কপ২৯ জলবায়ু সম্মেলন : প্রতিশ্রুতি বনাম বাস্তবতা
জলবায়ু সম্মেলনগুলো বরাবরই মতবিরোধ ও চ্যালেঞ্জের মধ্যে আটকে থাকে। কপ২৯ সম্মেলনেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের কপ২৯ জলবায়ু সম্মেলন আবারও হতাশার জন্ম দিয়েছে। ১১ নভেম্বর শুরু হওয়া এ সম্মেলনে ২০০ দেশের ৮৫ হাজার প্রতিনিধি অংশ নিলেও সম্মেলন শেষ হওয়ার নির্ধারিত সময় শুক্রবার পেরিয়ে গেলেও কোনো ঐক্যমতে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।
জলবায়ু তহবিল সংক্রান্ত খসড়া প্রস্তাব নিয়ে শেষ মুহূর্তে তীব্র সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এই বছর কপ২৯-কে ‘ফাইন্যান্স কপ’ বলা হলেও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল বরাদ্দে ধনী দেশগুলোর আন্তরিকতা প্রশ্নবিদ্ধ। আলোচনা চলছে নতুন যৌথ পরিমাণগত লক্ষ্য (এনসিকিউজি) নিয়ে। এর মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য পরিষ্কার অর্থনীতি গড়ে তোলা এবং ক্ষতি মোকাবিলার আর্থিক সহায়তা দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে ধনী দেশগুলো কতটা দায়ভার নেবে, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা ২০৩০ সালের মধ্যে বছরে ১ ট্রিলিয়ন ডলার এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলারের লক্ষ্য নির্ধারণ করার প্রস্তাব করেছেন। তবে আজারবাইজানের আয়োজনে প্রস্তাবিত খসড়া চুক্তিতে প্রতি বছর মাত্র ২৫০ বিলিয়ন ডলার তহবিল বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য পর্যাপ্ত নয়। অস্ট্রেলিয়া এবং অন্য দেশের প্রতিনিধিরা এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলেও চীনের মতো বড় বড় গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমনকারী দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
জাতিসংঘের এই সম্মেলন উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও বৈশ্বিক গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমণ এখনো উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়নি। এরই মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের দিকে ধাবিত হচ্ছে, যা জীববৈচিত্র্য, জীবিকা ও মানবজীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এছাড়া, জীবাশ্ম জ্বালানি লবিস্টদের বিরাট উপস্থিতি এবং ধনী দেশগুলোর সীমিত উদ্যোগ জলবায়ু সম্মেলনের অগ্রগতিকে সংকুচিত করছে।
বিশ্বব্যাপী শক্তি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সৌর ও বায়ু শক্তি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। তবে, সৌদি আরবের মতো দেশগুলোর জীবাশ্ম জ্বালানি লবিং এবং অর্থায়ন কাঠামোর অস্পষ্টতা জলবায়ু সম্মেলনের মূল লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে পরমাণু শক্তি নিয়ে কপ২৯-এ আলোচনার দাবি উঠে এলেও বাস্তবে এ ধরনের আলোচনা করা হয়নি।
তবে, বিশ্বব্যাপী ৩১টি দেশ ২০৫০ সালের মধ্যে পরমাণু শক্তি তিনগুণ করার প্রতিশ্রুতি দিলেও নবায়নযোগ্য শক্তিতেই বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। কপ২৮-এর চুক্তি অনুযায়ী, নবায়নযোগ্য শক্তিতে ২০৩০ সালের মধ্যে বিনিয়োগ তিনগুণ করতে হবে। তবে বাস্তবে, নবায়নযোগ্য এবং পরমাণু শক্তি উভয়ক্ষেত্রেই বিনিয়োগের অগ্রগতি অত্যন্ত ধীরগতিতে হচ্ছে।
কপ৩১ আয়োজক হওয়ার প্রতিযোগিতায় অস্ট্রেলিয়া ও তুরস্কের মধ্যে মতানৈক্য অব্যাহত। অস্ট্রেলিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলো এক দশক পর দক্ষিণ গোলার্ধে এই সম্মেলন আয়োজনের যৌক্তিকতা তুলে ধরলেও তুরস্ক এখনো প্রতিযোগিতায় রয়েছে। তালেবান, ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন থেকে শুরু করে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। ইউক্রেনের প্যাভিলিয়ন রাশিয়ার আক্রমণের পরিবেশগত ক্ষতি তুলে ধরেছে, যার মধ্যে ৭১ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি এবং ৯০০ বর্গকিমি বন পুড়ে যাওয়ার মতো ঘটনা রয়েছে।
ইউক্রেনের বার্তা ছিল একটিই : রুশ আগ্রাসনের পরও তারা জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কপ২৯-এর ব্যর্থতার ফলে জলবায়ু ন্যায্যতার দাবিতে দক্ষিণের দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। তবে প্রকৃত পরিবর্তনের জন্য হয়তো আগামী ব্রাজিলের বেলেমে কপ৩০ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
তবে গ্লোবাল কার্বন মার্কেট ফ্রেমওয়ার্কসহ কিছু ক্ষেত্রে অনুচ্ছেদ ৬-এর অধীনে অগ্রগতি হয়েছে। পাশাপাশি কয়েকটি দেশ তাদের এনডিসি এবং দ্বিবার্ষিক স্বচ্ছতা প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। সম্মেলনের শেষ দিনে বিশ্বনেতারা জলবায়ু অর্থায়নের ক্ষেত্রে অর্থবহ চুক্তিতে পৌঁছাতে পারবেন কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে। সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য- অর্থায়ন, অভিযোজন ও প্রশমনের অগ্রগতি উল্লেখযোগ্যভাবে থমকে গেছে। এটি বিশ্বব্যাপী জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
কপ২৯ সম্মেলনের শেষ পর্যায়ে নতুন যৌথ পরিমাণগত লক্ষ্য (এনসিকিউজি) তহবিলের খসড়া প্রত্যাখ্যানের আহ্বান জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। আজারবাইজানের বাকুতে আয়োজিত এই সম্মেলনে তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বছরে ২৫০ বিলিয়ন ডলারের বরাদ্দ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) ও ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর (সিডস) জরুরি প্রয়োজন মেটাতে সম্পূর্ণ অপ্রতুল। বরাদ্দের কোনো নির্দিষ্ট কাঠামো না থাকায় এবং তা অনুদান হিসেবে বিবেচিত না হওয়ায় তিনি গভীর হতাশা প্রকাশ করেন। বিশেষত, সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ৪৫টি স্বল্পোন্নত দেশের জন্য আলাদা তহবিল বরাদ্দের অভাব উল্লেখযোগ্য উদ্বেগের কারণ।
উপদেষ্টা আরও বলেন, এই প্যাকেজ কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা কম এবং এর সংশোধন প্রয়োজন। উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় উচ্চাভিলাষী ও ন্যায্য জলবায়ু অর্থায়ন কাঠামো প্রয়োজন, যা ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়ের চাহিদাকে অগ্রাধিকার দেবে। কপ২৯-এ জলবায়ু অর্থায়ন নিয়ে বিস্তর আলোচনা হলেও, তা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যথেষ্ট তহবিলের প্রতিশ্রুতি দিতে ব্যর্থ হয়েছে। উপদেষ্টার মতে, বর্তমান প্যাকেজ এলডিসি ও সিডসের মতো দেশগুলোকে তাদের সংকট নিরসনে কার্যকর সমর্থন প্রদান করতে পারছে না, বরং তাদের আরও অসহায় করে তুলছে।
বিশ্ব জলবায়ু নীতি নির্ধারণে ‘নন-ইকোনমিক লস অ্যান্ড ড্যামেজ’ (এলঅ্যান্ডডি) একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে বৈচিত্র্যতা বিলুপ্ত হচ্ছে। বুনো ধানের জাত বা পাহাড়ি ভুট্টার মতো ঐতিহ্যবাহী ফসল হারিয়ে যাচ্ছে। ব্রাজিলের আদিবাসী সম্প্রদায় আমাজন বনের উদ্ভিদ বিলুপ্তির কারণে তাদের রিচুয়াল পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে। একইভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে নারীদের প্রজনন সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের নীরব প্রভাব। তদুপরি, ঘূর্ণিঝড়, খরা, কিংবা নদীভাঙনের কারণে মানুষ ও বন্যপ্রাণীদের স্থানান্তর বেড়ে গেছে। এটি কেবল অর্থনৈতিক নয়, সাংস্কৃতিক ক্ষতিও ডেকে আনছে। নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে না পেরে তৈরি হচ্ছে দ্বন্দ্ব। বাংলাদেশের মতো জলবায়ু-সংকট কবলিত দেশগুলোতে ‘নন-ইকোনমিক এলঅ্যান্ডডি’-এর গুরুত্ব বুঝতে আরও গবেষণা ও বৈশ্বিক উদ্যোগ প্রয়োজন।
লেখক : অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার, ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ, অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, যুগ্ম সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এবং চেয়ারম্যান, বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত