ববিতে কলিমউল্লাহকে রাখা ও কর্তৃপক্ষের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক

| আপডেট :  ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:০৪  | প্রকাশিত :  ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:০৪

নিয়োগের দুই মাস না পেরুতেই বিভিন্ন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিন। ডিন নিয়োগের অনিয়মের অভিযোগ, ফাইলপত্র আটকানো ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্কিত সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহকে একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য ও পরীক্ষা সমন্বয়ক কমিটিতে রাখা নিয়ে বেশ বিতর্কের মুখে পড়েছেন এ উপাচার্য। 

উপাচার্যের এসব কর্মকাণ্ডকে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখছেন শিক্ষকের একটি অংশ ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া দৃশ্যমান নেই একাডেমিক ও কোনো উন্নয়নমূলক কাজের অগ্রগতি। 

এদিকে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দিকে অসন্তুষ্টের তীর ছুড়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ক্ষোভ প্রকাশও করছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক বিতর্কিত উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহকে শিক্ষক কর্মকর্তাদের পূর্বতন চাকরিকাল গণনা-সংক্রান্ত কমিটি, একাডেমিক কমিটি ও পরীক্ষা কমিটিতে রাখা হয়। গত ২৩ অক্টোবর এক চিঠিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলে সদস্য হিসেবে মনোনয়নের কথা জানা যায়। 

গত ১৩ নভেম্বর লোকপ্রশাসন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের প্রথম সেমিস্টার প্রশ্নপত্রের সমন্বয় সভায় পরীক্ষা কমিটির বহিস্থ সদস্য হিসেবেও মনোনয়ন দেওয়া হয় তাকে (কলিমউল্লাহ)। চিঠিতে গত ৭ নভেম্বরের শিক্ষক কর্মকর্তাদের পূর্বতন চাকরিকাল গণনা-সংক্রান্ত কমিটিতে তাকে আহ্বায়ক রাখা হয়। এসব বিষয়ে জোরেসোরে বিতর্ক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্ষোভ প্রকাশ করলে কলিমউল্লাহকে এ কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়। তবে বাকি দুটি কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হয়নি বলে জানা যায়।

লোকপ্রশাসন বিভাগের পরীক্ষা কমিটির সভাপতি (তৃতীয় বর্ষ, ১ম সেমিস্টার) সহকারী অধ্যাপক মারুফা আক্তার জানান, পরীক্ষা কমিটির নামের বিষয়টি নিয়ে কাজ প্রক্রিয়াধীন। কলিমউল্লাহকে বাদ দেওয়া হবে কি না প্রশ্ন করলে তিনি জানান, প্রক্রিয়াধীন মানে বোঝেনই তো, আপনি সাংবাদিক বোঝার কথা।

অধ্যাপক কলিমউল্লাহর বিরুদ্ধে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালে অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ পায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ( ইউজিসি)। তার বিরুদ্ধে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বৃহৎ সংগঠন অধিকার সুরক্ষা পরিষদ দুর্নীতির ৭৯০ পৃষ্ঠার শ্বেতপত্র প্রকাশ করে। যেখানে নিয়োগ বাণিজ্যেরও অভিযোগে উঠে এসেছে তার বিরুদ্ধে।

এদিকে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, আওয়ামী সরকারের সব পাতানো নির্বাচনে বৈধতা দিতে কলিমউল্লাহর জানিপপ প্রথম সারিতে থেকে কাজ করেছে। অভিযোগ রয়েছে, ববি উপাচার্য ড. শুচিতা শরমিনের সঙ্গে রয়েছে তার বেশ সখ্যতা। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইলগুলো আটকে রাখেন ববি উপাচার্য ড. শুচিতা শরমিন। অদৃশ্য কোনো এক ব্যক্তির কথায় স্বাক্ষর করেন ফাইলপত্র বলে জানা যায়। বিস্তর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও সাবেক উপাচার্য কলিমউল্লাহকে কমিটিতে রাখা নিয়ে শেষ হচ্ছে না বিতর্ক।

বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। রোববার (১৭ নভেম্বর) সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহকে ববির সব পদ ও কর্মকাণ্ড থেকে অনতিবিলম্বে অব্যাহতি ও ক্যাম্পাসে অবস্থানের অনুমতি না দেওয়ার প্রসঙ্গে প্রক্টরের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর একটি আবেদনও দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের আবেদনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন প্রক্টর রাহাত হোসেন ফয়সাল। এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতারাও তাকে (কলিমউল্লাহ) বিভিন্ন কমিটি থেকে বাদ দিতে তিন দিনের আলটিমেটাম দিয়েছেন।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. আশরাফুল মোল্লা বলেন, একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে ববির কমিটিতে রাখা হয়েছে। তাকে ববিতে যুক্ত করে বিশ্ববিদ্যালয়কে কলুষিত করা হচ্ছে। আমরা তাকে অব্যাহতি দেওয়া এবং ক্যাম্পাসে অবস্থান না করানোর দাবি জানিয়ে ববি উপাচার্যকে চিঠি দিয়েছি। শিক্ষার্থীরা কলিমউল্লাহকে বয়কটের ঘোষণাও দিয়েছেন।

এদিকে উপাচার্য ড. শুচিতা শরমিন নিয়োগের পরপরই জড়িয়ে পড়েন নানা বিতর্কে। গত ৪ নভেম্বর সামজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন নিয়োগ নিয়ে জড়িয়ে পড়ে বিতর্কে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ৪ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. মনিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে সামজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন নিয়োগ দেওয়া হয় অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জ্যোতির্ময় বিশ্বাসকে। কিন্তু একই দিনে এই অফিস আদেশটি বাতিল করা হয় এবং নিয়োগ দেওয়া হয় লোকপ্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ইসরাত জাহানকে। অথচ আইন অনুযায়ী পাওয়ার কথা সমাজবিজ্ঞান বিভাগের এক শিক্ষককে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু শিক্ষক ও কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রয়োজনীয় ফাইলে যথাসময়ে স্বাক্ষর করেন না ববি উপাচার্য অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিন। ফাইল স্টাডির কথা বলে আটকে রাখা হয় ফাইলপত্র। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে একাডেমিক, দাপ্তরিক ও প্রশাসনিক জটিলতা। এসব দপ্তরের প্রায় সব ফাইল আটকে আছে উপাচার্য দপ্তরে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেলে থাকে না প্রয়োজনীয় ওষুধ সামগ্রী। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মেডিকেলের প্রয়োজনীয় ওষুধ কেনার জন্য উপাচার্য দপ্তরে ফাইল জমা দিলেও স্বাক্ষর না দেওয়ায় কিনতে পারছে না প্রয়োজনীয় ওষুধ সামগ্রী। এদিকে গত ১৩ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসনই বিভাগের অফিসিয়াল প্যাডে শেখ হাসিনা সরকার স্লোগান দেখা যায়। এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্ষোভ দেখা যায়। নিয়োগ পাওয়ার দুই মাস হতে গেলেও উপাচার্যের দৃশ্যমান কোনো কাজ দেখতে না পেয়ে হতাশা প্রকাশ করছেন বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা।

যদিও এসব তথ্য সত্য না বলে দাবি করে অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিন বলেন, অনেক জায়গায় এসব কথা বলা হচ্ছে যেটা অনাকাঙ্ক্ষিত ও দুঃখজনক। ফাইলপত্র যখনি আসছে আমি স্বাক্ষর করে দিচ্ছি। কোনো ফাইল বৃহস্পতিবার আসলে রোববারে স্বাক্ষর করে দিচ্ছি। যেগুলো ক্রিটিক্যাল ফাইল, সেগুলো সেভাবেই দেখছি। আমরা অপচয় করতে চাই না। নিয়মের ভেতরে যেটা করা যায় সেটা করছি।

তিনি জানান, আমরা কিছু দৃশ্যমান কাজ করেছি এগুলোও জানা দরকার। রাস্তা ও লাইটের কাজ করছি। ক্যাম্পাসের ঝোপ-ঝাড় পরিষ্কার করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আজ থেকেই পরিষ্কারের কাজ শুরু হবে। 

হতাশা প্রকাশ করে এক শিক্ষার্থী বলেন, নিয়োগের দুই মাস হয়ে গেলেও একবারের জন্য ক্যাম্পাসকে ঘুরে দেখার সময় পাননি তিনি। ক্যাম্পাস নিয়ে কী ধরনের পরিকল্পনা করবেন সে বিষয়ে আমরা কিছু জানতে পারিনি। আমরা দেখেছি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের পরপরই সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেছেন কিন্তু আমাদের তেমন কিছুই করেনি। তার কাজ থেকে আমরা কি প্রত্যাশা করতে পারি, তা জানতে পারিনি। এটা অত্যন্ত হতাশাজনক। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, বর্তমানে যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয় চলছে, তাতে উপাচার্যের অদক্ষতা প্রকাশ পাচ্ছে। বিভিন্ন দপ্তরের ২৫০ ফাইলের মধ্যে প্রায় দেড় শতাধিক ফাইল আটকে আছে উপাচার্য দপ্তরে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কাজ প্রায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদেরও বসে থাকতে হচ্ছে। ছোটখাটো উন্নয়নে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানান একটি সূত্র। কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজের সিদ্ধান্ত নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরের লোকের তুলনায় বাহিরের লোক থেকে পরামর্শ নিতে স্বাচ্ছন্দ্যে বোধ করেন উপাচার্য ড. শুচিতা শরমিন।

উল্লেখ্য, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট সরকার পতনের পর অপসারণ করা হয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের। শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে গত ২০ আগস্ট পদত্যাগ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভুঁইয়া। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. শুচিতা শরমিন৷

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত