গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন দলগুলোর সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান এক বিশাল পরিবর্তন এনেছে। শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশ এক নতুন রাজনৈতিক পর্বে প্রবেশ করেছে। তবে শুধু সরকার পরিবর্তন নয়, এই গণঅভ্যুত্থান একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রয়োজনীয়তা সামনে এনেছে। জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক পুনর্গঠন ও নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য গভীর আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করেছে- যেখানে গণতান্ত্রিক চর্চা, সুশাসন এবং রাজনৈতিক সংস্কার থাকবে।
এ প্রেক্ষাপটে গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর আত্মপ্রকাশ লক্ষণীয়। বিশেষ করে নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (NCP), ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ (UPB) এবং অন্যান্য ছাত্র-জনতার উদ্যোগে গঠন হতে যাওয়া রাজনৈতিক উদ্যোগগুলো ভবিষ্যতের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এসব নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর উত্থান যেমন সম্ভাবনার দ্বার খুলছে, তেমনি সামনে বেশ চ্যালেঞ্জও রয়েছে। ফলে ছাত্রনেতৃত্বের নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কমিটমেন্ট এবং গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মগুলো যেমন জনগণের মধ্যে এক নতুন আশার সঞ্চার করেছে, তেমনি জনমনে প্রশ্নেরও উদ্রেক হচ্ছে- এই নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কতটা বাস্তবসম্মত? নতুন দলগুলোর সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ কী?
রাজনৈতিক পুনর্গঠন ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের বাস্তবতা ও যৌক্তিকতা
জুলাই অভ্যুত্থান কেবল একনায়কত্ব ও ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে ছিল না; এটি এমন এক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন ছিল যা বিগত সময়ে ন্যায়বিচার, সমতা ও গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে—যা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ছিল। ৫ অগাস্টের গণঅভ্যুত্থানের মূল চালিকাশক্তি ছিল জনগণের বহুদিনের জমানো ক্ষোভ, ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর সীমাহীন দুর্নীতি, রাজনৈতিক দমন-পীড়ন, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের বিরুদ্ধে। এই ক্ষোভ শুধু একটি সরকারের পতনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দাবি তুলেছে, যা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা- ন্যায়বিচার, সমতা এবং গণতন্ত্র- পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে। তাই গণঅভ্যুত্থানে পরবর্তী বাংলাদেশে রাজনৈতিক পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তার প্রশ্ন তুলছে অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব ও ছাত্র-জনতা। যে ক্ষেত্রে অংশীজনরা বেশ কিছু প্রাতিষ্ঠানিক, পদ্ধতিগত ও সাংবিধানিক ক্ষেত্রকে চিহ্নিত করেছেন।
১. পুরোনো রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ব্যর্থতা :
বিগত সরকার এবং তৎপূর্ববর্তী বেশ কিছু সরকারের অধীনে রাজনৈতিক ব্যবস্থাটি কর্তৃত্ববাদী শাসনে পরিণত হয়েছিল।তার মধ্যে খুব নিকট সময়ে যেমন বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে (২০১৪, ২০১৮, ২০২৪) অনিয়ম, কারচুপি এবং বিরোধীদের দমন করার কারণে রাজনৈতিক বৈধতা হারিয়েছিল ক্ষমতাসীন দল। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা এবং দলীয় প্রভাব বিস্তারের কারণে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ জন্ম নিয়েছিল। ফলে, এই অকার্যকর ব্যবস্থার পরিবর্তে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের দাবি স্বাভাবিকভাবে এসেছে।
২. গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন :
স্বাধীনতার অর্ধশতক পরও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারা কখনোই সুষ্ঠু বিকাশ পায়নি।দেশের জনগণ এই দীর্ঘ সময়েও সুশাসনের পূর্ণতা কখনো পায়নি এমনি অনেক ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার থেকেও বঞ্চিত ছিল।বিচারব্যবস্থাও কখনো অর্থ ও ক্ষমতাশালী অংশে দখলে ছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের উদ্যোগ নিলেও, এটি একটি অস্থায়ী সমাধান মাত্র।তাই এমন সব যৌক্তিক কারণ তুলে অভ্যুত্থানের ছাত্রজনতা নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের লক্ষ্যে—সংবিধান সংস্কার, রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক কাঠামো নিশ্চিত করা, এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ করার ওপর জোর দাবি জানাচ্ছে।
৩. নতুন সংবিধান প্রণয়নের বিতর্ক :
অভ্যুত্থান পরবর্তী শিক্ষার্থীদের প্রথম রাজনৈতিক উদ্যোগ জাতীয় নাগরিক পার্টি (NCP) “সেকেন্ড রিপাবলিক” ধারণার মাধ্যমে নতুন সংবিধান রচনার কথা বলছে। তারা মনে করে, বর্তমান সংবিধান গণতন্ত্র, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে, সংবিধান পরিবর্তনের দাবি বাস্তবায়ন করা সহজ নয় এবং এটি রাজনৈতিক সংকটের কারণ হতে পারে।এছাড়া অন্যান্য ছাত্র-জনতার উদ্যোগে গঠন হতে যাওয়া রাজনৈতিক উদ্যোগের নেতৃত্বও একই দাবি তুলছে।তবে, সংবিধান সংস্কারের প্রক্রিয়া অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং এটি রাজনৈতিক সংকটের কারণ হতে পারে। তাই, এই প্রক্রিয়ায় সকল অংশীজনের ঐকমত্য অর্জন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৪। নির্বাচনী ব্যবস্থা পুনর্গঠন :
নির্বাচনে অনিয়ম ও জালিয়াতি বন্ধ করে একটি গ্রহণযোগ্য ভোটব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য যেমন দাবি উঠছে তেমনি এক ব্যক্তির বিভিন্ন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার শিকড়ে থাকার পথ বন্ধ করাকে ফ্যাসিবাদী শাসক উত্থানের পথ হিসেবেও চিত্রিত করছে। তারুণ্যের এই দাবির সাথে বিএনপি চেয়ারম্যান তারেক রহমানের এক নেতৃত্বের দুইবারের অধিক প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করতে না পারার দাবিও নির্বাচনী ব্যবস্থার পুনর্গঠনের প্রশ্নকে যৌক্তিক করে তোলে।
৫। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক কাঠামো তৈরি :
অভ্যুত্থানের তরুণ নেতৃত্ব পরিবারতন্ত্র ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতিকে বিগত সময়ে অনিয়ম, অবিচার, দুর্নীতি ও কর্তৃত্ববাদী শাসকের উত্থানের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে এর অবসান ঘটানোর জোর দাবি তুলেছে।
প্রসঙ্গত অতীতের দুর্নীতি,রাজনৈতিক অসিহষ্ণুতা,পারিবারিক শাসন, নির্বাচনী বিতর্কের কলঙ্কিত অধ্যায় যেমন নাগরিককে হতাশ করেছে তেমনি রাজনৈতিক নতুনত্বের প্রয়োজনীয়তা জনগণকে আশাবাদী করে তুলেছে। বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসনের মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। গত কয়েক দশকে এই প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। নতুন বন্দোবস্তের মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী ও জবাবদিহিমূলক করা সম্ভব।৫ই অগাস্টে বিগত সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের উদ্যোগ নিলেও স্থায়ী পরিবর্তন, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার স্থায়ী বিলোপ ও জনগণের শাসন নিশ্চিতের জন্য একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
অভ্যুত্থানের পরবর্তী নতুন দলগুলোর সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
সম্ভাবনা: বাংলাদেশে ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল গঠন ও দেশ পুনর্গঠনের জন্য এক অদ্বিতীয় সুযোগ এনে দেয়।ফলে ছাত্রদের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (NCP),ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ(UPB) এবং জুলাই বিপ্লবের সামনের সারিতে থাকা অন্যান্যদের নেতৃত্বে গঠিত হতে যাওয়া রাজনৈতিক উদ্যোগ সমূহ দেশের রাজনৈতিক চিত্রের পরিবর্তন সূচিত করার আশ্বাস যেমন দিয়েছে, তেমনি এই দলগুলো ইতিমধ্যে জনতাকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছে তাদের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা এবং সাধারণ জনগণের অধিকার সুরক্ষা।তারা সামাজিক ও রাজনৈতিক ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে গঠনমূলক কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। তাদের মূল আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আনা, যা অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং গণতান্ত্রিক হবে আশ্বাস দিচ্ছে।
NCP, UP Bnagladesh ও গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বের নতুন রাজনৈতিক উদ্যোগের দলগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিকে বদলে দেওয়ার সক্ষমতা রাখে বলে একাধিক জরিপে উঠেছে আসছে। Brac ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পরিচালিত ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের এক জরিপে দেখা গেছে, ৪০% ভোটার ছাত্র নেতৃত্বাধীন একটি দলকে সমর্থন করতে আগ্রহী, যা বিশেষ করে যুবসমাজের মধ্যে প্রবল উৎসাহ নির্দেশ করে। তবে ভোটের প্রতিযোগিতা মূলক মাঠে যদিও নতুন দলের ভোট অর্জনের সম্ভাবনা বেশ কিছুটা সীমিত হলেও সময়ের পরিক্রমায় তরুণদের মধ্যে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রতি আগ্রহ তীব্রতর হচ্ছে এবং তারা বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোর ধারায়ও পরিবর্তন চায়।যা নতুন দল সমূহের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সম্ভাবনারই ইঙ্গিত দেয়।
এছাড়া কিছু ফ্যাক্টর তাদের ভবিষ্যতে সম্ভাবনাকে আরো ত্বরান্বিত করতে পারে –
তরুণ নেতৃত্ব ও নতুন পার্টি ও নব রাজনৈতিক উদ্যোগের নেতারা সরাসরি গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যা তাদের জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছে। তরুণ নেতৃত্বের প্রতি জনগণের আশা রয়েছে, কারণ তারা দুর্নীতি ও দলীয় স্বার্থের বাইরে থেকে নতুন ধরনের রাজনীতি করতে চায় এবং তারা নতুন ধরনের রাজনীতি করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রকাশ করছে।
ক. গণ-আন্দোলনের শক্তি তরুণ নেতৃত্বের গতিশীলতা ও জনগণের আস্থা: গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী তরুণরা ও ছাত্র-জনতার নতুন রাজনৈতিক উদ্যোগ, জনগণের মধ্যে একটি নতুন আশার সঞ্চার করেছে। তাদের সরাসরি গণ-আন্দোলনের অংশগ্রহণ তাদেরকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে গেছে। তরুণ নেতৃত্বের প্রতি জনগণের আশা রয়েছে, কারণ তারা দুর্নীতি ও দলীয় স্বার্থের বাইরে থেকে নতুন ধরনের রাজনীতি করতে চায় এবং তারা নতুন ধরনের রাজনীতি করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রকাশ করছে।ফলে তরুণ নেতৃত্বের প্রতি জনগণের আস্থা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কারণ তারা পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোর দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও কর্তৃত্ববাদী চর্চার বাইরে থেকে একটি স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে Brac ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের জরিপে দেখা গেছে, ৪০% ভোটার তরুণ নেতৃত্বাধীন দলের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছে, যা যুবসমাজের মধ্যে তাদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নির্দেশ করে।
খ. রাজনৈতিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি: নতুন দলগুলো নির্বাচনী সংস্কার, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা, এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যা জনগণের মধ্যে সাড়া ফেলেছে।এছাড়াও সেকেন্ড রিপাবলিক ঘোষণা, গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান রচনার কথাও তারা জনগণের কাছে তুলে ধরছে যা রাজনৈতিক কাঠামোর আমূল পরিবর্তন আনতে পারে।
গ. পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি অনাস্থা
বিএনপি, আওয়ামী লীগ এবং জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার রাজনীতিতে রয়েছে। নতুন দলগুলো এসব পুরনো দলগুলোর ব্যর্থতার বিপরীতে বিকল্প হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে পারে। ফলে পুরনো রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি জনগণের অনাস্থার কারণে নতুন দলগুলোর জন্য সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকবে।
ঘ. ভবিষ্যতের রাজনৈতিক প্রভাব: যদিও বর্তমান জরিপে এনসিপি মাত্র ৫.১% ভোট পেতে পারে বলে অনুমান করা হয়েছে, তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ সংখ্যা বাড়তে পারে। যদি সময়োপযোগী রাজনৈতিক এজেন্ডা নির্ধারণ ও জনমানুষের দাবিকে ধারণ করতে পারলে ভোটাররা নতুন রাজনৈতিক শক্তির প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে।
এই যুগসন্ধিক্ষণে এসে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী গঠিত রাজনৈতিক দল ও উদ্যোগ সমূহের সাহসী উদ্যোগ বিদ্যমান ব্যবস্থাকে যেমন চ্যালেঞ্জ করছে ঠিক তেমনি বিদ্যমান সিস্টেমের দরুন পোহানো ভোগান্তি থেকে মুক্তির আশাও আশাও জনমনে ক্রমশ বাড়ছে। বিশ্বের অন্যান্য স্থানে ছাত্র ও যুব নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক আন্দোলন সফল বিদ্যমান সিস্টেমের বিরুদ্ধে জয়ী হয়েছে তা বাংলাদেশের তরুণদেরও পথ দেখাচ্ছে। যেমন, চিলিতে ২০১১ সালের ছাত্র আন্দোলন “ফ্রেন্তে অ্যাম্প্লিও” (Frente Amplio) নামক একটি জোট তৈরি করে, যা পরে দেশের সাংবিধানিক সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একইভাবে, তিউনিসিয়ার ২০১১ সালের আরব বসন্ত বিদ্রোহ নতুন রাজনৈতিক শক্তিগুলোর উত্থান ঘটায়, যা দেশটির গণতান্ত্রিক রূপান্তরে ভূমিকা রাখে। এই উদাহরণগুলো দেখায় যে, NCP ও রিফাত-জুনায়েদ নেতৃত্বে নব গঠিত রাজনৈতিক উদ্যোগে এর স্বপ্ন অসম্ভব নয়—তবে এটি অর্জন করতে হলে তাদের সুসংগঠিত কাঠামো, রাজনৈতিক পরিচয় ও দীর্ঘমেয়াদি কৌশল প্রয়োজন।
চ্যালেঞ্জ:
নতুন দলগুলোর সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ থাকবে তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সমূহকে বাস্তবে পরিণত করা। বিশেষত, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ এমন যে, একতাবদ্ধতা এবং দলগুলোর মধ্যে সহযোগিতা প্রতিষ্ঠা বেশ কঠিন। বিশেষ করে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক গোষ্ঠীবদ্ধতার প্রবণতা বেশি, যা নতুন দলগুলোর জন্য বড় বাধা হতে পারে। সেকেন্ড রিপাবলিক গঠনের পথে সংবিধানের পরিবর্তন ও গণপরিষদ নির্বাচন একটি বড় রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করতে পারে। এমন সব দলীয় ইশতেহারের ফলে অন্যান্য রাজনৈতিক দল গুলোর মধ্যে অনৈক্যের সৃষ্টি হতে পারে। ফলে ভোটের মাঠে ঠিকে থাকাটাও নতুন দলের জন্য একটি কঠিন বৈতরণী হবে।কারণ বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে অধিকাংশ ভোটারই কম শিক্ষিত ও রাজনৈতিক সচেতনতার অভাবের ফলে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী রাজনৈতিক উদ্যোগসমূহের পক্ষে ভোট ব্যাংক অর্জন ও নতুন বন্দোবস্তের প্রতি জনগণের একটা অংশকে আগ্রহী করতে তীব্র বাধায় পড়তে হতে পারে। ২০২৫ সালের মার্চে ইনোভেশন কনসাল্টিং বাংলাদেশ পরিচালিত সর্বশেষ জরিপে দেখা যায় অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য ফলাফলে BNP ৪১.৭% সমর্থন নিয়ে শীর্ষে, জামায়াতে ইসলামী ৩১.৬% সমর্থন নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে, AL ১৩.৯%, এবং নবগঠিত NCP মাত্র ৫.১% সমর্থন পেয়েছে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, বিপ্লব পরবর্তী রাজনৈতিক উদ্যোগ ও NCP জনগোষ্ঠীর একটা অংশকে আশা জাগালেও বিপ্লবী উদ্দীপনাকে কার্যকর রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত করার পথে এখনও সামগ্রিক ভাবে আগাতে পারেনি।ফলে বিএনপির পুনরুত্থান ও জামায়াতের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নতুন দলগুলোর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জও বটে।
এছাড়া, নতুন দলগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য আর্থিক এবং সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি করা। অর্থায়ন এবং নির্বাচনী প্রস্তুতি নিয়ে তাদের বড় ধরনের পরিকল্পনা দরকার। অনেক সময় নতুন দলের নেতা ও সদস্যরা পুরনো রাজনৈতিক দলের দ্বারা ম্যানিপুলেটেড হতে পারে, বিশেষত যখন তারা সরকার বা বড় রাজনৈতিক শক্তির কাছ থেকে সমর্থন লাভের চেষ্টা করবে।
এছাড়াও নতুন দলকে বেশ কিছু চ্যালেনঞ্জ সামনে রেখে চলতে হবে –
১. সংগঠন গঠনের চ্যালেঞ্জ: বিএনপি ও জামায়াতের সুপ্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক নেটওয়ার্কের বিপরীতে NCP ও অপর নতুন রাজনৈতিক উদ্যোগ সমূহের সংগঠন গড়ে তোলা কঠিন হবে। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সমর্থন যথেষ্ট নয়; সারাদেশে একটি শক্তিশালী ভিত্তি গড়ে তোলা প্রয়োজন।
২. নির্বাচনী কৌশল: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার নেতৃত্বে রয়েছে মুহাম্মদ ইউনূস, ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের মার্চের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের পরিকল্পনা করছে। NCP সংবিধান পুনর্লিখনের জন্য একটি সংবিধান সভার দাবি তুলেছে, যা BNP-এর দ্রুত সাধারণ নির্বাচনের দাবির বিপরীত। এই মতানৈক্য নেপালের ২০০৬ পরবর্তী রাজনৈতিক অচলাবস্থার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।
৩. রাজনৈতিক মতাদর্শিক (আইডিওলজিক্যাল) অস্পষ্টতা : নতুন দলগুলো গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের পক্ষে কথা বললেও, তাদের মতাদর্শিক অবস্থান এখনও স্পষ্ট নয়। তাদের ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। কিছু অংশের ইসলামপন্থিদের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে।এই ধরনের অস্পষ্টতা তাদের সমর্থকদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার কারণ হতে পারে, যা ২০১১ সালের মিশরের আরব বসন্ত-পরবর্তী সংকটের স্মৃতি জাগায়। সেখানে মুসলিম ব্রাদারহুডের উত্থান উদারপন্থি বিপ্লবীদের বিচ্ছিন্ন করেছিল।
৪. সাংগঠনিক দুর্বলতা ও আর্থিক সীমাবদ্ধতা: নতুন দলগুলোর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো একটি শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তোলা। বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীর মতো প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর তুলনায় NCP, UPB এবং অন্যান্য নতুন উদ্যোগের সাংগঠনিক ভিত্তি এখনও দুর্বল। শুধু শহুরে এলাকা বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সমর্থন যথেষ্ট নয়; গ্রামীণ এলাকায় শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া, নির্বাচনী প্রচারণা এবং সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সংস্থান সংগ্রহ করাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
৫. প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর প্রতিযোগিতা: ২০২৫ সালের মার্চে ইনোভেশন কনসাল্টিং বাংলাদেশের জরিপ অনুযায়ী, বিএনপি ৪১.৭% এবং জামায়াতে ইসলামী ৩১.৬% সমর্থন নিয়ে নির্বাচনে এগিয়ে রয়েছে, যেখানে NCP মাত্র ৫.১% সমর্থন পেয়েছে। এই পরিসংখ্যান ইঙ্গিত দেয় যে, গণঅভ্যুত্থানের উদ্দীপনা সত্ত্বেও নতুন দলগুলো এখনও প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে রয়েছে। বিএনপি এবং জামায়াতের সুপ্রতিষ্ঠিত ভোটব্যাংক এবং সাংগঠনিক কাঠামো নতুন দলগুলোর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
৬. নির্বাচনী কৌশল ও রাজনৈতিক সংকটের ঝুঁকি: NCP ও গণঅভ্যুত্থানের তরুণদের এর সংবিধান পুনর্লিখন এবং গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি বিএনপি’র দ্রুত সাধারণ নির্বাচনের দাবির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই মতানৈক্য রাজনৈতিক অচলাবস্থা সৃষ্টি করতে পারে, যেমনটি নেপালে ২০০৬ সালের পর দেখা গিয়েছিল। এছাড়া, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের জন্য নতুন দলগুলোর কার্যকর কৌশল এবং জনগণের মধ্যে তাদের দাবি জনপ্রিয় করার ক্ষমতা সীমিত থাকতে পারে।
৭. জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব: বাংলাদেশের অধিকাংশ ভোটার কম শিক্ষিত এবং রাজনৈতিক সচেতনতার অভাবে প্রথাগত দলগুলোর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। নতুন দলগুলোর জন্য তাদের উদ্দেশ্য এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ধারণা সাধারণ জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ। গ্রামীণ এলাকায় ভোটারদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি না করতে পারলে নতুন দলগুলোর ভোটব্যাংক সীমিত থেকে যেতে
পারে।
বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টারের এক জরিপ অনুযায়ী, নতুন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বন্দোবস্তের সাথে তরুণরা পুরোনো দলগুলোর ভেতরেও সংস্কার চায়।যদিও বিষয়টি জটিল ও সময় সাপেক্ষ তবু NCP-এর প্রতিষ্ঠাতা সমাবেশে বিদ্রোহের শহীদদের পরিবার ও বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের অংশগ্রহণ এবং জুলাই অভ্যুত্থানের অপর রাজনৈতিক প্লাটফর্ম সমূহের জনসম্পৃক্ত উদ্যোগ নতুন শুরুর সম্ভাবনা তৈরি করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনৈতিক ইতিহাস বাংলাদেশকে একটি দৃষ্টান্ত দিতে পারে। সেখানে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (ANC) দীর্ঘদিন রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করলেও, পরে ইকোনমিক ফ্রিডম ফাইটার্স (EFF)-এর মতো দলগুলো যুব অসন্তোষ থেকে জন্ম নেয়।ফলে চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলায় কৌশলী কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ ও জনমানুষের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে পারলে তরুণদের নেতৃত্বে গঠিত নতুন রাজনৈতিক দলগুলোও সম্ভাবনাকে জয়ের বন্দরে নিয়ে যেতে পারবে। যেমন ভারতের “Aam Aadmi Party” (AAP) গত কয়েক বছরে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। তাদের রাজনৈতিক ভিশন, পথচলায় ন্যায্যতা, স্বচ্ছতা, এবং মানুষের মধ্যে বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা এই যাত্রাকে ত্বরান্বিত করেছে। এক্ষেত্রে, নতুন রাজনৈতিক দলগুলো যদি জনগণের কাছে তাদের উদ্দেশ্য এবং দৃষ্টিভঙ্গি সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারে, তাহলে তারা বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে সক্ষম হতে পারে।
২০২৪’র গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এই অভ্যুত্থান শুধু একটি সরকারের পতন নয়, বরং একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য জনগণের গভীর আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ। নতুন দলগুলো, বিশেষ করে NCP, UPB এবং অন্যান্য ছাত্র-জনতার উদ্যোগ, এই আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার সম্ভাবনা রাখে। তাদের তরুণ নেতৃত্ব, গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি এবং পুরনো বন্দোবস্তের প্রতি জনগণের হতাশা তাদের জন্য একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করেছে।
তবে, সাংগঠনিক দুর্বলতা, মতাদর্শিক অস্পষ্টতা এবং প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর প্রতিযোগিতার মতো চ্যালেঞ্জগুলো তাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে নতুন দলগুলোকে একটি সুসংগঠিত কাঠামো, স্পষ্ট রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং জনগণের সঙ্গে গভীর সংযোগ স্থাপনের কৌশল গ্রহণ করতে হবে। আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্ত, যেমন ভারতের AAP বা দক্ষিণ আফ্রিকার EFF, তাদের জন্য পথনির্দেশক হতে পারে।
নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রয়োজনীয়তা শুধু গণঅভ্যুত্থানের ফলাফল নয়, বরং এটি বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি গণতান্ত্রিক উন্নয়নের জন্য একটি অপরিহার্য পদক্ষেপ। এই বন্দোবস্তের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, নির্বাচনী ব্যবস্থার পুনর্গঠন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক কাঠামো নিশ্চিত করা সম্ভব। তবে, এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য নতুন দল ও গণ অভ্যুত্থানের শক্তি গুলোকে ধৈর্য, কৌশল এবং সকল অংশীজনের সঙ্গে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগোতে হবে।
শেষ পর্যন্ত, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর সাফল্য নির্ভর করবে তাদের জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে কতটা বাস্তবে রূপ দেওয়ার সক্ষমতার উপর। যদি তারা তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারে এবং চ্যালেঞ্জগুলোকে কৌশলগতভাবে মোকাবিলা করতে পারে, তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে পারে—যা গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
ইখতিয়ার মাহমুদ: সাংবাদিক ও অ্যাক্টিভিস্ট; শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত