জেনেভায় মানবাধিকারকর্মী আদিলুরকে দমন করে সরকারকে ইমেইল করেছিলেন সুফিউর
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। গুম, খুন, র্যাব, আয়নাঘর—এসব হয়ে ওঠে বহুল আলোচিত শব্দ। দেশ-বিদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি ধামাচাপা দিতে তৎপর হয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ঠিক এমনই এক প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালের নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে ২০২৩ সালের নভেম্বরে জেনেভা কনভেনশনে যোগ দেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
শুধু জেনেভা নয়, সরকারপ্রধানদের প্রতিটি রাষ্ট্রীয় সফরেই রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমের বাইরেও অনুষ্ঠিত হয় অনেক সাইডলাইন ইভেন্ট।
জেনেভায় সাইডলাইনে কয়েকটি ইভেন্টে যোগ দেন বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি এনজিওসহ মানবাধিকার সংগঠনের নেতারা। এমনই এক সাইডলাইন ইভেন্টে বাংলাদেশের তৎকালীন মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরতে সেমিনারে অংশ নেন মানবাধিকারকর্মী আদিলুর রহমান খান, যিনি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা। তিনি একটি পার্শ্ব-ইভেন্টে বাংলাদেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর বক্তব্য দিতে গেলে তাকে হেনস্তা করা হয়। তাকে জোর করে বের করে দেন তৎকালীন জেনেভায় নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মো. সুফিউর রহমানসহ আওয়ামী লীগ সমর্থকরা।
সেদিন জেনেভায় আদিলুর রহমানকে কীভাবে দমন করা হয়েছিল, তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে সরকারকে খুশি করতে ইমেইল করেন এবং ফ্যাক্সবার্তা পাঠান সুফিউর রহমান। সেই গোপন ইমেইলটি এসেছে কালবেলার হাতে।
সুফিউর রহমান ইমেইল বার্তায় লেখেন, কয়েকটি এনজিও/আইএনজিওএস যৌথভাবে ‘বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ইউপিআর’ শীর্ষক একটি পার্শ্ব-ইভেন্টের আয়োজন করেছিল। ইভেন্টে ছিলেন ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অ্যাগেইনস্ট টর্চার (ওএমসিটি), সিভিকস-ওয়ার্ল্ড অ্যালায়েন্স ফর সিটিজেন পার্টিসিপেশন, ফোরাম-এশিয়া, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (অনলাইন অংশগ্রহণ) প্রতিনিধিরা।
সুফিউর রহমান ইমেইল বার্তায় লেখেন, ‘আদিলুর রহমান খানের উপস্থিতি দেখে আমরা অনুমান করেছি, তিনি একটি শক্তিশালী সরকারবিরোধী বক্তব্য দেবেন। আশঙ্কা ছিল, আদিলুর রহমান এবং সেইসঙ্গে অন্যরা তাদের একতরফা, পক্ষপাতদুষ্ট, আংশিক এবং ভিত্তিহীন বর্ণনা দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে বহির্বিশ্বে বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেবেন।’ তখন আদিলুর রহমানকে নিরস্ত করেন সুফিউর রহমান, যা তিনি তার ইমেইলে উল্লেখ করেছেন। ইমেইলটি তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠান।
ইভেন্টে আদিলুর রহমানের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থকদের মধ্যে বাগবিতণ্ডা হয় জানিয়ে সুফিউর লেখেন, ‘ইভেন্ট-পরবর্তী ঘটনাবলি নিয়ে মানবাধিকারবিষয়ক ডেপুটি হাইকমিশনার নাদা আল-নাশিফ হাইকমিশনারের অফিসে বিস্তারিত জানতে চাইলে মানবাধিকার কাউন্সিলের সভাপতি আমাকে কল করেন, আমি চেক প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রদূত ভ্যাক্লাভ বালেকের সঙ্গে তার অফিসে দেখা করি। তখন তিনি এ ঘটনায় উদ্বেগ জানান। তবে তাকে আমি জানাই, আদিলুর রহমান খান এমন একজন ব্যক্তি, যিনি রাজনৈতিকভাবে বিরোধী দল বিএনপি ও অধিকারের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। অধিকারের নিবন্ধন নবায়ন করা যাচ্ছে না কেন, তারও পুরো বিবরণ দিয়েছি ভ্যাক্লাভ বালেকের কাছে। তা ছাড়া আমি ২০১৩ সালে হেফাজতের আন্দোলন ঘিরে মিথ্যা প্রচার এবং অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে আদিলুর রহমানের সরাসরি জড়িত থাকার ব্যাখ্যা দিয়েছি।’
সুফিউর রহমান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আরও লেখেন, ‘আদিলুর রহমান খান মানবাধিকার রক্ষাকারীর পোশাকে একজন সম্পূর্ণ পক্ষপাতদুষ্ট ব্যক্তি এবং বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হয়েছিলেন, তা আমি তাদের জানিয়েছি।’
ইমেইলে সুফিউর রহমান স্পষ্ট করেছেন, তিনি কীভাবে আদিলুর রহমানকে পরাস্ত করে আওয়ামী লীগ সরকারকে রক্ষা করেছেন। আদিলুর রহমান খানকে একজন দোষী ব্যক্তি হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করেন সুফিউর। তিনি বলেন, আদিলুর রহমান জেনেভায় এসে বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনের ঠিক আগে দেশের রাজনৈতিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে একের পর এক অসত্য ও বানোয়াট তথ্য উপস্থাপন করেছেন।
সাবেক এই রাষ্ট্রদূত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ইমেইল বার্তায় পরামর্শ দিয়েছেন, ‘ভবিষ্যতে এমন ইভেন্টে আমরা এনজিওকর্মী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে নিরুৎসাহিত করি। কারণ এখানে এসে এসব লোক নিজেদের জাহির করে থাকে।’
এ বিষয়ে অধিকারের পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন ইলন কালবেলাকে বলেন, আদিলুর রহমান খান একজন মানবাধিকারকর্মী। তাকে জেনেভায় বক্তব্য দিতে না দিয়ে তার বাকস্বাধীনতা হরণ করেই তারা থেমে যাননি। বরং আদিলুর রহমান দেশে ফিরে আসার পথে এয়ারপোর্টে বিভিন্ন স্থানে দুই ঘণ্টা বিনা কারণে এবং বিনা দোষে নানা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে কর্তৃপক্ষ এবং তার সঙ্গে অসদাচরণ করেছে, যা কখনোই কাম্য ছিল না।’
সুফিউর রহমান ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে এ বছরের (২০২৪) মে পর্যন্ত সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং জেনেভার জাতিসংঘ অফিসগুলো ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থায় বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের জেনেভা অফিসে তিনি তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে জবাবদিহি নিশ্চিত করতেন এবং যুক্তি উপস্থাপন করতেন।
নবম বিসিএস পররাষ্ট্র ক্যাডারের কর্মকর্তা সুফিউর রহমান ১৯৯১ সালে চাকরিতে যোগ দেন। পদক্রম তালিকায় শেষের দিকে থাকলেও ২০১২ সালে আওয়ামী লীগ সরকার কয়েকজনকে ডিঙিয়ে তাকে রাষ্ট্রদূত বানায়। তিনি এক দশকের বেশি সময় ধরে বিশ্বাসযোগ্য ও প্রভাবশালী রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত