যুক্তরাজ্যের নির্বাচনে প্রতিবাদের নামে যেন বাংলাদেশি নৌকা না ডুবে

| আপডেট :  ০৩ জুলাই ২০২৪, ১০:২৫  | প্রকাশিত :  ০৩ জুলাই ২০২৪, ১০:২৫


যুক্তরাজ্যের নির্বাচনে প্রতিবাদের নামে যেন বাংলাদেশি নৌকা না ডুবে

প্রবাসের কথা

জুয়েল রাজ


চলতি বছর ৪ জুলাই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে যুক্তরাজ্যের জাতীয় নির্বাচন। ব্রিটেনের রাজনীতির নানা চড়াই উতরাই পেরিয়ে মেয়াদের আগেই এক ধরনের পালিয়ে বাঁচার মতো করে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছেন, দুঃসময়ে কনজারভেটিভ দলের হাল ধরা ঋষি সুনাক। আর সেই নির্বাচনের আগেই প্রায় নির্ধারিত হয়ে গেছে, যুক্তরাজ্যের পরবর্তী সরকার গঠন করতে যাচ্ছে লেবার পার্টি। লেবার পার্টি সরকার গঠন করলে প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন কিয়ার স্টারমার।

প্রবাসী বাংলাদেশিদের বা ব্রিটেনের অভিবাসী সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সাথে দলটির সম্পর্ক খুব নিবিড়। যদি ও অন্যান্য  দলের রাজনীতিতেও অভিবাসী জাতি-গোষ্ঠীর মানুষজন যোগ দিচ্ছেন। যার সর্বশেষ বড় উদাহরণ বর্তমান সরকারি দলের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। এবারের জাতীয় নির্বাচনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্রসহ মোট ৩৪ জন প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। যদিও অধিকাংশই হয়ত জামানত হারাবেন। তবু আশার আলো হচ্ছে অংশগ্রহণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, অনেক প্রার্থী আবার প‌্যালেস্টাইন ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছেন। স্বয়ং লেবার পার্টির নেতা কিয়ার স্টারমারের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত একজন।

লেবার পার্টি থেকে প্রথম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন রোশনারা আলীর পর টিউলিপ সিদ্দিক ও রুপা হক। সর্বশেষ আফসানাসহ মোট চারজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপি পায় যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশিরা এবং সবাই নির্বাচিত হয়েছেন লেবার পার্টি থেকেই। ধারণা করা হচ্ছে সব ঠিকঠাক থাকলে এবারের নির্বাচনে সেই সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে। আলোচনা বা প্রচারণা আছে, প্রথমবারের মতো মন্ত্রীও হতে পারেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত দুই-একজন।

এই ভূমিকার মূল লেবার দলের নেতা কিয়ার স্টারমারের একটি বক্তব্যের কারণে, ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের মাঝে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। বিশেষ করে বাংলাদেশি অধ্যুষিত পূর্ব লন্ডনে নানা প্রতিবাদ কর্মসূচি সমাবেশ চলছে প্রায় প্রতিদিন।

মূলত, ডেইলি সানের ইলেকশন শো-ডাউন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন লেবার পার্টির নেতা কিয়ার স্টারমার। সেসময় একজন অবৈধ অভিবাসী ইস্যুতে তার অবস্থান জানতে চান।

জবাবের একপর্যায়ে বাংলাদেশকে উদাহরণ হিসেবে টেনে স্টারমার বলেন, ‘যারা বাংলাদেশের মতো দেশ থেকে এদেশে এসেছেন, তাদের ফেরত পাঠানো হতে পারে। কয়েকটি দেশের মানুষের এখানে আসা বন্ধ করতে পারি আমরা।’

রুয়ান্ডা অ্যাসাইলাম প্ল্যানকে ‘ব্যয়বহুল’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যে দেশ থেকে তারা এসেছেন, সেখানেই তাদের ফেরত পাঠানো হবে। আমি নিশ্চিত করব সেটা।’

উল্লেখ্য, ২০২২ সালের এপ্রিলে রুয়ান্ডা অ্যাসাইলাম প্ল্যান নামের একটি অভিবাসন নীতি প্রস্তাব করেছিল ব্রিটিশ সরকার। এতে বলা হয়, যুক্তরাজ্যে অবৈধ অভিবাসী বা আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তিদের  যুক্তরাজ্যে না রেখে পূর্ব আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডায় পুনর্বাসনের জন্য স্থানান্তর করা হবে।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, যে বিষয় নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন স্টারমার তার সাথে বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করা সম্পর্কহীন। এই নৌকায় আসা অবৈধ অভিবাসীর তালিকায় ২০ নম্বরেও নাম নেই বাংলাদেশের।

এর বাইরে গত এক দশকে ভিসা নিয়ে যুক্তরাজ্যে যাওয়া এক লাখ ২০ হাজারের বেশি মানুষ রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছেন।

এই আবেদনকারীদের মধ্যে সবার ওপরে রয়েছেন পাকিস্তানিরা। প্রায় ১৭ হাজার ৪০০ পাকিস্তানি আশ্রয় প্রার্থনা করে আবেদন করেছেন। তারপরই বাংলাদেশের অবস্থান। ভারতীয় ৭,৪০০ জন, নাইজেরীয়া ৬,৬০০ জন এবং আফগানিস্তান থেকে যাওয়া ৬,০০০ জন রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছেন।

যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনারের পক্ষ থেকেও বলা যায়, কূটনৈতিক ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়েছেন, স্টারমারের বক্তব্যের।

যদি বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া শুরু হওয়ামাত্রই তোপের মুখে এর ব্যাখ্যা দিয়ে দুঃখপ্রকাশ করেছে মি. স্টারমার। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘আমি কাউকে আঘাত দিতে চাইনি। আপনারা যে আমার কথায় কষ্ট পেয়েছেন এনিয়ে আমি উদ্বিগ্ন’। বারবার বাংলাদেশ ও বাংলাদেশি কমিউনিটির সাথে তার সম্পর্কের কথা উল্লেখ করছেন। প্রথমবার এমপি নির্বাচিত হয়ে তিনি এমপি হিসাবে বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে তার সফর শুরু হয়েছিল বলেও জানান।

কিন্তু এর আগেই দলীয় নেতার এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় লেবার পার্টির টাওয়ার হ্যামলেটস-এর ডেপুটি লিডার ও কাউন্সিলর বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সাবিনা আখতার লেবার পার্টি থেকে পদত্যাগ করেছেন।

নিজের এক্স অ্যাকাউন্টে পদত্যাগের কথা জানিয়ে সাবিনা আক্তার বলেছেন, ‘দলের নেতা যখন আমার কমিউনিটিকে আলাদা করে এবং আমার বাংলাদেশি পরিচয়কে অপমান করে, তখন আমি আর দল নিয়ে গর্ব করতে পারি না।’

ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন লেবার পার্টির নির্বাচনী প্রার্থী আফসানা বেগমও। এক ভিডিও বার্তায় আফসানা বেগম বলেন, ‘আমি স্পষ্টভাবে বলছি, আমি যতদিন আছি, অভিবাসী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে দোষারোপ সহ্য করব না। আমাদের বাংলাদেশি সম্প্রদায় ১৯৭৮ সালে বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন করে। সেই আন্দোলনে ইস্ট লন্ডনে ২৫ বছর বয়সী আলতাব আলী নিহত হন।

তখন আমাদের স্লোগান ছিল- ‘আমরা এখানে ছিলাম, আমরা এখানে থাকব’। আপনারা আমাকে ভোট দিলে শক্তিশালী আওয়াজের জন্য ভোট দিচ্ছেন, সে বিষয়ে নিশ্চিত থাকেন। যিনি সংসদে গিয়ে যেকোনও উপায়ে আমাদের অভিবাসী সম্প্রদায়ের অধিকার এবং সম্মান রক্ষা করবে।’

টানা চারবার নির্বাচিত এমপি রুশনারা আলী তাঁর বক্তব্যে জানিয়েছেন ‘কোনও দেশকে এভাবে এককভাবে বলা ঠিক নয়, এটা ভুল হয়েছে। আমি আমার নেতাদের জানিয়েছি, এভাবে এককভাবে বললে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়।’

কিন্তু তবুও থামছে না প্রতিবাদ। বাংলাদেশিদের দাবি প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে স্টারমারকে।  শুধু বাঙালি নয়, ব্রিটিশ মূলধারার গণমাধ্যমে ও ব্যাপকভাবে চর্চিত হচ্ছে বিষয়টি।  স্টারমার ক্ষমা চাইবেন কি না সেটা সময়ই বলে দেবে। নৌকায় আসা অভিবাসী নিয়ে এর আগে ২০২৩ সালে এমন বক্তব্য দিয়েছেন কিয়ার স্টারমার। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘ইংলিশ চ্যানেল ক্রস করে আসা অভিবাসীদের অবৈধ অভিবাসন নীতিমালার অধীনে সন্ত্রাসী হিসাবে গণ্য করা হবে। তিনি আরো বলেন যারা তার কথার সমর্থন করবে না তারা কাগজে কলমে ব্রিটিশ হলেও মনমানসিকতা ব্রিটিশ নয়।’

তিনি আরো যোগ করেন, প্রথমে ভাবতে হবে কীভাবে নৌকা করে অভিবাসীরা চ্যানেল ক্রস করে, সেটা বন্ধ করার ব্যবস্থা করা উচিত। আদম নিয়ে যে বাণিজ্য হচ্ছে সেই ট্রেন্ড ভাঙা জরুরি। তাছাড়া বিভিন্ন দেশের আইন ভঙ্গ করে যারা যুক্তরাজ্যে প্রবেশের চেষ্টা করছে তারা অপরাধী, তাদের সাথে আচরণ হতে হবে অনেক কঠিন। তাদেরকে টেরোরিস্ট ব্যতীত আর কি নামেই বা আখ্যা দেয়া যায়!

অবৈধ অভিবাসী নিয়ে তার মনোভাব নতুন কিছু নয়। তখন কোন দেশের নাম উল্লেখ করেন নাই, আর এবার নাম নিলেন বাংলাদেশের। কিয়ার স্টারমার ব্যক্তি হিসেবে অভিবাসন বিরোধী কট্টর জাতীয়তাবাদীদের সমর্থন পাবেন ব্যাপকভাবে।

কিন্তু তার এ বক্তব্যে বিপাকে পড়েছেন লেবার পার্টির মনোনয়ন পাওয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থীরা। নির্বাচনের আগে বাংলাদেশকে হেয় করে দেয়া ওই বক্তব্যের কারণে অনেকটাই নিশ্চিত বিজয়ী প্রার্থীগণকে অনিশ্চয়তা এবং প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে বের হয়ে আসতে হবে এখন। কারণ এই আসনগুলোতে এদের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরাও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। এর সাথে যোগ হয়েছে ধর্মীয় আবেগ, ফিলিস্তিনের মানবিক আবেদন।

স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য সব সোনায় সোহাগা হয়ে গেছে এবং বিশেষ করে পূর্ব লন্ডনের দুইটি আসন মূলত বাংলাদেশিদের ভোটই বিজয়ের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে। এখন কিয়ার স্টারমারের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে লেবারের প্রার্থীদের বিরোধিতা করেন, তাহলে প্রতিবাদের সাথে নিজেদের নৌকাটিও ডুবিয়ে দিবেন। দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় আজকের অবস্থানে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপিগণ। তাই তাদের বিজয়ের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করে এবং বিজয়ীর সংখ্যা বৃদ্ধি করে সংসদে আমাদের প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে হবে। অন্যথায় আলতাব আলী পার্ক আর ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে প্রতিবাদ সমাবেশ ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার থাকবে না। আবেগ এবং বিবেক দুইটাইকেই কাজে লাগাতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট

বিবার্তা/এসবি/লিমন

© BBARTA24.NET
Developed by : ORANGEBD
  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত