সরকারি ভবনে একজন অফিস করলেও শত শত টনের এসি চলে

| আপডেট :  ২৬ জুলাই ২০২২, ১২:০৭  | প্রকাশিত :  ২৬ জুলাই ২০২২, ১২:০৭

সরকার যখন বিদ্যুৎসংকট মোকাবিলায় রেশনিং পদ্ধতি চালু করেছে তখন উল্টোপথে হাঁটছে সরকারের একাধিক দপ্তর। কমপক্ষে সরকারি ১৩টি ভবনে সেন্ট্রাল এসি বা কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র বসানো হয়েছে। এসব ভবনে একজন অফিস করলেও শত শত টনের এসি চলে। ১৩ ভবনের ৬টিতে মোট ৯ হাজার ২০০ টন এসি ব্যবহৃত হচ্ছে।

রাজধানীর আগারগাঁও এলাকায় জাতীয় রাজস্ব ভবনে ২ হাজার ৫০০ টন, পান্থপথের পানি ভবনে ২ হাজার ৪০০ টন, সচিবালয়ের ভেতরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভবনে ১ হাজার ৫০০ টন, পুলিশ সদর দপ্তরে (এনেক্স ভবন) ১ হাজার ২০০ টন, বিজ্ঞান জাদুঘরে ১ হাজার টন, জাতীয় আর্কাইভ ভবনে ৬০০ টন এসি ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া পর্যটন ভবন, বিডা ভবন, আইসিটি ভবন, নির্বাচন কমিশন ভবন, জাতীয় সংসদ, বিটিআরসি ভবন, সিপিটিউ ভবনে সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র রয়েছে। এসব ভবনের বেশিরভাগে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন চিলার এয়ারকুলার বা ওয়াটার কুলার রয়েছে। চিলার কুলার বসাতে হলে কমপক্ষে ১০০ থেকে ১৫০ টন দিয়ে শুরু করতে হয়। দুয়েকটিতে আছে ভিআরএফ সিস্টেম। এ পদ্ধতির শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় কমপক্ষে ১৮ টন দিয়ে শুরু করতে হয়। দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে এ তথ্য পাওয়া গেছে। তবে এসি যন্ত্র বসানো ও বিদ্যুৎ বিল তৈরি করার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী ও একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কেউ এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বছর দুয়েক আগে সচিবালয়ে ২০ তলা একটি ভবনে অর্থ মন্ত্রণালয় কার্যক্রম শুরু করে। সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এ ভবনে মোট ১ হাজার ৫০০ টন এসি বসানো হয়েছে। চিলার এয়ারকুলার ধরনের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এ শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্রের জন্য বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে। এ ভবনের জন্য চলতি বছরের এপ্রিল মাসেই বিদ্যুৎ বিল বাবদ ২৮ লাখ ৪৩ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। সারা বছরের গড় করে এ ভবনের জন্য মাসে ১৭ লাখ ২৭ হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল গুনতে হচ্ছে। সরকারের প্রশাসনিক সদর দপ্তর বাংলাদেশ সচিবালয়ে ৩৬টি মন্ত্রণালয়ের জন্য রয়েছে মোট চার হাজার টন ক্ষমতার শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র। অর্থ ভবনেই রয়েছে দেড় হাজার টন যন্ত্র। এপ্রিল মাসে শুধু অর্থ ভবনেই ১ দশমিক ৫৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয়েছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়। সরকারি দপ্তরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এসি ব্যবহার করা হয়েছে আগারগাঁও এলাকার জাতীয় রাজস্ব (এনবিআর) ভবনে। সেখানে ২ হাজার ৫০০ টন উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এসি ব্যবহার করা হয়েছে।

এর সঙ্গেই রয়েছে সরকারি আরেকটি ভবন। আগের সব রেকর্ড ভেঙে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সদর দপ্তর ‘পানি ভবন’-এ বসানো হয়েছে ২ হাজার ৪০০ টন ক্ষমতার শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র। এটি দেশের প্রথম ‘সেন্ট্রাল এসি’ সরকারি অফিস হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। প্রায় ৪ লাখ ২০ হাজার বর্গফুট আয়তনের ১২ তলার পানি ভবনের জন্য প্রতি মাসে বিদ্যুৎ বিল গুনতে হচ্ছে ২৫ থেকে ২৭ লাখ টাকা। সে হিসাবে বছরে এর পরিমাণ দাঁড়াবে ৩ কোটি টাকার মতো। এরপরই রয়েছে পুলিশ সদর দপ্তরের (এনেক্স ভবন) অবস্থান। এ ভবনের জন্য বসানো হয়েছে ১ হাজার ২০০ টন এসি।

এসব ভবন ছাড়াও সরকারিভাবে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ১ হাজার ২০০ টন ক্ষমতার এসির ব্যবস্থা আছে। যদিও বর্তমানে ব্যবহার করা হয় ৮০০ টন এসি। ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ব্যবহার হয় ২৫০ টন আর সরকার নিয়ন্ত্রিত দেশের পাঁচতারকা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে রয়েছে ৯২০ টন এসি। বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহার করে এমন কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র ব্যবহারকে অনেকে বিলাসী চিন্তাভাবনা মনে করছেন।

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহার করে এসব ভবনে কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার আয়োজন বাস্তবতা-বিবর্জিত। শহরের উঁচু এসব ভবনে সাত-আটতলার ওপরে স্বাভাবিকভাবেই এমন পরিমাণ বাতাস থাকে যাতে অনেক সময় ফ্যান প্রয়োজন হয় না। এ ধরনের ভবনেও কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র বসানো হয়েছে।

পানি ভবনের এক প্রকৌশলী বলেন, সচিবালয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার জন্য। তিনি বলেছিলেন, সরকারি অফিস-আদালত নির্মাণের ক্ষেত্রে আবদ্ধ ভবন নির্মাণ না করে প্রাকৃতিক আলো-বাতাস প্রবেশ করে এমন পরিকল্পনা করতে। কিন্তু আমাদের পাউবোর ভবনসহ অনেক অফিসেই সেন্ট্রাল এসি। ফলে এসব ভবনে যে কজনই অফিস করুক না কেন, এসি চলবে সব তলায়। সিঁড়ি, লবি ও লিফটের অংশেও এসি ব্যবহার হয়।

একাধিক প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনের জন্য সিলিং ফ্যান টানানো যায় না। সৌন্দর্য রক্ষার জন্য সেখানে বাধ্য হয়ে এসি বসাতে হয়। শহরের সরকারি ভবনগুলোতে যদি এভাবে কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্র বসানো না হতো তাহলে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ সাশ্রয় হতো। এসব ভবনে এসির জন্য যে পরিমাণ বিদ্যুৎ ব্যবহার হয় তা দিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিপুল পরিমাণ মানুষকে বিদ্যুৎ দেওয়া সম্ভব।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত