ফ্যাসিজমের প্রচার কেন নিষিদ্ধ হবে না?

| আপডেট :  ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:০৪  | প্রকাশিত :  ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:০৪

তখন সবে যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন ইলিনয় ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডির ক্লাস শুরু করেছি। সময়টা ২০১৮ সালের ফল সেমিস্টার। এক সকালে ইউনিভার্সিটি পুলিশের কাছ থেকে একটি ইমেইল পেলাম। ইমেইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীর পরিচয় জানতে চাওয়া হয়েছিলো যার বিরুদ্ধে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী ও নব্য নাৎসি গোষ্ঠীর সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছিল। যদি কেউ ওই নামের কাউকে দেখেন/চিনেন তাহলে সাথে সাথে যাতে পুলিশের কাছে রিপোর্ট করে। এই ছিলো ইমেইলের উদ্দেশ্য। আমি যেহেতু ওই নামের কাউকে চিনি না, তাই ইমেইলের রিপ্লাই করি নাই।

সপ্তাহখানেক পর ইউনিভার্সিটির কাছ থেকে আরেকটি ইমেইল পেলাম। যেখানে বলা হলো ওই স্টুডেন্টকে বিশ্লবিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কী তার অপরাধ? ওই শিক্ষার্থী ‘ফাশ ড্রাগন’ নামে একটি প্রোফাইলের অধীনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেকে নব্য নাৎসী বলে পরিচয় দিয়েছে। এছাড়া ওই একাউন্ট থেকে তিনি আফ্রিকান-আমেরিকান, সমকামী, এবং ইহুদিদের ঘৃণা করার কথা বলেন এবং বিভিন্ন ছবিও পোস্ট করেন। ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্ট রাইটের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ফ্যাসিজমের প্রচার পুরোপুরি নিষিদ্ধ নয়। তবে অন্য শিক্ষার্থীরা যখন ওই শিক্ষার্থীর কর্মকান্ডে নিজেদের অনিরাপদ মনে করে ক্যাম্পাসে র্যালী করেছে তখন সেটা স্বভাবতই আর মত প্রকাশের স্বাধীনতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। 

আমি আরেক বাংলাদেশি শিক্ষার্থীকে চিনি যিনি ক্লাসে উদাহরণ টানতে গিয়ে নাৎসিজমের কথা বলেছিলেন এবং শিক্ষকের মনে হয়েছে তার ওই উদাহরণ ফাসিজমের পক্ষে গেছে। এটা নিয়ে তদন্ত কমিটি হয়। তদন্ত কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক ওই শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভর্তি ক্যান্সেল করে অন্য জায়গায় ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ওই শিক্ষার্থী ভর্তি ক্যান্সেল করে দেশে চলে আসে। 

এই দুই ঘটনা থেকে পরিষ্কার যুক্তরাষ্ট্রে ফ্যাসিজমের প্রচার ও প্রসারকে কতটা নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। ফ্যাসিজমের অন্যতম মতাদর্শ নাৎসিজমের উৎপত্তি জার্মানিতে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশটি কঠোর আইন প্রণয়ন করেছে নাৎসি মতাদর্শের পুনর্জীবন ঠেকানোর জন্য। জার্মানিতে নাৎসি প্রতীক (যেমন স্বস্তিকা, এসএস প্রতীক) প্রদর্শন, নাৎসি অপরাধ (বিশেষত হলোকাস্ট) অস্বীকার এবং নাৎসি সংগঠন গঠন করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। শুধু যুক্তরাষ্ট্র-জার্মানি নয়, অস্ট্রিয়া, পোল্যান্ড, ফ্রান্স, হাঙ্গেরি, ইতালি,ইসরায়েল, রাশিয়া, স্লোভাকিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, বেলজিয়াম এবং নেদারল্যান্ডস সহ অনেক দেশে ফ্যাসিজমের প্রতীক ও আদর্শের বিরুদ্ধে আইনগত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এসব দেশে কেন ফ্যাসিস্ট মতাদর্শ নিষিদ্ধ করা হয়েছে তা জানতে হলে প্রথমে ফ্যাসিজম কি এবং এটা কীভাবে সমাজে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার হরণ করে তা জানতে হবে। 

ফ্যাসিজম মূলত একটি স্বৈরাচারী রাজনৈতিক মতবাদ যা চরম জাতীয়তাবাদ, একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা এবং বিরোধী মতাদর্শের দমনকে গুরুত্ব দেয়। এটি ২০ শতকের শুরুর দিকে ইউরোপে উদ্ভূত হয়েছিল, বিশেষত ইতালিতে বেনিটো মুসোলিনি এবং নাৎসি জার্মানিতে অ্যাডলফ হিটলারের শাসনকালে। ফ্যাসিবাদ গণতন্ত্র ও উদারবাদকে প্রত্যাখ্যান করে এবং পরিবর্তে একটি কেন্দ্রীভূত, স্বৈরাচারী সরকার গড়ে তুলতে চায় যা একজন নেতা বা শাসক দলের নেতৃত্বে জনজীবনের অনেক দিককে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে। মুসোলিনি ১৯২০-এর দশকের গোড়ার দিকে ইতালিতে ফ্যাসিস্ট আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। তিনি একটি স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন যা ইতালীয় জাতীয়তাবাদ, সামরিকবাদ এবং রাজনৈতিক বিরোধিতার দমনকে প্রচার করেছিল। মুসোলিনির শাসনব্যবস্থা আক্রমণাত্মক সাম্রাজ্যবাদের মাধ্যমে ইতালীয় ভূখণ্ড সম্প্রসারণেরও চেষ্টা করেছিল। একইভাবে জার্মানিতে হিটলারের নাৎসি শাসন (১৯৩৩–১৯৪৫) ছিল একটি চরম ফ্যাসিবাদী রূপ, যা চরম জাতীয়তাবাদ, স্বৈরাচারিতা, সামরিকবাদ এবং বর্ণবাদের সমন্বয় ঘটিয়েছিল। নাৎসিরা একটি বর্ণগতভাবে ‘বিশুদ্ধ’ আর্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল, যার ফলে হলোকাস্টের গণহত্যা নীতি এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটে।

যদিও ধ্রুপদী ফ্যাসিবাদ ২০ শতকে তার শীর্ষে পৌঁছেছিল, কিছু আধুনিক রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা ফ্যাসিস্ট প্রবণতা দেখায়, স্বৈরাচারিতা, চরম জাতীয়তাবাদ এবং বিরোধিতার দমনের মাধ্যমে। এই ব্যবস্থাকে প্রায়শই নব্য-ফ্যাসিস্ট  হিসাবে বর্ণনা করা হয় এবং বিশ্বের কিছু অংশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করে চলেছে। গত ১৬ বছর ধরে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ যেটা করেছে তা একধরণের ফ্যাসিবাদই। আওয়ামী লীগ সুষ্ঠু নির্বাচন না করে গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে, বহুমতের উদারবাদকে প্রত্যাখান করে একটি স্বৈরচারী সরকার ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে যা শেখ হাসিনাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। মুজিববাদ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে চরম জাতীয়তাবাদের চর্চা করেছে, এবং বিরোধীদের দমন পীড়নে আয়নাঘরের মতো ঘৃণ্য কারাগার চালু করেছে। গুম, খুন, ক্রসফায়ারের মাধ্যমে অসংখ্য মানুষকে বিনাবিচারে হত্যা করেছে। 

ফ্যাসিজমের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরা সাধারণত স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রতি সমর্থন দেয়, যেখানে একনায়কত্বের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। গত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ এটাই করেছে। এরা গণতন্ত্রের পরিপন্থী, কারণ আওয়ামী ফ্যাসিস্ট শাসন ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের অধিকারকে চরমভাবে হ্রাস করেছে এবং এক নেতার অধীনে শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। গণতান্ত্রিক সমাজে এ ধরনের একনায়কত্ব বা স্বৈরতান্ত্রিকতা গ্রহণযোগ্য নয়।

ফ্যাসিস্ট মতবাদ প্রায়ই জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব ও বর্ণবাদকে সমর্থন করে। নাৎসি ফ্যাসিজম যেমনটি ইহুদি, রোমা এবং অন্য জাতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যাপক নির্যাতন চালিয়েছিল, তেমনিভাবে আওয়ামী ফ্যাসিজম বিরোধী দল তথা বিএনপি-জামায়াত-হেফাজতের ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালিয়েছে। এই কারণে, অনেক দেশে ফ্যাসিস্ট মতাদর্শ জাতিগত বা ধর্মীয় বিদ্বেষের কারণে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। 

ফ্যাসিজমের ইতিহাসে সহিংসতা, দমনমূলক পদ্ধতি, এবং যুদ্ধাপরাধ জড়িত। উদাহরণস্বরূপ, নাৎসি জার্মানির অধীনে হিটলারের নেতৃত্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং হলোকাস্ট সংঘটিত হয়, যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। আর আওয়ামী ফ্যাসিজম গুম, আয়নাঘরে বন্দি, মামলা, খুন, গণহত্যাসহ অনেক ধরণের সহিংসতার সঙ্গে জড়িত। ফ্যাসিজমের প্রচার থাকলে তা আবারও ফ্যাসিস্ট সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের সুযোগ করে দিবে।

ফ্যাসিস্ট শাসনব্যবস্থায় ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক অধিকারের উপর গুরুতর আঘাত করা হয়। ফ্যাসিস্ট শাসনব্যবস্থা গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সীমিত করে এবং যারা শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে যায় তাদের নিপীড়িত করে। গত ১৫ বছরের আওয়ামী ফ্যাসিস্ট শাসনের খতিয়ান খুললেই দেখবেন এরা ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টসহ বিভিন্ন দমনমূলক আইনের মাধ্যমে কীভাবে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক অধিকারের উপর আঘাত করেছে। 

ফ্যাসিজম সমাজে বিভাজন ও অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। ফ্যাসিস্ট মতবাদ জনগণের মধ্যে ভেদাভেদ ও বিভাজনকে উৎসাহিত করে এবং সাধারণত হিংসা ও অস্থিরতার জন্ম দেয়। গত ১৫ বছরের আওয়ামী শাসনামলে বাংলাদেশকে স্পষ্টতই বিভাজন করে ফেলা হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বনাম অবিশ্বাসী। এই ন্যারেটিভটাকে এমনভাবে দাঁড় করানো হয়েছে কেউ সরকারের সমালোচনা করলেই তাকে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ট্যাগ দেয়া হয়, সামাজিকভাবে হেয় করা হয়। এতে করে তাদেরকে নিজ দেশে দ্বিতীয় স্তরেরর নাগরিক মনে করা হয়। এই ধরণের সামাজিক বিশৃঙ্খলা এবং অস্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ফ্যাসিজমের প্রচার নিষিদ্ধ করা উচিত।

গত পাঁচ অগাস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পলায়নের পর থেকে আওয়ামী ফ্যাসিজমের প্রচার বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে নিউইয়র্কের রাস্তায় ডিজিটাল ব্যানারের মাধ্যমে নানারকম অপপ্রচার চালাচ্ছে । এই অপপ্রচারগুলোর অধিকাংশই ভুয়া তথ্য যা সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টি, জাতিগত ঘৃণা প্রচার এবং ভবিষ্যতে ফ্যাসিজমের পুণপ্রতিষ্ঠায় সহায়তা করছে।  ফ্যাসিবাদের প্রচার মত প্রকাশের স্বাধীনতার মধ্যে পড়ে না। এটা স্পষ্টতই অপরাধ যা সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টিতে উস্কানি দেয়। তাই ফ্যাসিজমের প্রচার ও প্রসারের লাগাম টানা উচিত এবং সেটা এখনই।

লেখক : ড. জাহেদ আরমান, অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, ফ্রামিংহাম স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র।

  • সর্বশেষ খবর
  • সর্বাধিক পঠিত