যাত্রীদের মারধরে হয়নি চালক ও কন্ডাক্টরের মৃত্যু, গল্প সাজিয়েছেন হেলপার: পুলিশ

| আপডেট :  ১০ এপ্রিল ২০২৪, ০১:৫৫  | প্রকাশিত :  ১০ এপ্রিল ২০২৪, ০১:৫৫


যাত্রীদের মারধরে হয়নি চালক ও কন্ডাক্টরের মৃত্যু, গল্প সাজিয়েছেন হেলপার: পুলিশ

সারাদেশ

সাভার প্রতিনিধি


বাড়তি ভাড়া নিয়ে বাগ্‌বিতণ্ডার জেরে আশুলিয়ায় যাত্রীদের মারধরে চালক ও কন্ডাক্টরের মৃত্যুর অভিযোগ উঠলেও ভিন্ন তথ্য পাওয়ার দাবি করেছে পুলিশ। বরং আরেকটি বাসের চাপায় তারা নিহত হয়েছেন। নিজেকে বাঁচাতে যাত্রীদের মারধরের গল্প সাজিয়েছেন সেই বাসের হেলপার। আর তিনিই তখন চালকের আসনে ছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য, সিসিটিভি ফুটেজ ও হেলপারকে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে এসেছে এমন তথ্য।  

এ ঘটনার একটি সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, গত সোমবার (৮ এপ্রিল) আশুলিয়ার ডিইপিজেড এলাকায় নবীনগর-চন্দ্রামুখী মহাসড়কের লেনে ইতিহাস পরিবহনের একটি বাস দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর একটি দূরপাল্লার বাস পাশ দিয়ে চলে যায়। এরপর বাসের গেট ঘিরে মানুষের ভিড়। যাত্রীরা যে যার মতো নামছেন। কিছুক্ষণ পর দুজনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাসপাতালে নেওয়ার কিছুক্ষণ পর মারা যান ইতিহাস পরিবহনের বাসটির চালক সোহেল রানা ও কন্ডাক্টর হৃদয়। তাঁদের সঙ্গে থাকা বাসের হেলপার আব্দুর রহমান দাবি করেছিলেন, বাড়তি ভাড়া নিয়ে বিতণ্ডার জেরে যাত্রীরা তাঁদের মারধর করেন। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিলে তাঁদের মৃত্যু হয়। এ সময় আব্দুর রহমান প্রাণের ভয়ে পালিয়ে যান।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সুমন শেখ বলেন, গতকাল আমি আমার পরিবারের লোকজনকে গাড়িতে তুলে দিতে আসি। এসময় দেখতে পাই, ইতিহাস বাসের গেটে দুজন ঝগড়া ও হাতাহাতি করছে। এরপর একটি বড় বাস তাদের ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। এরপর তাঁদের নিচে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। আর বাসের ভেতরে চালকের আসনে বসে থাকা কালো গেঞ্জি পরা এক লোক জানালা দিয়ে লাফিয়ে পালিয়ে যায়। পরে আহত দুজনকে উদ্ধার করে পুলিশ ও লোকজন হাসপাতালে নিয়ে যায়।

এদিকে নিহতদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন, সিসিটিভি ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানসহ প্রাথমিক তদন্তে বিষয়টি সন্দেহজনক মনে হয় পুলিশের। ঘটনার সূত্র ধরে তদন্ত শুরু করলে আসল ঘটনা বেরিয়ে আসতে শুরু করে।

আশুলিয়া থানার পুলিশ বলছে, দুজনের মৃত্যু মারধরে হয়নি। বাস থেকে নেমে যাত্রী ডাকাডাকির সময় দুই বাসের মাঝখানে পড়ে তাঁদের মৃত্যু হয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজ থেকে পুলিশ বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে।

গত সোমবার ঘটনার পরপর বাসচালকের সহকারী নিহত মো. হৃদয়ের ভাই আতিকুর রহমান দাবি করেছিলেন, ওই দিন বিকেল চারটার দিকে তিনি এ ঘটনার খবর পান। পরে বাসের চালকের আরেক সহকারীর কাছ থেকে জানতে পারেন, ইতিহাস পরিবহনে ঢাকার মিরপুর থেকে গাজীপুরের চন্দ্রা পর্যন্ত ভাড়া ৮০ টাকার মতো। ঈদ উপলক্ষে ১০০ টাকা ভাড়া নেওয়া হচ্ছিল। একজন যাত্রী বাসে ওঠার পর ১০০ টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানান। এ নিয়ে কথা-কাটাকাটি হয়। বাসটি আশুলিয়া থানা-সংলগ্ন এলাকায় পৌঁছালে বাসে ২০-৩০ জন ওঠেন। বাসটি কিছুদূর গিয়ে ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ডিইপিজেড) এলাকায় এসে যানজটে আটকা পড়ে। তখন হৃদয়কে বাস থেকে নামিয়ে হত্যা করা হয়। চালক সোহেল রানা ওরফে বাবুকে মারধর করা হয়। পরে দুজনকে গাজীপুরের শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেমোরিয়াল কেপিজে বিশেষায়িত হাসপাতালে নেয়া হলে মৃত ঘোষণা করা হয়।

তবে গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে আশুলিয়া থানার পুলিশ জানায়, যাত্রীদের মারধরে চালক ও সহকারীর মৃত্যুর খবরের তথ্য পেয়ে পুলিশ হাসপাতালে যায়। শরীরের আঘাত দেখে এবং চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে মারধরে ওই দুজনের মৃত্যু হয়েছে, এমন দাবির বিষয়ে তাদের সন্দেহ হয়। প্রকৃত ঘটনা জানতে সোমবার রাতেই পুলিশ ওই বাসের চালকের সহকারী পরিচয় দেওয়া আবদুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি অতিরিক্ত ভাড়া চাওয়ার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে এক যাত্রী ও তাঁর পরিচিত ব্যক্তিদের মারধরে ওই দুজন নিহত হয়েছেন বলে পুলিশের কাছে দাবি করেন।

পুলিশ জানায়, তদন্ত চলাকালে ঘটনাস্থলে উপস্থিত এক প্রত্যক্ষদর্শীর মাধ্যমে তারা জানতে পারেন, ঘটনার সময় ইতিহাস বাসের পাশে দুজন ধাক্কাধাক্কি করছিলেন। এ সময় উত্তরবঙ্গগামী একটি বাস ইতিহাস বাসের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মাঝখানে ওই দুজন চাপা পড়েন। পরে গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁদের হাসপাতালে নেওয়া হয়। এরপর পুলিশ গতকাল আবদুর রহমানকে আবার থানায় ডেকে নেয়। ঘটনাস্থলের পাশ থেকে সিসিটিভি ফুটেজও সংগ্রহ করে পুলিশ।

আশুলিয়া থানার পুলিশ বলছে, পরেরবারের জিজ্ঞাসাবাদে আবদুর রহমান বলেন যে ঘটনার আগে কিছু সময়ের জন্য তিনি গাড়িতে চালকের আসনে বসেছিলেন। চালক ও চালকের অপর সহকারী গাড়ির গেট থেকে নেমে যাত্রীদের ডাকছিলেন। এসময় উত্তরবঙ্গগামী একটি বাস তাদের দুজনকে চাপা দিয়ে চলে যায়। এতে ওই দুজনের মৃত্যু হয়।

দুই বাসের মাঝখানে পড়ে যে দুজনের মৃত্যু হয়েছে, ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া সিসিটিভি ফুটেজ থেকে বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ডিইপিজেডের সামনের সড়কের পাশে ঈদে ঘরমুখী মানুষের ভিড়। সড়কে গাড়িগুলো চলছে ধীরগতিতে। ইতিহাস পরিবহনের বাসটি সড়কে চন্দ্রামুখী লেনের ডান পাশ ঘেঁষে থেমে ছিল। কিছুক্ষণ পর পাশ দিয়ে ‘বাবা-মায়ের দোয়া’ নামে একটি বাস চলে যায়। এর পরপরই ইতিহাস পরিবহনের বাসের গেটটিতে লোকজনের জটলা দেখা যায়। এক পুলিশ সদস্যকে ছোটাছুটি করতে দেখা যায়।

পুলিশের দাবি, ইতিহাস পরিবহনের পাশ দিয়ে বাবা-মায়ের দোয়া পরিবহনের বাস যাওয়ার সময় দুই বাসের মাঝখানে চাপা পড়ে ওই দুজন নিহত হন।

গতকাল বিকেলে আশুলিয়া থানায় কথা হয় আবদুর রহমানের সঙ্গে। পুলিশকে সঠিক ঘটনা কেন বলেননি, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওই সময় আমি চাপের মধ্যে ছিলাম। হৃদয়ের আত্মীয়স্বজনও বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন। তাই এমনটা বলেছিলাম।

ঢাকা জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত) মো. আবদুল্লাহিল কাফী বালেন, মূলত নিজেকে আইনি জটিলতা থেকে রক্ষা করতে ভুল তথ্য দিয়েছিলেন চালকের সহকারী আবদুর রহমান।

বিবার্তা/লিমন

© BBARTA24.NET
Developed by : ORANGEBD
  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত