সব খোলা শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই করোনা!

| আপডেট :  ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১১:৩০  | প্রকাশিত :  ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১১:৩০

দেশজুড়ে গত সাত মাস ধরে চলছে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচন। সরকারি-বেসরকারি অফিস সব খোলা। চালু আছে কলকারখানাও। হয়ে গেল বাণিজ্য মেলা, চলতি মাসেই শুরু হওয়ার কথা বইমেলা। এভাবে ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে’ প্রায় সবকিছু চালু রাখা হলেও দেশজুড়ে বন্ধ রয়েছে শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে ১৭ মার্চ বন্ধ করে দেওয়া হয় সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দফায় দফায় ছুটি বাড়িয়ে টানা ৫৪৪ দিন পর গত ১২ সেপ্টেম্বর তা খুলে দেওয়া হয়। দেড় বছরের বেশি সময় পরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হলেও একসঙ্গে সব শ্রেণির ক্লাস শুরু করা যায়নি। এরই মধ্যে গত ২১ জানুয়ারি আবার বন্ধ করে দেওয়া হয় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

প্রাথমিকভাবে দুই সপ্তাহের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সংক্রমণ এখনও ঊর্ধ্বমুখী থাকায় আগামী ৬ ফেব্রুয়ারির পরে এই ছুটি আরও বাড়ানো হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকরা মনে করছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা কোনো ভালো সমাধান নয়। তারা প্রশ্ন তুলেছেন, সব খোলা, শুধু স্কুল বন্ধ কেন?

শিক্ষাবিদদের ভাষ্য, করোনার কারণে শিক্ষাব্যবস্থায় এরই মধ্যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। বাতিল করতে হয়েছে ২০২০ সালের এইচএসসি, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী এবং জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষা। এইচএসসি শিক্ষার্থীদের ‘অটোপাস’ দিয়ে সরকার সমালোচিত হয়েছে। সিলেবাস কমিয়ে শুধু তিনটি বিষয়ে নেওয়া হয়েছে ২০২১ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা। বাতিল করা হয়েছে ২০২১ সালের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী এবং জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষা। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়া হয়নি। কভিড সংক্রমণের মুখে চলতি বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার সিলেবাসও সংক্ষিপ্ত করে ফেলা হয়েছে। এগুলো শিক্ষার জন্য ‘অশনিসংকেত’।

এ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে টানা ছুটি থাকায় বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষাতেও জট লেগে গেছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের বেকারত্বের দিন দীর্ঘায়িত হচ্ছে।

বিশ্বের অনেক দেশেই করোনাভাইরাসের চলমান সংক্রমণের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু রাখা হয়েছে। খ্যাতনামা গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টাটিস্টার সর্বশেষ তথ্যমতে, বিশ্বের অন্তত ৯৫টি দেশে কিছু বিধিনিষেধসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু হয়েছে। কোনো ধরনের বিধিনিষেধ ছাড়া বিদ্যালয় খোলা আছে ২৬টি দেশে।

নটর ডেম কলেজের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক ড. সমুদ্র ডি গোমেজ বলেন, ‘বাণিজ্য মেলা, নানা সরকারি সম্মেলন, সুবিশাল শপিংমল, গণপরিবহন সবকিছু চলতে পারছে আর শিক্ষার্থীদের টিকা দিয়েও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা গেল না?’

রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগম সমকালকে বলেন, ঠান্ডা মাথায় একবার শিক্ষার্থীদের কথা ভাবুন। যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে হলেও সশরীরে ক্লাস-পরীক্ষা চালু রাখা দরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখাই একমাত্র সমাধান হতে পারে না।

ভিকারুননিসা নূন স্কুলের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক শাহমিকা শাহরিন অনামিকা বলেন, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আদেশ অনুসারে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় সমাবেশ, অনুষ্ঠানে ১০০ জনের বেশি জনসমাবেশ করা যাবে না। এসব ক্ষেত্রে যারা যোগ দেবেন, তাদের অবশ্যই ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট আনতে হবে। অন্যান্য ক্ষেত্রে যদি এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার সুযোগ থাকে, তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এমন সিদ্ধান্ত কেন বহাল থাকবে না?

তিনি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের কথা বাদ দিলাম, তারা ছোট, কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার পর তারা কি ঘরে থাকছে? না থাকতে পারছে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোমেনুর রসুল বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সমস্যা কেবল একাডেমিক ক্ষতিতেই সীমাবদ্ধ নয়। এ সমস্যার গভীরতা চতুর্মাত্রিক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অনেকগুলো বিষয় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সচল থাকলে কোটি মানুষের আয়-রোজগারের পথ সচল থাকে। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হলেই স্বাভাবিকভাবে তাদের পরিশ্রমী হাত দুটো চলে যায় মাথায়। চিন্তা, হতাশা গ্রাস করে শত শত পরিবারকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী মাজহারুল ইসলাম রবিন বলেন, করোনার প্রথম ছুটিতে দীর্ঘ পনেরো মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শুধু গত বছরেই ৫০ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। আরও অনেক হিসাবের বাইরে আছে, যাদের পরিসংখ্যান আমাদের সামনে আসে না। দারিদ্র্য এবং বেকারত্ব তরুণ শিক্ষার্থীদের হতাশায় নিপতিত করছে।

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিশাত অনিকেত বলেন, সরকারি ক্লাসের বিকল্প কখনও অনলাইন ক্লাস হতে পারে না। বিশেষ করে প্রকৌশল বিষয়ে তো নয়ই। গত এক বছরে অনলাইন ক্লাসের স্বাদ আমরা খুব ভালোমতো পেয়েছি। ডিভাইস না থাকা, নেটওয়ার্ক না থাকা, ডাটা না থাকা, পর্যাপ্ত পরিবেশ না থাকাসহ নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়েছে আমাদের। এসব প্রতিবন্ধকতার কারণে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম দিকে ক্লাসের উপস্থিতির ওপর নম্বর না থাকার ঘোষণা দিলেও পরে সে কথা রাখেননি শিক্ষকরা। পছন্দের ছাত্র অনুযায়ী নিজের ইচ্ছামতো নম্বর বসিয়ে রেখেছেন। ফলে বেগ পেতে হয়েছে অন্য শিক্ষার্থীদের। অমরা অনলাইনে ক্লাস করেছি ঠিকই, কিন্তু পরীক্ষা দিতে পারিনি অনলাইনে। ফলে দুই সেমিস্টারের পরীক্ষা একই সঙ্গে দিতে হয়েছে।

শিক্ষাবিদদের ভাষ্য: বরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশিদিন স্কুল বন্ধ রেখেছে বাংলাদেশ। এমনকি যখন কভিড-১৯ পরিস্থিতি অনেকটাই নাগালে, তখনও আমরা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রেখেছি। এতে শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক ক্ষতি হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন ১০ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়া হচ্ছে বলে সরকার দাবি করছে। এমন অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার আর কোনো যুক্তি নেই। সম্প্রতি ইউনেস্কোও বলেছে, কোনো অবস্থাতেই আর স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখা যাবে না। আমি বলব, যত সমস্যাই আসুক, টিকাদান কার্যক্রম জোরদার করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘টানা বন্ধ রাখায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না যেতে পারা শিক্ষার্থীরা বন্ধু-বান্ধবহীন হয়ে ফেসবুকে ঘুরে বেড়ায়, উদ্যমহীন হয়ে পড়ে, নানা সামাজিক সমস্যা তৈরি হয়। কন্যাশিশুদের বাল্যবিয়ে ও শিশুশ্রম বেড়ে যায়। এসব থেকে উত্তরণে স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল-কলেজ খোলা রাখতে হবে। আমি আশা করব, আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়া হবে।

সিলেবাস কমিয়ে পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণ প্রসঙ্গে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, অর্ধেক সিলেবাস মানে অর্ধেক জ্ঞান। অপূর্ণ জ্ঞান নিয়ে ওপরের শ্রেণিতে চলে যাওয়া মানে শিখন-ঘাটতি নিয়েই উত্তীর্ণ হওয়া। আমি বলব, সিলেবাস না কমিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার রেখে নিয়মিত ক্লাসের পাশাপাশি অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করে সেই ঘাটতিটুকু পূরণের জন্য শিক্ষকরা প্রচেষ্টা চালাতে পারেন। আগামীতে যেন কোনো স্তরেই সিলেবাস কমানো না হয়, সেজন্য সরকারকে অনুরোধ করব।

গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, সবকিছু খোলা রেখে শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখলে এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সব পথ খোলা, ভোটও হচ্ছে। অথচ যে শিক্ষার্থীদের হাতে আগামীর নেতৃত্ব, সেই তাদেরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আমরা বন্ধ করে রাখছি।

তিনি বলেন, সরকার হয়তো আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখছে। কিন্তু বিকল্প ব্যবস্থা না রেখে এভাবে টানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখলে শিক্ষার দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হবে।

রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, সিলেবাস কমানো শিক্ষার জন্য অশনিসংকেত। সিলেবাস না কমিয়ে বরং অনলাইন ও অফলাইন ক্লাস মিলিয়ে ‘ব্লেন্ডেড লার্নিং’য়ের দিতেই আমাদের যেতে হবে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্যমতে, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের বিপুল সংখ্যক শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের টিকাদান এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। দেশে ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ কোটি ১৬ লাখ ২৩ হাজার ৩২২। এদের মধ্যে টিকার প্রথম ডোজ পেয়েছেন ৪৪ লাখ, দ্বিতীয় ডোজ ৪ লাখ ১৯ হাজার ৫৫৪, অর্থাৎ টিকা পেয়েছেন ৪৮ লাখ ১৯ হাজার ৫৫৪ শিক্ষার্থী।

পাবলিক, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৪ লাখ ৩৪ হাজার ৪৫১ জন। এর মধ্যে টিকার প্রথম ডোজ পেয়েছেন ২৩ লাখ ২৮ হাজার ৪৬৮ জন, দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়েছে ১৭ লাখ ১৩ হাজার ৩০২ জনকে।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ২৯ লাখ জাতীয় বিশ্ব্ববিদ্যালয়ের। বাকিদের মধ্যে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯৫ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী টিকা পেয়েছেন। মন্ত্রণালয়ের হাতে থাকা তথ্যমতে, সারাদেশের শিক্ষকদের প্রায় সবার টিকা নেওয়া সম্পন্ন হয়েছে। এমন অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, সারাদেশের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ এরই মধ্যে টিকা পাওয়ায় এবং টিকাদান কার্যক্রম চলমান থাকার পরও কেন বারবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে?

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত