দুর্ঘটনায় নিহতের মর্যাদা ও অভিভাবকের সুসংবাদ
সম্প্রতি একটি বিমান দুর্ঘটনায় স্তব্ধ পুরো দেশের মানুষ। কোমলমতি শিশুদের চিৎকার, বিধ্বস্ত বিমানের লেলিহান শিখা, ছোপ ছোপ রক্তের দাগ, পোড়া মাংসের গন্ধ এখনো বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। দেশের শিক্ষার্থীরা যখন জুলাই বিপ্লবের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত নানা অনুষ্ঠানে নিজেদের জীবন নতুন করে সাজাতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই শিক্ষার্থীদের ওপর নেমে এলো এক ভয়াল ট্র্যাজেডি। ২১ জুলাই সোমবার দুপুর ১টা ১৮ মিনিটে রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে হঠাৎ বিধ্বস্ত হয় বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি এফটি-৭ বিজিআই প্রশিক্ষণ বিমান। বিকট শব্দে বিধ্বস্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আগুন ধরে যায় ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে। এ সময় স্কুল শাখায় প্রথম থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস চলমান ছিল। হঠাৎ বিকট শব্দে বিমানটি ভেঙে পড়লে মুহূর্তেই সেখানে তৈরি হয় কেয়ামতের বিভীষিকা। শুরু হয় শিক্ষার্থীদের কান্না, আতঙ্কিত অভিভাবকদের ছোটাছুটি এবং আগুনে পুড়ে যাওয়া এলাকার হৃদয়বিদারক দৃশ্য। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩২ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। হাসপাতালে আহত ও অগ্নিদগ্ধ দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী, স্টাফ ও অভিভাবক। বিমানবাহিনীর বিধ্বস্ত প্রশিক্ষণ বিমানটির পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলাম সাগরও মারা গেছেন। এ দুর্ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেন নোবেলজয়ী ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দেশজুড়ে রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়।
এ দুঃখজনক ঘটনায় অধিকাংশই শিশুশিক্ষার্থী অগ্নিদগ্ধ হয়ে আহত-নিহত হয়েছে, যা গোটা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছে। তাদের স্বজনদের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। তাদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা কারও জানা নেই। তবে প্রিয় নবীজি (সা.)-এর ভাষায়, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত মুমিন ব্যক্তির জন্য বিশেষ পুরস্কারের ঘোষণা তাদের কষ্টকে কিছুটা লাঘব করবে বলে আশা করি। হাদিসের ভাষ্যমতে, আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া ব্যক্তি শহীদি মর্যাদা লাভ করবে। ইসলামে সর্বোত্তম ও সবচেয়ে সম্মানজনক মৃত্যু হলো শহীদি মৃত্যু। প্রকৃত শহীদ হলো—যারা তাওহিদের কালেমাকে সমুন্নত করার খালেস নিয়তে আল্লাহর পথে লড়াই করে মারা যায়। আল্লাহর কাছে তাদের মর্যাদা সবচেয়ে বেশি। আল্লাহতায়ালা তাদের ব্যাপারে বলেছেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় যারা নিহত হয়, তাদের তোমরা মৃত বলো না। বরং তারা জীবিত; কিন্তু তোমরা অনুভব করতে পারো না।’ (সুরা বাকারা: ১৫৪)। অন্য এক আয়াতে এসেছে, তারা রবের পক্ষ থেকে রিজিকপ্রাপ্ত (সুরা ইমরান: ১৬৯)। এই প্রকারের শহীদ সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, তাদের রুহ সবুজ পাখির পেটে (রক্ষিত থাকে), যা আরশের সঙ্গে ঝুলন্ত দ্বীপাধারে বাস করে। জান্নাতের সর্বত্র তারা বিচরণ করার পর দ্বীপাধারগুলোতে ফিরে আসে। আল্লাহ যখন তাদের কোনো আকাঙ্ক্ষা আছে কি না জিজ্ঞেস করেন, তখন তারা বলে আর কী আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে, আমরা তো যথেচ্ছভাবে জান্নাতে বিচরণ করছি। কোনো আকাঙ্ক্ষার কথা জানাতে না পেরে একপর্যায়ে তারা মহান আল্লাহকে বলেন, আমাদের রুহগুলোকে আমাদের দেহগুলোয় ফিরিয়ে দিন, আর পুনরায় আপনারই পথে নিহত (শহীদ) হই।’ (সহিহ মুসলিম: ৪৭৩২)।
তবে আরও অনেক ব্যক্তিকে শহীদ বলে ঘোষণা করেছেন রাসুলুল্লাহ (সা.)। এরা বিধানগত শহীদের আওতাভুক্ত। তাদের মধ্যে রয়েছেন মহামারিতে, আগুনে পুড়ে, পানিতে ডুবে ও বিভিন্ন দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণকারীরা। আবদুল্লাহ ইবনে জাবের (রা.) তার বাবার সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) তার বাবা জাবের (রা.)-কে তার রোগশয্যায় দেখতে গেলেন। তার কাছে গিয়ে দেখলেন নারীরা কেঁদে কেঁদে বলছে, আমরা মনে করেছিলাম, তুমি আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়ে মৃত্যুবরণ করবে। তখন মহানবী (সা.) বলেন, আল্লাহর রাস্তায় শহীদ না হলে তোমরা কাউকে শহীদ মনে করো না? এমন হলে তো তোমাদের শহীদের সংখ্যা অতি অল্পই হবে। আল্লাহর রাস্তায় নিহত ব্যক্তি শহীদ, পেটের পীড়ায় মৃত ব্যক্তি শহীদ, আগুনে পুড়ে মৃত ব্যক্তি শহীদ, পানিতে ডুবে মৃত ব্যক্তি শহীদ, কোনো কিছুর নিচে চাপা পড়ে মৃত ব্যক্তি শহীদ, নিউমোনিয়াজাতীয় কঠিন পীড়ায় মৃত ব্যক্তি শহীদ, যে নারী গর্ভাবস্থায় মৃত্যুবরণ করে সেও শহীদ। (আবু দাউদ: ৩১১১)
জাবের বিন আতিক (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহর পথে মৃত্যুবরণ করা ছাড়াও সাত প্রকার শহীদ রয়েছে—১. মহামারিতে মৃত্যুবরণকারী; ২. পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণকারী; ৩ শয্যাশায়ী অবস্থায় মৃত ব্যক্তি; ৪. পেটের রোগে মৃত্যুবরণকারী; ৫. অগ্নিদগ্ধ ব্যক্তি; ৬. যে ব্যক্তি ধ্বংসাবশেষের নিচে পড়ে মারা যায়; ৭. সন্তান প্রসব করতে মারা যাওয়া নারী (মুয়াত্তা মালিক: ৫৫৪)। এসব হাদিসের আলোকে বিমান বিধ্বস্তের দুর্ঘটনায় মৃত ব্যক্তিরাও শহীদি মর্যাদা লাভ করবেন ইনশাআল্লাহ।
নিহত শিক্ষার্থীদের মা-বাবাদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমাদের জানা নেই। তবে মুমিনের জন্য নিরাশ হওয়ারও কিছু নেই। কারণ মুমিনের দৃষ্টিতে পৃথিবীর জীবনই একমাত্র জীবন নয়, পৃথিবীর জীবনের পর আছে আখেরাতের জীবন, জান্নাতের অনন্ত সুখের জীবন। যেসব সন্তান অল্প বয়সে মারা যায়, তারা মা-বাবার জন্য জান্নাতের দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকবে। সাহাবি কুররা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন বসতেন, তখন সাহাবিদের অনেকে তার কাছে এসে বসতেন। তাদের মধ্যে একজন সাহাবির ছোট একটি শিশুপুত্র ছিল। তিনি তার ছেলেকে পেছন দিক থেকে নিজের সামনে এনে বসাতেন। একদিন সে ছেলেটি মৃত্যুবরণ করল। ফলে সে সাহাবি খুব বিষণ্ন হয়ে পড়লেন। ছেলের শোকে তিনি নবীজি (সা.)-এর মজলিসে উপস্থিত হতেন না। কয়েক দিন তাকে না দেখে রাসুলুল্লাহ (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘অমুক ব্যক্তিকে দেখছি না কেন?’ সাহাবিরা বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনি তার যে ছোট ছেলেকে দেখেছিলেন সে মৃত্যুবরণ করেছে।’ পরে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রাসুলুল্লাহ (সা.) জিজ্ঞাসা করেন, ‘তোমার সে ছেলেটির কী হয়েছে?’ তিনি বলেন, ছেলেটির মৃত্যু হয়েছে। তখন নবীজি (সা.) তাকে সান্ত্বনা দিয়ে ধৈর্য ধারণ করতে বলেন। তারপর বলেন, ‘তোমার কাছে কোনটা বেশি পছন্দ—তার দ্বারা তোমার পার্থিব জীবন সুখময় করা, নাকি কাল কেয়ামতে জান্নাতের যে দরজা দিয়ে তুমি প্রবেশ করতে চাইবে তাকে সেখানেই পাওয়া, যেখানে সে পৌঁছে তোমার জন্য জান্নাতের দরজা খুলে দেবে?’ তিনি বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! বরং সে আমার জান্নাতের দরজায় গিয়ে আমার জন্য দরজা খুলে দেবে; এটাই আমার কাছে অধিক পছন্দনীয়।’ তখন রাসুল (সা.) বলেন, ‘তাহলে তোমার জন্য তাই হবে।’ (নাসায়ি, হাদিস: ২০৯০)।
সন্তান হারানো মা-বাবার জন্য এর চেয়ে বড় সান্ত্বনা আর কী হতে পারে যে, সন্তান হারানোর বিনিময়ে তারা জান্নাতের অনন্তকালের সুখময় জীবন লাভ করবে! আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, যে কোনো মুসলিম ব্যক্তির এমন তিনটি (সন্তান) মারা যাবে, যারা প্রাপ্তবয়স্ক হয়নি, আল্লাহ তাদের প্রতি বিশেষ রহমতে তাদের মা-বাবাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। (বোখারি, হাদিস: ১৩৮১)। হাদিসে আরও বর্ণিত হয়েছে, ছোট বয়সে মৃত্যুবরণকারী শিশু জান্নাতের প্রজাপতির মতো। আবু হাসসান (রহ.) বলেন, আমি আবু হুরায়রা (রা.)-কে বললাম, আমার দুটি সন্তান মারা গেছে। আপনি কি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর থেকে এমন একটি হাদিস বর্ণনা করবেন, যাতে আমরা অন্তরে সান্ত্বনা পেতে পারি? তখন আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, হ্যাঁ, আমি নবীজি (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ছোট বয়সে মৃত্যুবরণকারী সন্তানরা জান্নাতের প্রজাপতির মতো। তাদের কেউ যখন পিতা কিংবা মাতা-পিতা উভয়ের সঙ্গে মিলিত হবে, তখন তার পরিধানের কাপড় কিংবা হাত ধরবে, যেভাবে এখন আমি তোমার কাপড়ের আঁচল ধরেছি। এরপর সেই কাপড় কিংবা হাত আর ছাড়বে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহতায়ালা তাকে তার মা-বাবাসহ জান্নাতে প্রবেশ না করাবেন। (মুসলিম, হাদিস: ৬৩৭০)।
আসলে যার জন্ম আছে, তার মৃত্যুও অবধারিত। যখন সময় আসবে তখন তাকে কেউ আটকে রাখতে পারবে না। সময়ের একমুহূর্ত আগেও কেউ তাকে মারতে পারবে না। তবে কারও মৃত্যু যদি কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা বা কঠিন রোগে হয়, মহান আল্লাহ তার বিনিময়ে তাকে শাহাদাতের মতো অতি সম্মানের মর্যাদা দিয়ে দেন। তাই এ দুর্ঘটনায় যারা তাদের আত্মীয়স্বজন হারিয়েছেন, তাদের উচিত, নবীজি (সা.)-এর এ সুসংবাদ জানার পর ধৈর্য ধারণ করা, মহান আল্লাহর সিদ্ধান্তের ওপর রাজি থাকা। আল্লাহর কাছে নিহত স্বজনদের মাগফিরাতে দোয়া করা। গোটা দেশবাসীর দায়িত্ব দুর্ঘটনার নিহতদের জন্য দোয়া করা। এমন ঘটনা থেকে আল্লাহ যেন সবাইকে রক্ষা করেন সেজন্য আল্লাহর কাছে পানাহ চাওয়া। মহান আল্লাহ এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নিহত মুমিনদের শহীদি মর্যাদা দান করুন। তাদের পরিবার-পরিজনদের ধৈর্য ধারণের তওফিক দান করুন এবং তাদের উত্তম প্রতিদান দিন।
লেখক: মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত