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস হাসপাতাল থেকে ফোন করে জানানো হয়, মাসুদ পারভেজ ওই হাসপাতালে আছেন।

মেরিনা বলেন, বাইরে থেকে সিটি স্ক্যান করানো গেলে হয়তো তার স্বামীকে বাঁচানো যেত; কিন্তু চিকিৎসকেরা বলেন, বাইরে নেয়ার মতো তার স্বামীর শারীরিক অবস্থা নেই।

ওই রাতে বাচ্চাদের বাসায় রেখে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে যান মেরিনা। ভেতরে ঢুকে দেখতে পান, স্বামী লাইফ সাপোর্টে। মাথায়-পায়ে ব্যান্ডেজ, বুকসহ সারা শরীরে পেটানোর চিহ্ন।

দুইদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ২১ জুলাই বেলা ১১টার দিকে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস হাসপাতালে মৃত্যু হয় মাসুদ পারভেজের। গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার কালান্দরে তাকে দাফন করা হয়। হামলাকারীরা মাসুদ পারভেজের কাছ থেকে দুটি মুঠোফোন ও মানিব্যাগ নিয়ে যায়। ওই মানিব্যাগে ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড ও রেশন কার্ড ছিল।

২৩ জুলাই মেরিনা আক্তার বাদী হয়ে তার স্বামী মাসুদ পারভেজ ভূঁইয়া হত্যার ঘটনায় খিলগাঁও থানায় মামলা করেন।

এতে বলা হয়, বিএনপি, জামায়াত–শিবির, এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের অজ্ঞতানামা দুর্বৃত্ত ও বিক্ষোভরত দুষ্কৃতকারীরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে হত্যার উদ্দেশ্যে মাসুদ পারভেজের ওপর হামলা চালায়।

মামলাটি তদন্ত করছে পিবিআইয়ের ঢাকা মেট্রো দক্ষিণ বিভাগ। মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সারোয়ার আলম।

মো. সারোয়ার আলম বলেন, ওই ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

মাসুদ পারভেজ-মেরিনা আক্তার দম্পতির দুই মেয়ে, এক ছেলে। বড় মেয়ে উম্মে মাইশা স্নেহা বেসরকারি ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজিতে (সম্মান) প্রথম বর্ষে পড়েন। আরেক মেয়ে উম্মে মাহিরা নেহা এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন। আর ছেলে আহনাফ মাহিন ভূঁইয়া অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে।

এখন তিন সন্তানকে নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন মেরিনা আক্তার।

ছেলেকে প্রকৌশলী বানানোর স্বপ্ন ছিল মাসুদ পারভেজের। নিজের পরিবার চালানোর পাশাপাশি গ্রামে থাকা মাকেও খরচ দিতেন। এখন কীভাবে তাদের পরিবার চলবে, সন্তানদেরও কীভাবে লেখাপড়া চালিয়ে নেবেন, তা ভেবে দিশাহারা মেরিনা আক্তার।

এরই মধ্যে অবশ্য পুলিশের মহাপরিদর্শক তাদের জন্য আট লাখ টাকার এফডিআর করে দিয়েছেন।

বিবার্তা/লিমন

© BBARTA24.NET
Developed by : ORANGEBD
  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত