‘তুমি বাড়ি যাও, আমি আসছি’ স্ত্রীকে শেষ কথা শহীদ জামালের
হাটহাজারী বাসস্ট্যান্ড থেকে আধা কিলোমিটার দূরে কড়িয়া দিঘির পাড়ে ‘ফটিকা রহমানিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। সময় বিকেল ৪টা। বিদ্যালয়ের মাঠে একদল শিশু-কিশোর ফুটবল নিয়ে খেলছে। দুই দলের মধ্যে এক দলের পক্ষ হয়ে খেলছে শিশু আল আমিন।
বয়স ১৪। স্থানীয় একটি পেট্রল পাম্পে কাজ করে সে। শুক্রবার, তাই কাজ বন্ধ। এ সুযোগে বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলায় মেতেছে। রক্ষণভাগে খেলতে ভালোবাসে আল আমিন। তার প্রিয় খেলোয়াড় মেসি। যে বয়সে বই-খাতা নিয়ে স্কুল প্রাঙ্গণে দুরন্ত শৈশব পার করার কথা, সে বয়সে তাকে পেট্রল পাম্পে গাড়ি পরিষ্কারের কাজ করতে হচ্ছে। কারণ মা ও বড় বোনকে নিয়ে বাবাহীন সংসারের পুরো দায়িত্ব যে এখন তার কাঁধে। সামশু কলোনিতে মা ও বোনকে নিয়ে ভাড়া থাকে সে।
আল আমিনের পিতা জামাল উদ্দিন (৫৪) পেশায় ছিলেন সিএনজি চালক। চট্টগ্রাম নগরীর ২নং জালালাবাদ ওয়ার্ডের অক্সিজেন কুলগাঁও এলাকার মৃত সালেহ আহমদ এর ছোট ছেলে জামাল দীর্ঘ ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে হাটহাজারী ফায়ার সেন্টার, হাজিরাতলী এলাকায় বসবাস করছিলেন। স্ত্রী (তাসলিমা বেগম) এবং এক মেয়ে (তানিয়া আকতার রুমি) ও এক ছেলেকে (আল আমিন) নিয়ে সুখেই দিন কাটছিল জামাল উদ্দিনের।
গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের এক দফা দাবিতে সারা দেশের মতো হাটহাজারী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় শত শত ছাত্র-জনতা জড়ো হয়। সমবেত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ এ সময় টিয়ারগ্যাস ও গুলি ছুড়তে থাকে। এ সময় হাতে ও বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন পথচারী জামাল উদ্দিন।
স্থানীয় জনগণ ও পথচারীরা প্রথমে তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। সেখানে অবস্থার অবনতি হওয়ায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। রাত ৯টার দিকে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। পরদিন ৬ আগস্ট অক্সিজেন কুলগাঁও এলাকায় নিজ গ্রামের বাড়িতে তাকে দাফন করা হয়।
জামাল উদ্দিনের স্ত্রী তাসলিমা বেগম (৪৮) বলেন, আমার মেয়েটি মানসিক প্রতিবন্ধী। গত ৫ আগস্ট হাটহাজারী আব্বাসের পুল এলাকায় মেয়ের জন্য পাত্র দেখে আমার স্বামী ও এক প্রতিবেশীকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম।
হাটহাজারী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পৌঁছলে আমার স্বামী আমাকে বলেন, ‘তুমি বাড়ি যাও, আমি আসছি।’
আমি প্রতিবেশী নারীকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে চলে আসি। বাড়ি এসে পৌঁছতেই খবর আসে আমার স্বামীর গায়ে গুলি লেগেছে। বাড়িতে এলাকার লোকজন এসে ভিড় জমাতে থাকে। ব্যাপারটা আমার কাছে কেমন যেন অদ্ভুত লাগছিল। কোনোভাবেই আমি তাদের কথা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সঙ্গে সঙ্গে পাগলের মতো হাসপাতালে ছুটে যাই। গিয়ে দেখি আমার স্বামীর শরীর থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। এলাকার লোকজনকে নিয়ে আমরা হাটহাজারী হাসপাতাল থেকে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে যাই। রাত ৯টার দিকে আমার চোখের সামনেই তিনি ছটফট করতে করতে মারা যান।
কীভাবে দিন কাটছে এ প্রশ্নের জবাবে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আমার স্বামী সিএনজি চালিয়ে যা উপার্জন করত তা দিয়ে কোনোভাবে আমাদের সংসার চলত। পরিবারে অভাব থাকলেও ছেলে-মেয়ের আবদার কখনো অপূর্ণ রাখত না। এখন আমি মেয়ে আর ছেলেকে নিয়ে কীভাবে সংসার চালাব?
স্বামী মারা যাওয়ার পর বাচ্চা ছেলেটাকে কাজে দিয়েছি। আমিও আশপাশের মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করছি। কিন্তু ঘরভাড়া দিতেই তো সব টাকা শেষ।
সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে এখন আমি চোখেমুখে অন্ধকার দেখছি। আমার স্বামী দেশের জন্য মারা গেছেন। এখন চাইলেও তো কেউ তাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না। সরকার যদি আমার মেয়েটার বিয়ের খরচ এবং আমার ছেলেটার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে তাহলে আমার কষ্টটা লাঘব হবে।
একমাত্র মেয়ে তানিয়া আকতার রুমি (১৮) কাঁদতে কাঁদতে বাবার স্মৃতি মনে করে বলেন, আমি আমার বাবার অনেক আদরের সন্তান। আমার বাবা আমাকে ছাড়া আর কিছুই বুঝতেন না। তিনি কখনো আমাকে ছাড়া ভাত খেতেন না। প্রতিদিন আমাকে পাশে বসিয়ে ভাত খেতেন। আমাকেও খাইয়ে দিতেন।
প্রতিবেশীরা জানান, জামাল উদ্দিন খুবই সহজ সরল প্রকৃতির মানুষ ছিল। এলাকায় কোনো দিন কারও সঙ্গে ঝগড়াবিবাদ করেনি। বাড়িতে থাকলে সারাদিন এলাকার ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে খেলাধুলা করত। হাঁস-মুরগি পালনে তার প্রচণ্ড ঝোঁক ছিল। এখন তার স্ত্রী-সন্তানরা মানবেতর জীবনযাপন করছে।
সরকার যদি তাদের পাশে দাঁড়ায় তাহলে পরিবারটা ভালোভাবে চলতে পারবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএম মশিউজ্জামান বলেন, ‘পরিবারটি খুবই অসহায়। এরই মধ্যে উপজেলা প্রশাসন থেকে আর্থিক সহযোগিতা করা হয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে পরিবারটির পাশে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত