কেজি দরে বিক্রি হওয়া ভাস্কর্যটি মুক্তিযোদ্ধার নয়
রাজশাহীতে একটি ভাস্কর্য ভাঙারির দোকানে বিক্রি হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। তবে ভাস্কর্যটি মুক্তিযোদ্ধার নয়, পাক আর্মির আদলে হওয়ায় ভাস্কর অধ্যাপক ড. আমিরুল মোমেনীন চৌধুরী ওরফে জোসি নিজেই বিক্রি করে দিয়েছেন।
কিন্তু ‘ঘটনাটিকে বিকৃত করে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। তবে এটিকে একটি মহল রাজনৈতিক ইস্যু বানানোর অপচেষ্টা করছেন’- এমন অভিযোগ তুলেছেন ভাস্কর ড. আমিরুল মোমেনীন চৌধুরী।
তিনি বলেন, ভাস্কর্যটির ঠিকমতো রূপ দেওয়া যায়নি। তাই এটি কাজে লাগানোর সুযোগ নেই। তাই ওয়েস্টেজ (অপচয়) হিসেবে আমি বিক্রি করে দিয়েছিলাম। রোববার আবার ফেরত নিয়ে এসেছি।
গেল ৫ আগস্টের পর বর্তমান প্রেক্ষাপটে মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্যটি কোথাও বিক্রি করা সম্ভব নয়, তাই ভাঙারির দোকানে বিক্রি করে দিয়েছেন ভাস্কর ড. আমিরুল মোমেনীন চৌধুরী- এমন সংবাদে গেল কয়েক দিন ধরেই গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
এ ছবিটি পোস্ট করে কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে আওয়ামী লীগের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজ থেকে। ছবিটি শেয়ার করে তীর্যক কবিতা লিখে নিজের ফেসবুকে শেয়ার করেছেন বিতর্কিত লেখক তসলিমা নাসরিনও।
কিন্তু এই প্রচারণাকে অসত্য ও রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি বলে দাবি করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাফিক ডিজাইন, কারুশিল্প ও শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. আমিরুল মোমেনীন চৌধুরী। তিনি জানিয়েছেন, এক যুগ আগে নওগাঁর জেলা পরিষদের চাহিদার প্রেক্ষিতে ঠিকাদারের কথায় ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু শর্ত না মেনে নির্মাণ করায় তারা এটি গ্রহণ করেনি। পরে তাদের রড-সিমেন্ট দিয়ে আরেকটি ভাস্কর্য নির্মাণ করে দেন। এরপর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারু অনুষদের পেছনে মেহেরচণ্ডী মধ্যপাড়ায় তার নিজের স্টুডিওতে রাখা ছিল এটি। নিজের জায়গাতেই এ স্টুডিওটি। এখানে নানা শিল্পকর্ম নির্মাণ করেন ড. আমিরুল মোমেনীন।
রোববার (২৪ নভেম্বর) দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বিক্রি করা ভাস্কর্যটি স্টুডিও আঙিনাতে রাখা। ভেতরে পুরো লোহার পাত দেওয়া রয়েছে। বাইরের অংশ স্টিল দিয়ে তৈরি। উচ্চতা প্রায় ১৮ ফুট। এখানে আরও কয়েকটি ভাস্কর্য রাখা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো- বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের আবক্ষ ভাস্কর্য।
এ সময় ড. আমিরুল মোমেনীন কালবেলাকে বলেন, মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের ভাস্কর্যটিও কর্তৃপক্ষ পছন্দ করেনি। এজন্য হস্তান্তর করা যায়নি। বেশ কয়েক বছর ধরে এখানে রাখা আছে। কিন্তু এখন স্টুডিওর এই জায়গাটি বিক্রির চেষ্টা করছি। তাই স্টুডিওর সব ওয়েস্টেজ বিক্রি করে দিচ্ছি। কয়েক দিন আগে কয়েকজন এসে বললো মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্যটি কিনতে চায়। তাদের কাছে ভাঙারি লোহার মতো কেজি দরে নামে মাত্র টাকায় বিক্রি করেছিলাম। আমি তখন জানতাম না তারা ভাঙারির দোকানের জন্য কিনছে। পরে পত্রপত্রিকায় দেখেছি এ ঘটনা। তারা আসল ঘটনা না জেনেই এগুলো লিখেছে। আমি কখনোই কাউকে বলিনি, বর্তমান পরিস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্য বিক্রি করা বা রাখা যাবে না। বর্তমান সরকার তো মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী নয়। আর কোথাও এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু একটি মহল অপপ্রচার চালিয়ে এ ঘটনাকে রাজনৈতিক ইস্যু বানানোর চেষ্টা করছে। আমি এটার প্রতিবাদ করছি।
তিনি আরও বলেন, এটি আমি কোথাও স্থাপন করতে না পেরে বিক্রি করেছি এমনটাও নয়। এই ভাস্কর্যটি মূলত মুক্তিযোদ্ধার হয়নি, নির্মাণ ত্রুটির কারণে রূপ পেয়েছে পাক আর্মির। আমি চাই এটি নিয়ে কেউ যেন রাজনীতি না করেন। ভাস্কর্যটি সংশোধন করে কুড়িগ্রামের একটি জাদুঘরকে বিনামূল্যে দেবেন বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক আমিরুল মোমেনীন চৌধুরী।
এতদিন কেন এগুলো কোথাও স্থাপন করা যায়নি এমন প্রশ্নের জবাবে জোসি বলেন, এগুলো বানানোর পর আমার কাছেই মনে হয়েছিল এতে কিছু ত্রুটি আছে। মাথাগুলো ছোট হয়েছিল। আবার মাথায় পাক আর্মির মতো হেলমেট পরানো। ফলে এগুলো মুক্তিযোদ্ধার অবয়ব ভাস্কর্য হলেও ঠিক সেভাবে ফুটে ওঠেনি। এ কারণে আমার মনে হয়েছে এগুলোতে আরও কাজ করতে হবে। এ কারণে এটি নেওয়ার কেউ আগ্রহ দেখায়নি। নিজেও এটি কোথাও বসানোর জন্য তেমন চেষ্টাও করিনি।
ভাস্কর্য কেন ভাঙারির দোকানে- এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক জোসি বলেন, আমাদের একেকটি শিল্প একেকটি সন্তানের মতো। কিন্তু এটি কখন মূল্যবান হয় সেটি বুঝতে হবে। একটি ভাস্কর্য যতক্ষণ বেদিতে না বসানো হলো, তার একটা নাম দেওয়া না হলো- ততক্ষণ তো এটি ভাস্কর্যই হলো না।
রাজশাহী নগরীর বিনোদপুর বাজারের ভাঙারি ব্যবসায়ী মিলনের একটি দোকান রয়েছে। ‘খোকন আয়রন ঘর’ নামের এই দোকানটিতে বিভিন্ন পুরোনো কাগজপত্রসহ ভাঙারি জিনিসপত্র কেনা-বেচা করা হয়। এই দোকানের সামনে রাস্তার ওপরে দাঁড় করে রাখা ছিল ভাস্কর্যটি। বিনোদপুরে খোকন আয়রন ঘরে গিয়ে দেখা হয় মিলনের বাবা বাদরুদ্দীনের সঙ্গে। এসব নিয়ে তিনিও বিব্রত। এ নিয়ে কিছু বলতেও চান না বদরউদ্দীন। শুধু বললেন, এসবের তিনি কিছুই জানেন না। তার ছেলে একজনের কাছ থেকে নিয়ে এসেছেন এটুকুই তিনি জানেন। এর বেশি কিছু বলতে নারাজ তিনি।
তবে মিলন বলেন, ভাস্কর্যটি কিনে এনেছিলাম কিন্তু এ নিয়ে নানা কথা হওয়ায় রোববার আবার স্যারের স্টুডিওতে ফেরত দিয়ে এসেছি।
- সর্বশেষ খবর
- সর্বাধিক পঠিত